কামিনীগণ জলৌকার মতো সতত পুরুষের রক্ত পান ক’রে থাকে, মূর্খেরা তা বুঝতে পারে না; কেননা তারা নারীদের হাবভাবে মোহিত হয়ে পড়ে। পুরুষ যাকে কান্ত মনে করে, সে-কান্তা সুখসম্ভোগ দিয়ে বীর্য, এবং কুটিল প্রেমালাপে মন ও ধন সবই হরণ করে। তাই নারীর মতো চোর আর কে আছে? রমণীরা কখনো সুখের নয়, তারা শুধু দুঃখেরই কারণ।
আরেকজন বলেছেন, ‘রমণীরা যে-পর্যন্ত কোনো নির্জন স্থান না পায় এবং কোনো পুরুষের সাথে বিশেষ আলাপ করতে না পারে, সে-পর্যন্ত স্ত্রীলোকের সতীত্ব থাকে‘ [শিবপুরাণ, ধর্মসংহিতা : ৪৪]। এ-ঋষিদের একজনের পুনর্জন্ম নেন বঙ্কিমচন্দ্ৰ চট্টোপাধ্যায় নামে; তিনি সৃষ্টি করেন একটি দানবী–রোহিণী। উপপ্রেমিকাতুর রোহিণীর মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন বঙ্কিম [কৃষ্ণকান্তের উইল : ৭] এভাবে :
রোহিণী দেখিয়াছিল যে, নিশাকর রূপবান–পটলচেরা চোখ।…ভাবিয়াছিল, নারী হইয়া জেয় পুরুষ দেখিলে কোন্ নারী না তাহাকে জয় করিতে কামনা করিবে? বাঘ গোরু মারে,–সকল গোরু খায় না। স্ত্রীলোক পুরুষকে জয় করে–কেবল জয়পতাকা উড়াইবার জন্য।
ঋষিরা পরিমাপও করেছেন দানবীর দুঃশীলতা; নির্দেশ করেছেন দুঃশীলতার ওজন। ঋষিদের পরিমাপে নারী [মহাভারত, অনুশাসনপর্ব : ৩৮] :
তুলাদণ্ডেব একদিকে যম, বায়ু, মৃত্যু, পাতাল, বাড়বানল, ক্ষুরধার, বিষ, সৰ্প, ও বহ্নি এবং অপরদিকে স্ত্রীজাতিকে সংস্থাপন করলে স্ত্রীজাতি কখনোই ভয়ানকত্বে ওগুলোব থেকে ন্যূন হবে না। বিধাতা যখন সৃষ্টিকার্যে প্রবৃত্ত হয়ে মহাভূত সমুদয় ও স্ত্রী-পুরুষের সৃষ্টি করেন, সে-সময়ই স্ত্রীদের দোষের সৃষ্টি করেছেন।
শুধু একবার ওজন করেন নি, করেছেন বারবার, দেখেছেন পরিমাপে তাঁরা নির্ভুল : ‘ইহলোকে স্ত্রীলোকের থেকে পাপশীল পদাৰ্থ আর কিছু নেই। প্ৰজ্বলিত অগ্নি, ময়দানবের মায়া, ক্ষুরধার, বিষ, সৰ্প ও মৃত্যু এর সবগুলোর সাথে তাদের তুলনা করা যায়'[ওই : ৪০; দ্র রবীন্দ্রনাথ (১২৯৪), অশোক (১৯৮৩, ৯১-১০৩), অনন্যা (১৩৯৪, ৩৬-৩৭)]। পদ্মপুরাণ-এ বলা হয়েছে :
ঘূতকুম্ভসম নারী তৃপ্তাঙ্গারসমাঃ পুমান।
তস্মাদ্ঘৃতঞ্চ বহ্নিঞ্চ নৈকস্থানে চ ধারয়েৎ।।
যথৈব মত্ত মাতঙ্গ সৃণিমুদগর যোগতঃ।
স্ববশং কুরুতে যন্তা তথা স্ত্রীণাং প্ররক্ষকঃ।।
নারী ঘৃতকুম্ভসম, পুরুষ তপ্ত অঙ্গারাসমান;
তাই ঘৃত ও অগ্নিকে একস্থানে রাখা উচিত নয়।
মাহুত যেমন মুগুর দিয়ে মত্ত হস্তীকে বশ করে,
তেমনি বশ করতে হবে নারীকে।
ব্ৰহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এ আছে, ‘দুনিবাৰ্যশ্চ সৰ্বেষাং স্ত্রীস্বভাবশাচ চাপলঃ’, অর্থাৎ “স্ত্রীস্বভাব এতো চঞ্চল যে কারো পক্ষে সহজে নিবারণ করা অসম্ভব।’ এ-পুরাণপ্ৰণেতা আরো বলেছেন, ‘নারী মোক্ষদ্বারের করাট, হরিভক্তির বিরোধী। সংসারবন্ধনস্তম্ভের রজ্জ্ব, যা ছিন্ন করা যায় না। নারী বৈরাগ্যনাশের বীজ, সর্বদা অনুরাগবর্ধনকারিণী, সাহসের ভিত্তি ও দোষের গৃহ। নারী অবিশ্বাসের ক্ষেত্র, মূর্তিমতী কপটতা; অহঙ্কারের আশ্রয়, নারীর মুখে মধু ও অন্তরে বিষ।‘ পঞ্চতন্ত্র-এ বিষ্ণুশৰ্মা হিতোপদেশ দিয়েছেন : ‘নারীর মুখে মধু, অন্তরে শুধুই বিষ; তাই এদের মুখ পান করবে। কিন্তু হৃদয় মুষ্টাঘাতে আহত করবে।‘ এমন দানবী কি ঈশ্বর সৃষ্টি করতে পারেন? এক ঋষি প্রশ্ন করেছেন : ‘বিষ ও অমৃতযুক্ত স্ত্রীরূপ যন্ত্র ধর্মনাশের জন্যে কার দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে?’ আরেক ঋষি বিধান দিয়েছেন, ‘নাৰ্য শ্মশানঘটিকা ইব বর্জনীয়াঃ’ : ‘নারী শ্মশানের ঘটিকার মতো বর্জনীয়’ ( দ্র নারায়ণ (১৩৭৪, ৫৩-৫৪)]। নজরুল দোলন-চাঁপার ‘পূজারিণী’ কবিতায় চিৎকার করে বলেছেন, ‘নারী নাহি হতে চায় শুধু একা কারো, / এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো। /ইহাদের অতিলোভী মন/একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়, যাচে বহু জন।‘ প্রাচীন ভারতীয় ঋষিদের গলা স্পষ্ট শোনা যায় এ-বিদ্বেষ ও হাহাকারে।
কিন্তু নারীকে পুরুষ বর্জন করতে পারে নি, দানবীকে সে প্রয়োজনে, কামে ও আবেগে কখনো কখনো দেবী ক’রে তুলেছে। বন্দনা করেছে তার দেবীরূপের-মাতা, স্ত্রী ও দয়িতার। তবে দেবীরূপে নারী পুরুষের অধীন, সামান্য ও অসহায়; তাই দেবী অনেক স্বস্তিকর, পুরুষের প্রিয় পুতুল। পুরুষ যখন নারীকে দেবীরূপেও কল্পনা করে, তখন তার ওপরে থাকে পুরুষ ও পুরুষ দেবতারা; দেবীকে ক’রে তোলে তারা বাহ্যিক শোভাময়, এবং অন্তঃসারশূন্য। হিন্দু পুরাণে চণ্ডী বা দুৰ্গা মহাশক্তি, কিন্তু তার শক্তিও তার নিজের নয়; পুরুষ দেবতাদের কৃপায় সে শক্তিময়ী : ‘শিবের তেজে দেবীর মুখ, যমের তেজে কেশ, বিষ্ণুর তেজে বাহুসমূহ, চন্দ্ৰতেজে স্তনদ্বয়, ইন্দ্রের তেজে মধ্যভাগ, বরুণের তেজে জংঘা ও উরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্ৰহ্মার তেজে পদযুগল…। মহাদেব দিলেন শূল, কৃষ্ণ দিলেন চক্র, শঙ্খ দিলেন বরুণ, অগ্নি দিলেন শক্তি…’ [দ্র হংসনারায়ণ (১৯৮০, ১৭৫)]। আদমের বক্র হাড় থেকে যেমন সৃষ্টি করা হয়েছে হাওয়াকে, তেমনি পুরুষ দেবতাদের শক্তির সংকলন হচ্ছে এ-দেবী, যার নিজস্ব অস্তিত্বই নেই।
পুরুষতন্ত্র বহু শতাব্দী ধ’রে নারীকে ভূমি আর ভূমিকে নারীরূপে দেখে আসছে; পৃথিবীকে মাতৃদেবীরূপে পুজোও করছে; কিন্তু তার শক্তিকে করছে অস্বীকার। এস্কিলুস, আরিস্ততল, হিপপোক্রেতিস ঘোষণা করেছেন অলিম্পাস থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সবখানে প্রধান পুরুষ; পুরুষই সৃষ্টিশীল, নারী নয়। নারী ভূমি, নারী উর্বর; তবে ওই উর্বরতা সৃষ্টিশীল নয়, তাকে সৃষ্টিশীল করে পুরুষের বীর্য। নারী মৃত্তিকা, পুরুষ বীজ; পুরুষ অগ্নি, নারী জল। মনু বলেছেন, ‘নারী জাতি ক্ষেত্রস্বরূপ এবং পুরুষ বীজস্বরূপ; ক্ষেত্র ও বীজের সংযোগেই সমস্ত প্রাণীর উদ্ভব হয়ে থাকে’ [৯:৩৩]; তিনি আরো বলেছেন, ঠিক সময়ে কৰ্ষিত ক্ষেত্রে যেমন বীজ বপন করা হয়, ক্ষেত্রে সে-বীজগুণসম্পন্ন অঙ্কুরই উদগত হয়ে থাকে’ [৯:৩৬]। কোরানে আছে : ‘তোমাদের স্ত্রী তোমাদের শস্যক্ষেত্র। তাই তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভারে ইচ্ছে যেতে পারো’ [২:২২৩]। পুরুষ নারীকে দরকারে দেবী করেছে, ধরণী করেছে; কিন্তু তাকে ক’রে রেখেছে অসার। প্রজননে নারীর ভূমিকাকে অস্বীকার করে তাকে পরিণত করেছে একটি অক্রিয় বীজধারণের পাত্রে। পিতৃতন্ত্র পুরুষের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্যে বীজকেই দিয়েছে গুরুত্ব। হিন্দু পুরাণে দেখা যায় দেবতা ও ঋষিরা যেখানেসেখানে বীর্যপাত করছে, জন্ম দিচ্ছে অজস্র সন্তান; অর্থাৎ তারা নারীর জরায়ুকে প্রত্যাখ্যান ক’রে নারীকে তার একান্ত অধিকার থেকেও বহিষ্কার করেছে। পিতৃতন্ত্রের নারীর জরায়ুকে অস্বীকারের প্রায় রাজনীতিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এস্কিলুসের অরেসতেইয়া নাটকে। অ্যাপোলো পেশ করে জন্মদানের পিতৃতান্ত্রিক ভাষ্য :