মা নয় শিশুর মাতা, যাকে তার বলা হয়।
সে সেবিকামাত্র, তার কাজ তার ভেতবে বপন করা
শিশুর প্রকৃত জন্মদাতা পুরুষের বীজ লালনপালন।
যদি দেবতার বরে বেঁচে থাকে শিশু,
সে তাকে পালন কবে, যেমন সখার জন্যে
কেউ দেখাশোনা কবে বেড়ে-ওঠা চারা…
মা ছাড়াও পিতা পারে জন্ম দিতে।
পুরুষের প্রাধান্য রাখার জন্যে পিতৃতন্ত্র সব পারে ; জন্মের স্বাভাবিক রীতিকেও উল্টে দিতে পারে। অ্যাপোলো এর উদাহরণও হাজির করেছে; নিয়ে এসেছে অ্যাথেনাকে, যে সম্পূর্ণ যুবতীরূপে জন্ম নিয়েছিলো পিতা জিউসের শির থেকে। সে এসেই ঘোষণা করে পিতৃতন্ত্রের জয় : ‘কোনো মাতা জন্ম দেয় নি আমাকে। তাই পিতার দাবি ও পুরুষাধিপত্যকে আমি শিরোধাৰ্য করি।‘ পুরুষতন্ত্রের একটি চমৎকার কৌশল হচ্ছে নারীর মুখে পুরুষের জয় ঘোষণা ও নারীনিন্দা করা। মহাভারত-এর নারীনিন্দার আধিকাংশ শ্লোক বলা হয়েছে নারীরই মুখে। পুরুষতন্ত্রে পুরুষই দেবতা; সে সব পারে, একলা নিজেই জন্ম দিতে পারে, দেবীকে পরিণত করতে পারে দাসীতে; মাকে শেখাতে পারে নীতিশাস্ত্র। বাঙলায় সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনো বিশ্বাস রয়েছে যে নারী ঘট মাত্র; পুরুষের বীজেই ওই ঘট ভরে ওঠে। পুরুষ যখন নারীকে দেবী ব’লে, ভূমি ব’লে, মা ব’লে, তখনো তার মহিমা অস্বীকার করে।
নারীর দেবীরূপের একটি হচ্ছে বধু, যে পরম কাম্য শিকার পুরুষের। নববধূকে আলিঙ্গনে জড়িয়ে পুরুষ লাভ করে জীবন্র সমস্ত ধন। তার টাটকা শরীরের ছোঁয়ায় পুরুষের শরীরে ও মনে জাগে কবিতা, বাজে সঙ্গীতের সুর, সে ঢেকে যায় নিসর্গের বর্ণিল শোভায়। পুরুষের কাছে সে তখন কপোত ময়না কোকিল, গোলাপ পদ্ম রজনীগন্ধা, অমৃত, সন্ধ্যার মেঘমালা, হীরেচুনিপান্না, বসন্তের বাতাস, নীলিমা, সমুদ্র। কবিরা এ-দেবীর স্তব করেছেন উৎকৃষ্টতম শব্দের উৎকৃষ্টতম বিন্যাসে। বধু দেবী, কেননা সে পুরুষের রঙিন কামের রক্তিমতম পরিতৃপ্তি। কবি গেয়ে ওঠেন, ‘ওগো বধু সুন্দরী, তুমি মধুমঞ্জরী, পুলকিত চম্পার লহো অভিনন্দন–/পর্ণের পাত্রে ফাল্গুনরাত্রে মুকুলিত মল্লিকামাল্যের বন্ধন।/এনেছি বসন্তের অঞ্জলি গন্ধের; পলাশের কুঙ্কুম চাঁদিনির চন্দন–/পারুলের হিল্লোল, শিরীষের হিন্দোল, মঞ্জল বল্লীর বঙ্কিম কঙ্কণ’ [রবীন্দ্রনাথ]; আর এর সুরে ও ছবিতে প্রবলভাবে বয়ে চলে পুরুষের কামের প্রবাহ। দেবীকে ঘিরে আবর্তিত হয় পুরুষের থরোথরো কামনা। কামই ঘিরে থাকে দেবীকে বুদ্ধদেব বসু যখন বলেন, ‘যাও, মেয়ে জীবনের খাদ্য হও’; বা বিষ্ণু দে বলেন, ‘তুমি যেন এক পর্দায় ঢাকা বাড়ি, / আমি অঘ্রাণ-শিশিরে সিক্ত হাওয়া, /বিনিদ্র তাই দিনরাত ঘুরি ঘিরে’ ; বা ‘শলোমনের পরমগীত’-এর দয়িত বলে :
অয়ি মম প্ৰিয়ে! দেখ, তুমি সুন্দরী,
দেখ, তুমি সুন্দরী,
ঘোমটার মধ্যে তোমার নয়নযুগল কপোতের ন্যায়;
তোমার কেশপাশ এমন ছাগপালের ন্যায়,
যাহাবা গিলিয়দ-পৰ্ব্বতের পার্শ্বে শুইয়া থাকে।
তোমার দন্তশ্রেণী ছিন্নলোমা মেষীর পালবৎ,
যাহারা স্নান করিয়া উঠিয়া আসিয়াছে,…
তোমার ওষ্ঠাধর সিন্দুরবর্ণ সূত্রের ন্যায়,
তোমার গণ্ডদেশ দাড়িম্বখণ্ডের ন্যায়।…
তোমার কুচযুগল দুই হরিণ-শাবকের,
হরিণীব দুই যমজ বৎসের ন্যায়…
তোমার প্রেম দ্রাক্ষারস হইতে কত উৎকৃষ্ট!
তোমার তৈলের সৌরভ সমস্ত সুগন্ধি দ্রব্য অপেক্ষা কত উৎকৃষ্ট।
কান্তে! তোমার ওষ্ঠাধর হইতে ফোটা ফোটা মধু ক্ষরে,
তোমার জিহ্বার তলে মধু ও দুগ্ধ আছে;
মম ভগিনি, মম কান্তা অর্গলবদ্ধ উপবন,
অৰ্গলবদ্ধ জলাকর, মুদ্রাঙ্কিত উৎস।…
তোমার গোলাকার উরুদ্বয় স্বর্ণহারস্বরূপ।
নিপুণ শিল্পীর হস্তনির্মিত স্বর্ণহারস্বরূপ।
তোমার দেহ এমন গোল বাটির ন্যায়,
যাহাতে মিশ্ৰিত দ্রাক্ষারসের অভাব নাই।
তোমার কটিদেশ এমন গোধূমরাশির ন্যায়,
যাহা শোশন-পুষ্পশ্রেণীতে শোভিত।….
তোমার কুচযুগ দ্রাক্ষাগুচ্ছম্বরূপ।
বধুর এ-অসামান্য রূপ শুধু যৌবনের, যখন সে প্রেমিক; যখন সে গাৰ্হস্থ্য স্ত্রী হয়ে ওঠে নি। স্ত্রী হয়ে ওঠার পরও কখনো কখনো তাকে দেবী ক’রে তোলে পুরুষ, সন্তানের জননী গৃহলক্ষ্মীরূপে; কিন্তু সে নিজে তখন দেবতা। দেবতাই প্ৰভু, গৃহের দেবী তার পরিচারিকামাত্র।
কোনো কোনো ধর্মে নারীকে তার রক্তমাংস থেকে উত্তীর্ণ ক’রে অতীন্দ্ৰিয় ক’রে তোলা হয়। যেমন খ্রিস্টধর্মে, বা সুফিদের সাধনায়, কিছুটা হিন্দুধর্মে। ইসলামে নারীকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে সমস্ত অতীন্দ্ৰিয়তা ও রহস্য থেকে, মুসলমানের কোনো দেবী নেই; মুসলমানের কাছে নারী সম্ভোগের সামগ্ৰী:–পৃথিবীতে এবং ইন্দ্ৰিয়ভারাতুর বেহেশতে। খ্রিস্টানরা নারীকে মনে করে পরিবার ও গৃহের আত্মা। প্রায় সমস্ত ভাষায়ই দেশ, নগর, নদী প্রভৃতি নারী; নানা বিমূর্ত ভাবনাও নারী। সাহিত্যে নারীই বারবার ব্যবহৃত হয়েছে রূপকরূপে; কারণ নারী হচ্ছে ভাব ও আত্মা। খ্রিস্টানের কাছে নারী স্বর্গের সৌন্দর্য, যে তাকে ঈশ্বরের দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়, যেমন ‘ডিভাইন কমেডি’তে দান্তেকে পথ দেখায় বিয়াত্রিসে। অনেক তত্ত্বে নারী হচ্ছে সুষমা, যুক্তি, সত্য। বিহারীলাল, হিন্দুধর্মের প্রভাবেই, বিশ্বসৌন্দর্যের সারসত্তাকে দেখেছেন নারীরূপে, সারদারূপে, এবং তাকে গৃহে দেখতে পেয়েছেন স্ত্রীরূপে। রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতাও অনেক সময় নারী। নারী যখন ভাব, রূপক, প্রতীক, তখন সে আর মাংস নয়; সে তখন অলৌকিক সত্তা। নারী তখন, যেমন জীবনানন্দের কাছে, অনন্ত নক্ষত্ৰবীথি অন্ধকারে জ্বলে যার পবিত্র শিখা। তখন সে কারো সম্পত্তি নয়, সম্ভোগসামগ্ৰী নয়, তখন সে আরাধ্য। তখন সে অতীন্দ্ৰিয়, বায়বীয়; তখন অশুভ রূপান্তরিত হয়। শুভ ও শুদ্ধতায়। তবে এ-নারী বাস্তব নারী নয়; তাকে নিয়ে বাস করে না পুরুষ; নারীর অতীন্দ্ৰিয় মূর্তি রচনা প্ৰকাশ করে পুরুষেরই প্রতিভা, তাতে নারীর অবস্থার কোনোই উন্নতি ঘটে না।
নারীজাতির ঐতিহাসিক মহাপরাজয়
দ্য বোভোয়ার বলেছেন নারী মনুষ্যপ্ৰজাতির শিকার; পুরুষ তার শরীরকে অতিক্রম ক’রে গেছে, কিন্তু নারী পশুর মতো, শুধু জন্ম দেয়াই যার একান্ত ধর্ম, বন্দী হয়ে রয়েছে নিজের শরীরের শেকলে। নারী পরাভূত হয়েছে : মনুষ্যপ্ৰজাতির পরাজিত লিঙ্গের নাম নারী। নারী তার শরীরমনে বয়ে চলছে। ওই পরাজয়; বিজয়ী পুরুষকে অভিবাদন জানিয়ে, তার সামনে নত থেকে, শুরু ও শেষ হয় তার জীবন। নারী পরাজিত হয় পুরুষের কাছে, নারী তন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটে। পিতৃ-বা পুরুষ-তন্ত্রের রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে। নারীর পরাজয়ের তত্ত্ব রচনা করেছেন অনেকে : চেরানিশেভঙ্কি [কী করণীয়?] মিল [নারী-অধীনতা], বেবেল [নারী ও সমাজতন্ত্ৰ], ভেবলেন [সুবিধাভোগী শ্রেণীর তত্ত্ব] প্রমুখ, তবে এঙ্গেলস লেখেন সবচেয়ে বিপ্লবাত্মক রচনাটি, যার নাম ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ (১৮৮৪)। এঙ্গেলস এটি লিখেছিলেন হেনরি মর্গানের ‘আদিম সমাজ’ (১৮৭৭) ও বাখোফেনের ‘মাতৃ-অধিকার’ (১৮৬১) অবলম্বনে, কিন্তু তিনি এতে পেশ করেন পিতৃতন্ত্রের ইতিহাস ও অর্থনীতির এক সংহত বিবরণ; এবং একমাত্র তিনিই আক্রমণ করেন পিতৃতন্ত্রের বহুনন্দিত একটি সংস্থাকে, যাকে বলা হয় পরিবার। পিতৃতন্ত্রবাদীরা বিশ্বাস করেন পিতৃতন্ত্র ও পরিবারসংস্থা মানুষের সমাজসংস্থাগুলোর মধ্যে অনাদি; তাঁরা মনে করেন এগুলোর উদ্ভব ঘটেছিলো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় পুরুষের জৈবিক শক্তি ও সহজাত প্রাধান্য ভিত্তি করে। যেনো এটিই বিধির স্বর্গীয় বিধান। তাঁরা মনে করেন দেহই নারীর নিয়তি; তার শারীরিক অশক্তি, ঋতুস্রাব, গর্ভ ও প্রসব তাকে বাধ্য করে পরাজিত লিঙ্গে পরিণত হ’তে।