মানুষের আরণ্যপর্বের পর আসে কৃষি বা বর্বরতার পর্ব। যাযাবর মানুষ স্থির হয় কোনো উর্বর অঞ্চলে, হয় কৃষক; এবং পশু হয় তার প্রধান সম্পদ, মানুষ হয় গোস্বামী। ভূমিকা বদলায় নারীরও। যাযাবর আরণ্য মানুষের ছিলো শুধু বর্তমান; কিন্তু কৃষিসমাজের মানুষের বর্তমান তো রয়েছেই, রয়েছে অতীত ও ভবিষ্যৎ। তার কাছে উর্বরতা দেখা দেয় একটি বড়ো বিস্ময়রূপে। কৃষক অনুভব করে নারী ও জমি একই প্রকৃতির, উভয়ই উর্বর; চাষ করলে উভয়ই সোনা ফলায়। কিন্তু সম্পূর্ণটা তখনো বুঝে উঠতে পারে নি। তারা, নারী ও জমিতে দেখেছে তারা ইন্দ্ৰজাল, যেনো কোনো অলৌকিক যাদুতে নারী হয় সন্তানবতী, জমি ফসলভারাবনত। এ-সময় সন্তান ও ফসলের দায়িত্বও ছিলো নারীর;–নারী শুধু সন্তান ধারণ করতো না, চাষের কাজও করতো। তাই তার মূল্য ছিলো, গৌরব ছিলো। এ-সময়ই দিকেদিকে দেখা দেয় উর্বরতার মহাদেবী: —মহামাতা, যে জীবন দেয়, জীবন হরণ করে, আবার পুনর্জীবন দেয়। ব্যাবিলোনিয়ায় তার নাম ইশতার, সেমেটীয় অঞ্চলে আসতারতে, গ্রিকদের সে রিঅ্যা, মিশরীয়দের আইসিস। এ-সময়ে নারীপুরুষের যৌনসম্পর্কের কয়েকটি রূপ দেখা দেয়, উন্মেষ ঘটে পরিবারের আদিরূপটির। পরিবারের আদি রূপটি হচ্ছে একরক্তসম্পর্কের পরিবার। একরক্ত পরিবারে বিয়ে হতো প্ৰজন্মক্রমে : পিতামহ ও পিতামহী পরস্পরের ভাইবোন ও স্বামীস্ত্রী, তাদের পুত্রকন্যারা একে-অন্যের ভাইবোন ও স্বামীস্ত্রী, তাদের পুত্রকন্যারা ভাইবোন ও স্বামীস্ত্রী। ক্রমে নিষিদ্ধ হয় একরক্তসম্পর্কিতদের মধ্যে বিয়ে, উদ্ভূত হয় এমন একধরনের পরিবার, মর্গান ও এঙ্গেলস যাকে বলেছেন ‘পুনালুয়া পরিবার’। পুনালুয়া পরিবারে আপনি বা সমান্তরবর্তী কজন বোন হতো তাদের সাধারণ স্বামীদের সাধারণ স্ত্রী, বাদ পড়তো তাদের ভাইয়েরা। এ-পরিবারে স্বামীরা পরস্পরের ভাই হতো না, তারা হতো একে-অন্যের ঘনিষ্ঠ সাথী বা পুনালুয়া। ঠিক একইভাবে একদল আপনি বা সমান্তরবর্তী ভাইয়েরা মিলিতভাবে বিয়ে করতো একদল নারীকে, এবং স্ত্রীরা হতো একে-অন্যের সাখী। এটা ছিলো সমষ্টি বিয়ে, যা থেকে উৎপত্তি হয়েছিলো গোত্রের।
সমষ্টি বিয়ের পরিবারে বাপের ঠিক ছিলো না, কিন্তু মা ছিলো সুনিশ্চিত। সমষ্টি মায়েররা পরিবারের সব সন্তানকেই নিজের সন্তান মনে করতো, তবে নিজের পেটের সন্তানদের চিনতো পৃথক করে। সমষ্টি বিয়েতে শুধু মায়ের দিক থেকেই সম্ভব ছিলো বংশপরম্পরা ঠিক করা; তাই তাতে স্বীকৃতি পেতো শুধু মাতৃধারা। সমষ্টি বিয়ের কালে বা তারও আগে কিছু সময়ের জন্যে দেখা দিয়েছিলো জোড়বাধা পরিবার, যাতে বহু স্ত্রীর মধ্যে একটি পুরুষের থাকতো একটি মুখ্য স্ত্রী। আবার ওই পুরুষটি হতো ওই নারীর বহু পতির মধ্যে মুখ্য পতি। মহাভারতে বিয়ের প্রচলন সম্পর্কে একটি কাহিনী রয়েছে। শ্বেতকেতু তার পিতা উদালক ও মায়ের সাথে বসে ছিলো; এমন সময় এক ব্ৰাহ্মণ এসে শ্বেতকেতুর মাকে নিয়ে যায়। শ্বেতকেতু এর কারণ জানতে চাইলে তার পিতা তাকে জানায় যে তার মায়ের ওপর তার একান্ত অধিকার নেই; যে-কেউ তার মাকে নিয়ে ভোগ করতে পারে। এ-উপাখ্যান নির্দেশ করে সম্ভবত জোড়বাধা পরিবার। এর আগে পুরুষের জন্যে নারীর অভাব ঘটতো না, কারণ তখনো রক্তসম্পর্কিতদের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ হয় নি, তাই প্রচুর নারী পাওয়া যেতো বিয়ের জন্যে; কিন্তু এখন নারী দুষ্পপ্ৰাপ্য হয়ে ওঠে। নারীর অভাবে জোড়বাধা বিয়ের সাথেসাথে শুরু হয় নারীহরণ ও নারীকেনা। জোড়বাঁধা বিয়ে ছিলো অস্থায়ী ও দুর্বল; তাই এর ফলে আগের সাম্যতন্ত্রী গৃহস্থালি ভেঙে যায় নি। সমষ্টি বিয়ের সাম্যতন্ত্রী পরিবারে ছিলো নারীদের আধিপত্য; কেননা তখন জনককে নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হতো না, তাই মা-ই ছিলো স্বীকৃত, পিতা তখনো স্বীকৃতি পায় নি। সমাজের সূচনাকালে নারীরা পুরুষের দাসী ছিলো না; আরণ্য ও বর্বর নারীরা ছিলো স্বাধীন ও সম্মানিত। সাম্যতন্ত্রী পরিবারে নারীরা বা বেশির ভাগ নারী হতো একই গোত্রের, পুরুষেবা বিভিন্ন গোত্রের; তাই আদিম যুগে ছিলো নারীর আধিপত্য। নারীরা তখন বিচ্ছিন্ন ছিলো না। শ্রম থেকে, শ্রমই তাদের সত্যিকার মর্যাদার আসনে বসাতো; তারা আধুনিক সুবিধাভোগী শ্রেণীর শ্রমবিচ্ছিন্ন নারীদের মতো আসার আরাম আর মর্যাদা ভোগ করতো না।
সমষ্টি বিয়েতে এক নারীর ছিলো বহু পতি, পরে তা একপতিতে সমাপ্তি পায়। পাতিব্ৰত্য এখন গুণ, কিন্তু একপতিতে সীমাবদ্ধ হওয়ার প্রথম দিকে পাতিব্ৰত্য হয়ে ওঠে নারীর অপরাধ; আর এ-অপরাধের জন্যে প্ৰায়শ্চিত্তও করতে হয় নারীদের। এটা নেয় নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে আত্মদানের রূপ, নারীদের বিশেষ সময়ের জন্যে স্বামী ছাড়া অন্যদের দান করতে হয় দেহ। ব্যাবিলনের নারীদের বছরে একবার দেহদান করতে হতো মিলিট্টার মন্দিরে, মধ্যপ্রাচ্যের নানা উপজাতির মেয়েদের কয়েক বছর দেহদানের জন্যে পাঠানো হতো আনাইটিসের মন্দিরে। পরে প্রাঃশ্চিত্তমূলক দেহদানের সময় কমানো হয়। বাখোফেন বলেছেন : বৎসরে একবার করে আত্মদানের বদলে মাত্র একবার আত্মদান চালু হয়, বিবাহিতা স্ত্রীলোকের হেটায়ারিজমের (গণিকাবৃত্তি) জায়গায় দেখা দেয় কুমারীদের হেটায়ারিজম, বিবাহিত অবস্থায় তার আচরণের বদলে বিবাহের পূর্বে আচরণ, সকলের কাছে নির্বিচারে আত্মদানের বদলে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির কাছে আত্মদান’ [দ্র এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২০৮)]। ভূমধ্যসাগর থেকে গঙ্গার কূল পর্যন্ত ধর্মের আবরণে, এবং কোনো কোনো জাতির মধ্যে ধর্মের আবরণ ছাড়াই চলে এ-প্রথা। পুরোনো দিনের থ্রেসিয়ান, কেল্টিক, ভারতের বহু আদিম অধিবাসী, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ ও আমেরিকার অনেক আদিবাসীদের মধ্যে মেয়েরা বিয়ের আগে ভোগ করতো প্রচুর যৌনস্বাধীনতা। কোনো কোনো জাতির মধ্যে বরের বন্ধু বা আত্মীয়রা বা বরযাত্রীরা বিয়ের রাতেই কনের দেহের ওপর খাটাতো নিজেদের সনাতন অধিকার, সবশেষে আসতো বরের পালা। পুরাকালে এর চল ছিলো বেলিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জে, ও আফ্রিকার অগিলাদের মধ্যে। কোনো কোনো জাতির মধ্যে কনের ওপর ‘প্রথম রাত্রির অধিকার’ উপভোগ করতো গোত্রপ্রধান, কাসিক, শামান, পুরোহিত, রাজপুত্র ইত্যাদি বরেণ্যরা। বাঙলায়ও একসময় ছিলো। এ-প্ৰথা, যার নাম গুরুপ্রসাদী; এতে গুরু বা পুরোহিত মোচন করতো বধুর কৌমাৰ্য। গুরুর প্রসাদগ্ৰহণ সম্পন্ন হওয়ার পর বরের ভাগ্যে জুটতো নববধুর দেহপ্রসাদ।