এ-বই প্রকাশের পর হৈচৈ পড়ে যায়, রক্ষশীলেরা একটি ভালো শিকার পেয়ে মেতে ওঠে: অ্যান্থনি ও আর কয়েকজন ছাড়া ভোটাধিকার সংঘের সদস্যরাও স্ট্যান্টনকে অস্বীকার করেন। এর মাত্ৰ ন-বছর পর বাঙলায় এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজের নারী রোকেয়া বলেন, ‘আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্ৰ বলিয়া প্ৰকাশ করিয়াছেন।…এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ-রচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।’
১৮৯৮ শার্লোট পার্কিন্স গিলমানের নারী ও অর্থনীতি।
এমেলিন প্যাংকহাক্টের নেতৃত্ত্বে যুক্তরাজ্যে নারীর সামাজিক ও রাজনীতিক ইউনিয়ন গঠন; নারীমুক্তি আন্দোলনের চরম রূপ। তাদের ঘোষণা : ‘অবিলম্বে ভোটাধিকার’। ১৯০৫-এ আন্দোলনকে তীব্র, ও সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ, করার জন্যে লিবারেল দলের নির্বাচনী জনসভায় প্যাংকহাক্টের মেয়ে ক্রিস্টাবেল ‘তোমরা কি নারীদের ভোটাধিকার দেবো?’ প্লাকার্ড বহন করে, প্রেফতার হওয়ার জন্যে পুলিশের মুখে থুতু দেয়। দেশে সৃষ্টি হয় প্রবল আন্দোলন।
১৯০৪ বেগম রোকেয়ার বিপ্লবী প্ৰবন্ধ ‘আমাদের অবনতি’ [নবনুর, ২:৫]। মতিচুর (১৯০৫) গ্রন্থে ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ নামে সংকলিত। এ-প্রবন্ধেই ভারতে প্রথম ধর্মগ্রন্থের বিরুদ্ধে পেশ করা হয় তীব্র বক্তব্য। রোকেয়া বলেন :
‘যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, আমনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। …আমরা প্রথমতঃ যাহা সহজে মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিবোদ্ধাৰ্য করিয়াছি; আমাদিগকে অন্ধকাবে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্ৰ বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।…এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ-রচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।…এখন আমাদের আর ধর্মের নামে নত মস্তকে নরের অযথা প্ৰভুত্ব সহা উচিত নহে। আরও দেখ, যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ়, সেইখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক।‘
তার বক্তেব্য রক্ষণশীলেরা উন্মত্ত হয়ে ওঠে,–তবে এখনকার মতো নয়, ব্রিটিশরাজে রক্ষণশীলদের উন্মত্ততারও সীমা ছিলো; গ্রন্থে প্রকাশের সময় তিনি আপত্তিকর অংশ বাদ দিতে বাধ্য হন। ওই আপত্তিকর ও নিষিদ্ধ অংশটুকুই হচ্ছে রোকেয়ার শ্রেষ্ঠ রচনা। পৃথিবীর একটি পরিহাস হচ্ছে এখানে শ্রেষ্ঠরা নিয়ন্ত্রিত হন নিকৃষ্টদের দ্বারা।
১৯১১ কলকাতায় ১৬ মার্চে রোকেয়ার সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা।
১৯১৩ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নারীর মূল্য [যমুনা, ১৩২০]৷ বেরিয়েছিলো অনিলা দেবীর ছদ্মনামে। গ্রন্থাকারে বেরোয় ১৯২৪-এ। শরৎচন্দ্ৰ বলেন :
‘নারীত্বে মূল্য কি? অর্থাৎ, কি পবিমাণে তিনি সেবাপরায়ণ, স্নেহশীলা, সতী এবং দুঃখে কষ্টে মৌনা। অৰ্থাৎ তাঁহাকে লইয়া কি পরিমাণে মানুষের সুখ ও সুবিধা ঘটিবে। এবং কি পরিমাণে তিনি রূপসী। অর্থাৎ পুরুষের লালসা ও প্রবৃত্তিকে কতটা পরিমাণে তিনি নিবদ্ধ ও তৃপ্ত রাখিতে পাবিবেন। দাম কৰ্ষিবার এ ছাড়া যে আর কোন পথ নাই, সে কথা আমি পৃথিবীর ইতিহাস খুলিয়া প্রমাণ করিতে পারি।…
সতীত্বের বাড়া নারীর আর গুণ নাই। সব দেশেব পুরুষই এ কথা বোঝে, এটা পুরুষেবা কাছে সবচেয়ে উপাদেয় সামগ্ৰী।…এই সতীত্ব যে নারীর কতবড় ধর্ম হওয়া উচিত, রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণাদিতে সে কথার পুনঃ পুনঃ আলোচনা হইয়া গিয়াছে।…এখানে স্বয়ং ভগবান পর্যন্ত সতীত্বের দাপটে কতবার অস্থির হইয়া গিয়াছেন। কিন্তু সমস্ত তর্কই একতরফা–এক নারীরই জন্য।‘
যুক্তরাষ্ট্রে এলিস পল নামে এক তীব্র তরুণীর আমূল্যবাদী সংঘ কংগ্রেসনাল ইউনিয়ন’ [পরবর্তী নাম ‘ওম্যানস পাটি’]। ভোটাধিকার লাভের জন্যে তিনি প্রয়োগ করেন সব কৌশল : তাঁর দল প্যারেড, গণবিক্ষোভ, অনশন ধর্মঘট করে; তাঁর দলের সদস্যরা কারাগারে যায়। তিনিই মার্কিন নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলনকে অবসন্নতা উদ্ধার করেন।
যুক্তরাজ্যে নারী ভোটাধিকার আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। তারা রাতে দেয়ালে দেয়ালে দাবি লেখে, ডাকবাক্সে জ্যাম ঢেলে ডাকবিভাগকে বিব্রত করে, দমকলঘন্টা বাজায়, প্রধান মন্ত্রী লয়েড জর্জের বাড়ির ক্ষতিসাধন করে, রেলস্টেশন স্টেডিয়াম গির্জায় আগুন লাগায়। জুনের ৮ তারিখে এপসম ডাউন্সে রাজার রেসের ঘোড়া যখন দৌড়োচ্ছিলো, তখন এমিলি ওয়াইন্ডিং ডেভিসন দৌড়ে গিয়ে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরেন। আহত এমিলি চার দিন পর মারা যান। এমিলি নারীবাদের প্রথম শহীদ।
১৯১৭ ভারতীয় নারীদের ভোটাধিকার দাবি; জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি।
১৯১৮ যুক্তরাজ্যে ত্ৰিশোর্ধ নারীরা ভোটাধিকার পান; ১৯২৮-এ তাঁদের ভোটাধিকার বয়স কমিয়ে পুরুষের সমান, ২১ বছর, করা হয়।
১৯১৯ জর্মন নারীবাদের জনপ্ৰিয়তম নেত্রী, তাত্ত্বিক, বক্তা ডক্টর রোসা লুক্সেমবুর্গ ডানপন্থী সৈন্যদের হাতে নিহত [১৫ জানুয়ারি]।
১৯২০ আগস্টের ২৬ তারিখে মার্কিন কংগ্রেস নারী ভোটাধিকার (১৯তম) সংশোধনী বিল পাশ করে। ১৮৭৮ থেকে ‘অ্যান্থনি সংশোধনী’ নামে এটি কংগ্রেসের প্রতি অধিবেশনে উত্থাপি৩ হয়, কিন্তু গৃহীত হ’তে লাগে বেয়াল্লিশ বছর! এর সাথে আমেরিকায় ঘটে নারীবাদের মৃত্যু; পুনরুজীবিত হ’তে লাগে চল্লিশ বছর।