নারীবাদীদেরও অনেকে দ্বিধাভরে মেনে নিয়েছেন একথা; যেমন দ্য বোভোয়ার দ্বিতীয় লিঙ্গ-এ নারীর অশক্তির, মনুষ্যপ্ৰজাতির শিকার হওয়ার, দিয়েছেন বিশদ বিবরণ; কিন্তু কেইট মিলেট (১৯৬৯, ১০৯) এটা মেনে নেন নি। মিলেটের মতে সামাজিক রাজনীতিক সংস্থা দেহবল ভিত্তি ক’রে গ’ড়ে ওঠে না, গ’ড়ে ওঠে সমাজের মূল্যবোধ ও উৎপাদন পদ্ধতি ভিত্তি করে। পিতৃতন্ত্র একটি সংস্থা; মানুষের বিকাশের বিশেষ সময়ে এর উদ্ভব ঘটে, উদ্ভবের পেছনে রয়েছে বিশেষ পরিস্থিতি। তার উদ্ভবের প্রক্রিয়া আজ পুরোপুরি জানা না গেলেও সে-সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব। অনেকেই মনে করেন পিতৃতন্ত্রের আগে ছিলো অন্য কোনো তন্ত্র। ম্যাথিয়াস ও ম্যাথিলডা ভ্যারটুং [আধিপত্যশীল লিঙ্গ, ১৯২৩] মনে করেন পিতৃতন্ত্রের আগে ছিলো মাতৃতন্ত্র বা নারীতন্ত্র, যেখানে নারীরাই ছিলো আধিপত্যশীল, যেমন পিতৃতন্ত্রে আধিপত্যশীল পুরুষেরা; আর বাখোফেন [মাতৃ-অধিকার, ১৮৬১], ম্যাকলেনন [আদিম বিবাহ, ১৮৭৫l, মর্গান [আদিম সমাজ, ১৮৭৭), ব্ৰিফল্ট [মাতারা, ১৯২৭) মনে করেন পিতৃতন্ত্রের আগে ঠিক মাতৃতন্ত্র না থাকলেও তার মতোই কিছু একটা ছিলো। সেখানে হয়তো সামাজিক আর ধর্মীয় এলাকায় প্রধান মূল্য পেতো মাতৃ-অধিকার, বা নারীনীতি, বা নারীর উর্বরতা। পিতৃতন্ত্রবাদীরা এটা মানতে রাজি নন; তাঁরা মনে করেন বর্তমান ও ঐতিহাসিক কালটি সম্পূর্ণরূপে পিতৃতন্ত্রের; শুধু তাই নয়, তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস প্রাগৈতিহাসিক কালটিও পিতৃতন্ত্রের, এবং বিপুল ভবিষ্যৎও থাকবে পুরুষতন্ত্রের অধিকারে। নারীবাদীরা অস্বীকার করেন দাবি; তাঁরা মনে করেন না যে পিতৃতন্ত্র অনাদি ও শাশ্বত; তাঁদের মতে পিতৃতন্ত্রের আগামী বিপুল ভবিষ্যৎ জুড়ে টিকে থাকার কোনো জৈবিক সামাজিক কারণ বা প্রয়োজন নেই। আজ যা আছে, তাকে সনাতন শাশ্বত ভাবা হাস্যকর।
পিতৃতন্ত্র মানুষের ইতিহাসের একটি পর্বমাত্র; তাই তার সমাপ্তি ঘটে শুরু হতে পারে নরনারীর সম্পর্কের আরেক, ও উন্নত, পর্ব। জন স্টুয়ার্ট মিল উদার মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে লিখেছিলেন নারী-অধীনতা (১৮৬৯) নামে একটি প্রভাবশালী বই। স্টুয়ার্ট মিল ধ’রে নিয়েছিলেন নারীজাতির অধীনতা ঘটেছে পুরুষের বলপ্রয়োগের বিশ্বজনীন নীতিতে, তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে নারীজাতির অধীনতা দূর হবে প্রগতি ও নৈতিকতার ক্রমাগ্রগতির ফলে। তাঁর বিশ্বাস ছিলো মানুষের প্রগতি ও নৈতিকতার অগ্রগতি অবধারিত, কেননা মানুষ আর পেছনের দিকে যেতে পারে না। এঙ্গেলস মানুষের ওপর পোষণ করতে পারেন নি এতোটা আস্থা। মিলের মতো তিনি এমন আশাবাদ পুষতে পারেন নি যে মানবসমাজ প্রগতিশীল থেকে প্রগতিশীলতর হবেই, কেননা প্ৰগতিশীল আদিম সাম্যবাদের পর প্রতিক্রিয়াশীল দাসপ্রথার আবির্ভাব তিনি দেখেছেন। বিপ্লবী ছিলেন তিনি; তাই তার পক্ষে কোনো সংস্থার জৈবিক উদ্ভবতত্ত্বে বিশ্বাস করাও ছিলো অসম্ভব। তাঁর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে সংস্থামাত্রেই মানুষের তৈরি। তাই বদলে দেয়া যেতে পারে যে-কোনো সংস্থাকে, এমনকি দরকার হ’লে তাকে হঠাৎ প্ৰচণ্ড বিপ্লবাত্মক প্রক্রিয়ায়ও উচ্ছেদ করা সম্ভব। তিনি দেখেন যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ও সম্পত্তির মধ্যে; সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানা ও নারীর অধীনতার ভিত্তির ওপরই স্থাপিত পিতৃতন্ত্র। তাই পিতৃতন্ত্র ও পরিবার দাঁড়িয়ে আছে শোষণের ওপর; মানুষের একটি লিঙ্গ শোষণ করছে আরেকটি লিঙ্গকে–নারীশোষণের মহত্তম যন্ত্রটির নাম পিতৃতন্ত্র। তিনি অনুরক্ত ছিলেন বাখোফেনের মাতৃ-অধিকার গ্রন্থে প্রস্তাবিত তত্ত্বের প্রতি : মাতৃ-অধিকারে এঙ্গেলস দেখতে পান এক ধরনের আদিম সাম্যবাদ, যেখানে ছিলো না কোনো ব্যক্তিমালিকানা। পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে একরাশ সামাজিক রোগ নিয়ে; দেখা দেয় সম্পত্তির ব্যক্তিগত অধিকার, নারী-অধীনতা ও দাসপ্রথা, সমাজ ভাগ হয়ে যায় নানা শ্রেণী ও বর্ণে, দেখা দেয় শাসক ও সম্পত্তিশীল শ্রেণী, শুরু হয়। সম্পত্তির অসম বণ্টন, এবং শেষে শোষণের নির্মম বিকট যন্ত্ররূপে দেখা দেয় রাষ্ট্র। এঙ্গেলস বাখোফেন ও মর্গানের সাথে নিজের সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বের সমন্বয় ক’রে রচনা করেন সমাজবিবর্তনের এক বিশ্বজনীন ইতিহাস, যাতে তিনি নির্দেশ করেন কীভাবে উদ্ভূত হয় পরিবার, বিভিন্ন সমাজসংস্থা; মানুষ কীভাবে সম্পদ উৎপাদনের জন্যে হাতিয়ার তৈরি করে, কৃষিকাজ শুরু করে, ব্যবসায়ী হয়, এবং শেষে হয় শিল্পপতি। পরিবারের ইতিহাসকে তিনি ভাগ করেন। কয়েকটি স্তরে; দেখান কীভাবে মাতৃতন্ত্র বা মাতৃ-অধিকারের স্তর থেকে নির্বিচার বা মুক্ত যৌনসম্পর্ক, সমষ্টি বিয়ে, জোড়বাধা বিয়ে, একরক্তেরসম্পর্কের বিয়ে, পুনালুয়া বিয়ে প্রভৃতি থেকে উদ্ভূত হয় পিতৃতান্ত্রিক ও একপতিপত্নী বিয়ে (বা একপতিবহুপত্নী বিয়ে), এবং নারী হয়ে ওঠে পুরুষের সম্ভোগসামগ্ৰী ও পরিচারিকা।
মানুষের ইতিহাসের প্রথমে আরণ্যপর্ব, তারপর বর্বরতার পর্ব, এবং তারপর ও এখন সভ্যতার পর্ব। আরণ্যপর্বে মানুষ ছিলো অরণ্যের সন্তান; মানুষ তখন প্রকৃতি থেকে আহরণ করেছে তার অবিলম্বে ব্যবহার্য সম্পদগুলো, যা তাকে বঁচিয়ে রেখেছে। হাতিযার বলতে কিছুই তার ছিলো না, বা ছিলো সে-সব যা তাকে সাহায্য করেছে প্রকৃতি থেকে ফলমূল আহরণে। এ-সময় নারীর অবস্থা কেমন ছিলো, তা নিশ্চিত জানার উপায় নেই। নারীকে নিশ্চয়ই তখন করতে হতো নানা কঠিন কাজ; স্থান থেকে স্থানান্তরে যাওয়ার সময় ভারবহনের ভারটা হয়তো পড়তো তখন নারীরই ওপর, কেননা পুরুষকে নিজের হাত দুটি মুক্ত রাখতে হতো পশুর আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচাতে। অর্থাৎ নারী ভার বইতো, কিন্তু পুরুষ করতো আরো ভয়ঙ্কর কাজ। তবে ওই নারীরা আজকের বুর্জোয়া নারীদের মতো ভঙ্গুর ছিলো না। কিন্তু তারা বাঁধা ছিলো ঋতুস্ৰাব, গৰ্ভধারণ ও প্রসবের জৈব শেকলে, যা তাদের তখনো করে রেখেছিলো বিরূপ বিশ্বে অসহায়। তাই অন্ন ও আশ্রয়ের জন্যে তাদের নির্ভর করতেই হতো মুক্ত পুরুষের ওপর। নারী পুরুষের মতো সৃষ্টি বা উদ্ভাবন করে নি, সে গর্ভবতী হয়েছে ও প্রসব করেছে। গৰ্ভ ও প্রসব কোনো কাজ নয়, তা জৈব ব্যাপার; তাই নারীকে আত্মসমৰ্পণ করতে হয়েছে নিজেরই জৈবনিয়তির কাছে। পুরুষ গেছে ভিন্ন পথে; সে তার জৈব ও পাশব স্বভাব পেরিয়ে হয়ে উঠেছে স্রষ্টা বা উদ্ভাবক। আদিম মানুষ মর্যাদাসম্পন্ন হয়েছে আরেক কারণে, তার পৌরুষ বা বীরত্বের জন্যে। সে বেছে নিয়েছে বিপজ্জনক কাজ: সে শিকার করেছে, ভয়ঙ্কর জন্তুদের সাথে লড়াই ক’রে বিপন্ন করেছে জীবন, এবং পরেছে জয়মাল্য। পুরুষ শোষক, স্বার্থপরায়ণ, পীড়ক, কিন্তু শক্তিমান; আর শক্তির কাছে গৌণ হয়ে যায় অন্য সব কিছু। নারী জীবন সৃষ্টি করে, এটা মানুষকে রেখে দেয় পশুরই স্তরে : পুরুষ জীবন বিপন্ন করে, এটা মানুষকে পশুর পর্যায় থেকে উত্তীৰ্ণ করে মানুষের পর্যায়ে। নারী টিকিয়ে রেখেছে মানুষ প্রজাতিকে, আর পুরুষ বদলে দিয়েছে পৃথিবীকে; নারীর নিয়তি, অন্তত এখন পর্যন্ত, হয়ে রয়েছে জীবনের পুনরাবৃত্তি করা; কিন্তু জীবনের পুনরাবৃত্তি করে কেউ পৃথিবীর প্রভু হতে পারে না। জৈবিক ও আর্থ কারণে পুরুষ হয়েছে পৃথিবী ও নারীর প্রভু। আরণ্যপর্বে নরনারীর যৌনসম্পর্কের রীতি কী ছিলো? এ-পর্বে ছিলো নির্বিচার বা মুক্ত যৌনসম্পর্ক, যে-কোনো নারী মিলিত হতো। যে-কোনো পুরুষের সাথে। এটা মেনে নিতে অনেকের লজ্জা লাগতে পারে; কিন্তু আরণ্য মানুষ আজকের ভণ্ডামো আয়ত্ত করে ওঠে নি। এঙ্গেলস (১৮৮৪, ১৯১১) বলেছেন, ‘যদি কঠোর একপতিপত্নী বিধিই সর্বপ্রধান পুণ্য বলে মনে করা হয় তাহলে টোপওয়ার্মকেই শ্ৰেষ্ঠ মানতে হয়, কারণ তার পঞ্চাশ থেকে দু’শ খণ্ডে বিভক্ত শরীরের প্রত্যেকটি খণ্ডে একজোড়া পুরুষ ও স্ত্রী অঙ্গ আছে এবং সারা জীবন ধরে এই কৃমিকীট শরীরের প্ৰত্যেকটি খণ্ডে আত্মসঙ্গম করে কাটায়।‘ আরণ্য নরনারী টেপাওয়ার্ম ছিলো না; এবং ছিলো না তার উত্তরাধিকারীর মতো ভণ্ড।