এ-মৌলিক পরিবর্তনের সাথে রাজনীতিক, সামাজিক, আর্থনীতিক প্রভৃতি গৌণ ব্যাপারেও বদল ঘটাতে হবে; নারীকে দিতে হবে আত্মনিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ অধিকার। তারা মনে করেন সমাজের সমস্ত কাজে নারীকে সম্পূর্ণরূপে জড়িত করতে হবে, এবং দিতে হবে যৌন স্বাধীনতা। তাদের মতে প্ৰযুক্তি শুধু নারীকে গর্ভধারণের দায় থেকে মুক্তি দেবে না, পরিশেষে তা মুক্তি দেবে নারীপুরুষ উভয়কেই কাজ করার দায় থেকে। প্রযুক্তি ধ্বংস ক’রে দেবে পরিবারের জৈবিক ও আর্থ ভিত্তি, বাতিল হয়ে যাবে পরিবার, নারীপুরুষের বিভিন্ন ভূমিকা, ও শক্তির সম্পর্ক। তাঁরা মনে করেন নারীকে নিজের ভূমিকা বেছে নেয়ার অধিকার দেয়াই যথেষ্ট নয়; জৈবিক বিপ্লবের মাধ্যমে বিলুপ্ত করে দিতে হবে সমস্ত ভূমিকা’। তাদের মতে জৈবিক পরিবার বিলুপ্ত হ’লে যৌন পীড়নও লোপ পাবে। তখন কে কার সাথে, ও কোন ধরনের যৌনসম্পর্কে জড়িত হবে, তা স্থির করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে প্রতিটি নরনারীর। তখন সমকামী-পুরুষের সাথে পুরুষের, নারীর সাথে নারীর-নিন্দিত থাকবে না, বিকল্প বলেও গণ্য হবে না; যে যার রুচি মতো বেছে নেবে বিশেষ ধরনের যৌনসম্পর্ক। উদার নারীবাদীদের মতে সমকাম বিষমকামের বিকল্প, মার্ক্সীয়দের মতে সমকামী পুঁজিবাদী বিকৃতি; আমূল নারীবাদীদের মতে এটা স্বাভাবিক। তাদের মতে জৈবিক বিপ্লবের ফলে ‘সমকাম’, ‘বিষমকাম’ প্রভৃতি ধারণাই লোপ পাবে; লোপ পাবে ‘যৌনসঙ্গম’ নামের সংস্থাটি’ও, যাতে নারীপুরুষ পালন করে সুনির্দিষ্ট ভূমিকা। সাম্য বলতে আমূল্যবাদীরা শুধু সুযোগসুবিধার সাম্য বোঝেন না, বোঝেন সন্তানধারণ না করারও সাম্য। তবে সন্তানকে ভালোবাসাব অধিকার থাকবে তাদের। জৈবিক বিপ্লব বাস্তবায়িত হ’লে রাষ্ট্র লোপ পাবে; এর ফলে এমন মানুষ দেখা দেবে, যা আগে কখনো দেখা যায় নি। এ-বিপ্লব শুধু নারীকে মুক্ত করবে না, মুক্ত করবে। পুরুষকেও; পুরুষ মুক্তি পাবে ভরণপোষণের ভার থেকে, কিন্তু তারাও সন্তান ধারণ ও লালনে পালন করবে। সমান দায়িত্ব।
আমূল নারীবাদের একটি ধারা হচ্ছে নারীসমকামী স্বাতন্ত্র্যবাদ’। তাদের মতে পুরুষাধিপত্য বিলুপ্ত করার উপায় হচ্ছে পুরুষের সাথে কোনো সম্পর্কে না আসা। তাদের একদলের মতে, এটা সাময়িক ব্যবস্থা; আরেক দলের মতে, এটা হবে সব সময়ের ব্যবস্থা। তাদের মতে কে কার যৌনসঙ্গী, এটা কোনো গুরুত্বের ব্যাপার নয়; তবে এখনকার পুরুষাধিপত্যবাদী সমাজে যৌনসঙ্গী নির্বাচনও রাজনীতি। তাই পুরুষাধিপত্য প্রতিরোধ করার জন্যে নারী পুরুষকে প্রত্যাখ্যান ক’রে যৌনসঙ্গী হিশেবে বেছে নেবে নারীকে। তাদের মতে বিষমসম্পর্কের ভেতরেই গোপন রয়েছে এমন বিশ্বাস যে পুরুষ প্রভুত্ব করবে নারীর ওপর। অনেক নারীসমকামী স্বাতন্ত্র্যবাদী আবার প্রতিষ্ঠা করতে চান মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, কেননা তা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার থেকে উন্নত। সম্প্রতি মার্ক্সীয় নারীবাদ কিছুটা ভিন্ন রূপ নিয়েছে, যা ধ্রুপদী মার্ক্সীয় নারীবাদের সাথে যুক্ত কবেছে কিছু নতুনত্ব। তাঁরা সন্তানধারণে প্রস্তুত, এবং আমূল নারীবাদকে গণ্য করেন ইউটোপীয় ধারণা বলে। তারা মনে করেন সাম্যবাদই নারীমুক্তির পর্বশর্ত, তবে সাম্যবাদই যথেষ্ট নয়; কেননা সাম্যবাদী সমাজেও বিরাজ করতে পারে লিঙ্গবাদ। তাই নারীমুক্তির জন্যে বদলে দিতে হবে সামাজিক সম্পর্কের সম্পূর্ণ রূপটিকেই।
১৭৯২ মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্ট্-এর (১৭৫৯-১৭৯৭) ভিন্ডিকেশন অফ দি রাইটস্ অফ ওম্যান। ভিণ্ডিকেশন নারীমুক্তি আন্দোলন বা নারীবাদের প্রথম মহাইশতেহার; একে মার্কিন ‘ডিক্লেয়ারেশন অফ ইন্ডিপেনডেন্স’-এর সাথে তুলনা করে নারীবাদী স্বাধীনতার ঘোষণা ও বলা হয়। প্রকাশের পর মেরি নিন্দিত, প্রশংসিত, ধিকৃত, অভিনন্দিত হন; রক্ষণশীলেরা মেতে ওঠে ধিক্কারে, প্রগতিশীলেরা জানায় অভিনন্দন। তেরো পরিচ্ছেদের তীব্ৰ তীক্ষু এ-বইটির মূল দাবি নারী মানুষ, বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, নারী যৌনপ্রাণী নয়; তাকে দিতে হবে স্বাধিকার। আঠারোশতকের শেষভাগে যখন পুরুষেরা দেশে দেশে বিপ্লব ক’রে চলছিলো, সংগ্রাম ক’রে চলছিলো মানুষের অর্থাৎ পুরুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে, তখন তেত্রিশ বছরের তরুণী মেরি ঘোষণা করেন নারীমুক্তির ইশতেহার। তাঁর বই সাথে সাথে কোনো বিপ্লব ঘটায় নি, তবে সূচনা ক’রে এক দীর্ঘ বিপ্লবের, যা আজো অসম্পূর্ণ।
১৮১৮ রামমোহন রায়ের সহমরণ বিষয় প্ৰবৰ্ত্তক ও নিবৰ্ত্তকের সম্বাদ। রামমোহন সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম নারীবাদী পুরুষ, যিনি নারীকে দিতে চেয়েছিলেন বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকু, পিতৃতন্ত্র যা দিতে চায় নি।
১৮১৯ রামমোহন রায়ের সহমরণ বিষয়ে প্ৰবৰ্ত্তক ও নিবাৰ্ত্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ।
১৮২২ গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কারের স্ত্রীশিক্ষাবিধায়ক। বিদ্যালঙ্কার বলেন :
‘যদি ফল স্ত্রীলোকের বুদ্ধি অল্প এ কারণ তাহাদের বিদ্যা হয় না, অতএব পিতামোতও তাঁহাদের বিদ্যার জন্যে উদ্যোগ করেন না, একথা অতি অনুপযুক্ত। যেহেতুক নীতিশাস্ত্রে পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রীর বুদ্ধি চতুর্গুণ ও ব্যবসায় ছয়গুণ কহিয়াছেন।…এদশের লোকেরা বিদ্যা শিক্ষা ও জ্ঞানের উপদেশ স্ত্রীলোককে প্রায় দেন না। বরং তাঁহাদের মধ্যে যদি কেহ বিদ্যা শিখিতে আরম্ভ কবে তবে তাঁহাকে মিথ্যা জনরব মাত্র সিদ্ধ নানা অশাস্ত্রীয় প্রতিবন্ধক দেখাইয়া ও ব্যবহার দুষ্ট বলিয়া মানা করান।