মার্ক্সীয় নারীবাদ : মার্ক্সীয় মতবাদ অনুসারে নারীশোষণ, ঐতিহাসিকভাবে এবং বর্তমানে, ব্যক্ৰিমালিকানার ফল; তাই নারীকে মুক্ত করা সম্ভব শুধু ব্যক্তিমালিকানা বিলুপ্ত ক’রে। মার্ক্সীয়দের মতে নারীমুক্তি-আন্দোলন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপক সংগ্রামের একটি অংশ। সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার অনেক কারণ রয়েছে, নারীবাদ ওই কারণগুলোর একটি। তাদের মতে নারী ও শ্রমিকের স্বাৰ্থ একই, কেননা নারী ও শ্রমিক একই রকমে শোষিত। মার্ক্সীয় নারীবাদের উদ্ভব ঘটে এঙ্গেলসের পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি (১৮৮৪) সন্দর্ভে। মার্ক্সবাদ অনুসারে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে অধিকাংশ মানুষই শোষিত, কেননা উৎপাদনের উপকরণগুলো কিছু মানুষের অধিকারে। তারা উপকরণের জোরে আধিপত্য করে সমাজের অধিকাংশ মানুষের ওপর, যারা বেঁচে থাকার জন্যে শস্তায় বেচে দিতে বাধ্য হয় তাদের শ্রমশক্তি। নারীও এ-শোষণের শিকার। মাস্ত্রীয়রা স্বীকার করেন যে নারী শিকার হয় আরো বিশেষ কিছু শোষণের, পুরুষ যা থেকে থাকে মুক্ত; তবে শোষণেঝ মূল রয়েছে পুঁজিবাদে, তাই পুঁজিবাদ উৎখাত নারীর জন্যে আরো বেশি জরুরি। মার্ক্সবাদ অনুসারে নারী বিশেষভাবে শোষিত হয় প্রথাগত পরিবারের জন্যে : নারী হচ্ছে পারিবারিক দাসী, সে বাইরের কোনো উৎপাদনমুখি কাজে অংশ নিতে পারে না। একপতিপত্নী বিয়ে উদ্ভাবনই করা হয়েছিলো কতিপয়ের মুঠোতে ধন জড়ো করার উদ্দেশ্যে; ওই কতিপয় পুরুষ। তাদের মতে পরিবার গঠিত হয়েছিলো শ্রেণীভিভক্ত সমাজে পুরুষাধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে। পুরুষই পরিবারে সার্বভীেম। এঙ্গেলসের (১৮৮৪, ২২৯) মতে, একপতিপত্নী বিয়েনির্ভর ‘আধুনিক ব্যক্তিগত পরিবার স্ত্রীলোকের প্রকাশ্য অথবা গোপন গাৰ্হস্থ দাসত্বের ভিত্তির উপব দাড়িয়ে আছে।’ তবে এ-বিয়ে নামে মাত্র একপতিপত্নী বিয়ে; এতে নারীকেই থাকতে হয় সতী, কিন্তু পুরুষের কাছে যৌনসততা চাওয়া হয় না।
মার্ক্সীয়রা বলেন না যে নারীশোষণ পুঁজিবাদের সৃষ্টি; তবে তাদের মতে পুঁজিবাদ নারীশোষণ বহুগুণে বাড়িয়েছে, এবং নারীকে অবনতির শেষ সীমায় পৌঁছে দিয়েছে। তাদের মতে পুঁজিবাদ। আর পুরুষাধিপত্য অবিচ্ছেদ্য, একটি শক্তিশালী করে আরেকটিকে। এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২৯, ২৩০) বলেছেন, ‘সামাজিক উৎপাদনের ক্ষেত্র থেকে বহিষ্কৃত হয়ে স্ত্রী-ই হল প্রথম ঘরোয়া ঝি’, এবং ‘সামাজিক উৎপাদনের মধ্যে গোটা স্ত্রীজাতিকে আবার নিয়ে আসাই হচ্ছে তাদের মুক্তির প্রথম শর্ত।’ তখন নারী আর স্বামীর ওপর ভরণপোষণের জন্যে নির্ভর করবে না, নারী স্বাধীন হবে। তবে এর জন্যে দরকার সমাজের মৌলিক রূপান্তর। নারী আজ যে-সকল কাজ করে-ঘরকন্না, শিশুপালন সব কিছুকে নিয়ে আসতে হবে সামাজিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে। তাঁরা মনে করেন নারীমুক্তির জন্যে দরকার পরিবার সংগঠনটির মৌলিক পরিবর্তন। এর জন্যে পরিবারের আর্থিক কাজগুলো পালন করতে হবে রাষ্ট্রকে; রাষ্ট্রই বহন করবে পরিবারের ভার। পুঁজিবাদ। এ-ভার নেবে না; এ-ভার নিতে পারে শুধু সাম্যবাদ। তাই শুধু সাম্যবাদের মধ্যেই নারী পেতে পারে প্রকৃত মুক্তি; সেখানে আর পরিবারের মধ্যে স্বামীটি থাকবে না বুর্জেয়া, আর স্ত্রীটি প্রলেতারিয়েত। সাম্যবাদে ধ্বংস হয়ে যাবে ‘আর্থ একক রূপে বিরাজমান একপতিপত্নীক পরিবার, তবে তা টিকে থাকবে ‘সামাজিক একক’ রূপে। সাম্যবাদেও বিয়ে থাকবে, তবে তা এখনকার মতো আর্থ চুক্তি থাকবে না; তখনও পরিবার থাকবে, তবে তা গড়ে উঠবে নারীপুরুষের পরস্পরিক আকর্ষণে। তখন নারী ও পুরুষ হবে প্রকৃতই মুক্ত।
আমূল নারীবাদ : আমূল নারীবাদ নারীপীড়নের সমস্ত দিক ব্যাখ্যা করে একটি মূল ধারণা দিয়ে, সেটি হচ্ছে লৈঙ্গিক পীড়ন। উদার নারীবাদীরা মনে করেন নারীর সমস্যা বাজনীতিক সামাজিক অধিকারহীনতা, কিন্তু আমূল নারীবাদীরা তা মনে করেন না; মার্ক্সীয়দের মতো তারা মনে করেন না যে শ্রেণীবিভক্ত সমাজই নারীর দুরবস্থার মূলে। তাঁরা মনে করেন নারীর দুরবস্থার মূল কারণ জৈবিক; গৰ্ভধারণ করতে গিয়েই নারী মেনে নিতে বাধ্য হয়। পুরুষের অধীনতা। তাদের মতে পরিবারের উৎপত্তি ঘটেছে জৈবিক কারণে, পরিবার একটি জৈবসংগঠন। তারা মনে করেন। ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে আদি ও মৌলিক পীড়ন হচ্ছে পুরুষ কর্তৃক শারীরিকভাবে নারীকে নিজের অধীনে নিয়ে আসা। তারা যেনো মনে করেন যে দেহই নারীর নিয়তি, তবে নারীকে মুক্তি পেতে হবে এ-নিয়তি থেকে। তারা মনে করেন জৈবপরিবারে যে-শক্তির সম্পর্ক দেখা দেয়, তাই শক্তির মৌল কাঠামো; তাদের মতে জৈবপরিবারই শ্রেণীবিভক্ত সমাজের মূলে। তাদের মতে পুঁজিবাদ ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই গীেণ ব্যাপার, মূল লড়াই হচ্ছে লিঙ্গবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। আমূল নারীবাদী ভাবনার উন্মেষ বোভোয়ার, মিলেট, গ্রিয়ার ও আরো অনেকের মধ্যে দেখা যায়, তবে তা প্রবল রূপ পায় টাই-গ্রেস অ্যাটকিনসন ও শুলামিথ ফায়ারস্টোনের লেখায়। তাদের মতে নারী-অধীনতা মূলত জৈবিক, তাই নারীমুক্তির জন্যে দরকার জৈবিক বিপ্লব। তারা মনে করেন মানুষের ইতিহাসে এই প্রথম প্রযুক্তিবিদ্যার এমন উন্নতি হয়েছে যে তার সাহায্যে নারীকে মুক্ত করা সম্ভব সন্তানধারণ ও পালনের মৌলিক অসাম্য থেকে। তারা মনে করেন গর্ভধারণ নারীর জন্যে অবধারিত নয়, মানবপ্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নারীর নয়। যদি মানবপ্রজাতিকে টিকিয়ে রাখতে হয়, তবে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে পুরুষকেও। নারী আর গর্ভধারণ করবে না, শিশুপালন করবে না; কৃত্রিম উপায়ে জন্ম দিতে হবে সন্তান, আর সমাজ বহন করবে তার পালনের দায়িত্ব।