শুধু পুরোহিতেরা নন, বিজ্ঞানীরাও ঘেন্না করেছেন নারীর দেহের কথা ভাবতে। লিনাউস প্রকৃতিবিষয়ক সন্দর্ভে ঘেন্নায় নারীর যৌনাঙ্গ সম্পর্কে আলোচনা করেন নি। আজো অনেকেই নারীর দেহ, এমনকি নারী সম্পর্কে আলোচনাকেই মনে করে অশ্লীল। ফরাশি বিজ্ঞানী দ্য লরেঁ ঘেন্নায় প্রশ্ন করেছেন, ‘কী ক’রে এই স্বর্গীয় প্রাণী, যার রয়েছে যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি, আকর্ষণ বোধ করে নারীর গোপন অঙ্গের প্রতি, যা ভরা থাকে রসে, আর যা লজ্জাজনকভাবে অবস্থিত শরীরের নিম্নতম স্থলে?’ [দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ২০০)]। খ্রিস্টানেরা তাই দানবীকে রূপান্তরিত করেছে দেবীতে; তারা পাপী প্রলোভনকারিণী হাওয়াকে ধুয়েমুছে তৈরি করেছে পাপহর মেরিকে। নারীকে তারা ক’রে তুলেছে গৃহগির্জার থাম। এ-প্রক্রিয়ায় নারীর শরীর থেকে ছেঁকে ফেলে দেয়া হয়েছে কাম। একজন লিখেছেন, ‘পুরুষের মাঝে যৌনকামনা সহজাত ও স্বতস্ফুর্ত, নারীর মধ্যে গুপ্ত, যদিও একেবারে অনুপস্থিত নয়।‘ অ্যাকটন ছিলেন উনিশ শতকের এক বিখ্যাত বিলেতি চিকিৎসক, বই লিখেছিলেন জননেন্দ্ৰিয়ের ভূমিকা ও রোগ নামে। ওই বইতে তিনি নারীর যৌনাঙ্গ সম্পর্কে কোনো আলোচনাই করেন নি; তাঁর মনোভাব হচ্ছে নারীর ওই সব প্রত্যঙ্গ নেই, থাকলেও সেগুলোর কোনো ভূমিকা নেই! তিনি ভিক্টোরীয় তরুণ স্বামীদের অভয়ও দিয়েছেন যে নারীরা তাদের গিলে খাবে না, কেননা ‘প্রেম, গৃহ, সন্তানই নারীর সব। সঙ্গম ঘটে খুবই কম’ (দ্র বাস্ক (১৯৭৪, ৮-৯)]। যে-সঙ্গম পুরুষের দিবারাত্রির স্বপ্ন, তাকেও ভয় করে পুরুষ। ওই দানবীর অঙ্গটিকে তার মনে হয় ক্ষত : নিজের ধাতুক্ষরণকে মনে হয় মৃত্যু। সব সমাজেই বিশ্বাস করা হয় সঙ্গমে পুরুষের বীর্য ক্ষয় হয়, শক্তি নষ্ট হয়; ফরাশিরা পুরুষের পুলককে বলে ‘ছোটো মৃত্যু’। নারীকে পুরুষ মনে করে ডাইনি, রক্তপায়ী ভ্যাম্পায়ার, যে তাকে পান করে, খায়। ফ্রয়েড পুরুষের এ-ভয়কে বৈজ্ঞানিক রূপ দিয়েছিলেন যে নারী সঙ্গমের সময় পুরুষকে খোজা করার সুখ পায়, অধিকার করে নেয় সম্রাট শিশ্নটি। পুরুষ নারীকে ততোটুকু ভালোবাসে ও দেবী মনে করে যতোটুকু নারী তার অধিকারে; আর ভয় কয়ে ও দানবী মনে করে যতোটুকু নারী তার অধিকারের বাইরে।
নারী দানবী, তাই তাকে বিশ্বাস করা যাবে না। পুরুষের সমস্ত শাস্ত্র রটনা করেছে নারীকে বিশ্বাস করলে ঘটবে পুরুষের পতন; তার শৌর্য নষ্ট হবে, রাজ্য ধ্বংস হবে, সমস্ত কীর্তি ধুলোয় লুটোবে। নারীকে বিশ্বাস ক’রে পুরুষের শোচনীয় পতনের কাহিনীতে ভ’রে আছে সমস্ত পুরাণ ও সাহিত্য। হাদিসে আছে : ‘যদি বিবি হাওয়া না হইত তবে কখনো কোনো নারী স্বামীর ক্ষতি করিত না’, এবং ‘পুরুষের জন্য নারী অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকর বিপদের জিনিস আমি আমার পরে আর কিছু রাখিয়া যাইতেছি না’, এবং ‘তোমরা দুনিয়া সম্পর্কে সতর্ক হও এবং সতর্ক হও নারী জাতি সম্পর্কে। কেননা, বনি ইস্রাইলের প্রতি যে প্রথম বিপদ আসিয়াছিল তাহা নারীদের ভিতর দিয়াই আসিয়াছিল’, এবং ‘নারী হইল আওরত বা আবরণীয় জিনিস। যখন সে বাহির হয় শয়তান তাহাকে চোখ তুলিয়া দেখে’ [দ্র নূর মোহাম্মদ (১৯৮৭, ২৮১, ১৮৭, ১৮৮, ২০১); এবং ‘পুরুষ নারীর বাধ্য হলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়’ [দ্র রফিক (১৯৭৯, ১৮৩)]। নারীর বশীভূত হ’লে বীরের কী দুর্দশা ঘটে, বাইবেলের প্রণেতারা তা লিখেছেন স্যামসন ও ডেলাইলার উপাখ্যানে। স্যামসন শাস্তি পায় নারীর বশীভূত হওয়ার অপরাধে। মিল্টনের স্যামসন অ্যাগোনিসটিজ-এ স্যামসন বিশ্বাসই করে সে পেয়েছে উচিত শাস্তি; কেননা সে করেছে তুচ্ছ নারীর বশীভূত হওয়ার মতো গৰ্হিত অপরাধ। নারীর মতো সামান্যার বশীভূত হওয়ার থেকে অনেক ভালো যুদ্ধে মরা, ঘৃণ্য শত্ৰুর দাস হওয়া। স্যামসনের বিলাপে বাজে নারীর প্রতি পুরুষের চিরন্তন ধিক্কার :
ঘূণ্য কাপুরুষতা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ক’রে
রেখেছিলো তার দাস; হে অসম্মান,
হে মর্যাদা, ধর্মের কলঙ্ক! ক্রীতদাস মন
পুরস্কৃত হয়েছে দাসের যোগ্য শাস্তিতে!
যে-রসাতলে এখন পড়েছি আমি,
এই ছিন্নবাস, এই ঘানিটানা, এও তুচ্ছ
আগের ঘূণ্য, অপৌরুষেয়, কলঙ্ককর, কুখ্যাত,
যথার্থ গোলামির কাছে। সেদিনের অন্ধদশা ছিলো অনেক নিকৃষ্ট,
যা দেখতে পায় নি আমার বশ্যতা ছিলো কতো শোচনীয়।
পুরুষতন্ত্র বিশ্বাস করে নারী হচ্ছে অনন্ত কাম ক্ষুধা, যা পুরুষকে শুষে নিঃশেষ করে। পুরুষের কাছে নারী হচ্ছে কাম। যে-নারী নিচে অসার পড়ে থেকে পুরুষকে সম্ভোগ করতে দেয়, পুরুষ তাকে সতী ভাবে; আর যে-নারী সাড়া দেয়, পুরুষকে মথিত করে, পুরুষের কাছে সে দানবী। জাঁ জাক রুশোর কথা ধরা যাক। রোম্যানটিকতার পুরোধা এ-দার্শনিক ঘোষণা করেছিলেন, ‘মানুষ জন্ম নেয় স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত।‘ তাঁর কাছে ‘মানুষ’ হচ্ছে ‘পুরুষ’। তিনি আসলে বলেছিলেন, ‘পুরুষ জন্ম নেয় স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত।‘ রুশোর বিশ্বাস ছিলো নারীরা বাঁচবে পুরুষের বিনোদের জন্যে; তবে পুরুষের অপেক্ষায় না থেকে কামেপ্রেমে নারীর উদ্যোগ নেয়ার প্রবল বিরোধী রুশো। যে-নারী উদ্যোগ নেয়, সে দানবী। রুশোর মতে, নারী থাকবে লাজুক লতা; সে নিজের দেহের সুখের কথা ভাববে না; যদি ভাবে তবে মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যাবে সে-প্রক্রিয়ায় যে-প্রক্রিয়ায় তার টিকে থাকার কথা। অর্থাৎ পুরুষের কাম মানবজাতিকে টিকিয়ে রাখার জন্যে, আর নারীর কাম হচ্ছে মানবজাতির বিনাশ। পুরুষ তার আজগর কামক্ষুধায় ছুটতে পারে নারী থেকে নারীতে; নিজের ক্ষুধা তৃপ্ত করার জন্যে জাগিয়ে তোলে অলৌকিক ভীতি, কিন্তু নারীর ক্ষুধা তার কাছে আপত্তিকর। নারী হচ্ছে পুরুষের কাম ক্ষুধার খাদ্য; পুরুষ এটা শুধু বিশ্বাসই করে না, নারী যাতে অবলীলায় খাদ্য হয়, পুরুষ তার বিধানও তৈরি করে। আরব অঞ্চলে নারীকে মনে করা হয় ‘ফিৎনা’, যে নিজের কামে ঘটাতে পারে সামাজিক বিশৃঙ্খলা; কিন্তু সেখানে নারীকে অবরুদ্ধ ক’রে নানা ব্যবস্থা নেয়া হয় পুরুষের কামতৃপ্তির। একটি হাদিসে রয়েছে: ‘যখন কোনো রমণীকে তার স্বামী শয্যায় আহ্বান করে এবং সে অস্বীকাব করে এবং তার জন্য তার স্বামী ক্ষোভে রাত কাটায়–সেই রমণীকে প্রভাত পর্যন্ত ফেরেশতাগণ অভিশাপ দেয়’ [দ্র রফিক (১৯৭৯, ১৮১)]। নারী সম্পর্কে ডাইনিশিকারী স্প্রেংগার [দ্র ফিজেস (১৯৭০, ৬৪)] লিখেছেন :