এখন অধিকাংশ দেশে নারী ভোট দিতে পারে, তবে এর মানে নয় যে নারী তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে স্বাধীনভাবে। অনেক মুসলমান রাষ্ট্রে ভোটাধিকার থাকা সত্ত্বেও নারী ভোট দেয় না, বা দিতে পারে না, বা দেয় পুরুষ অভিভাবকের নির্দেশমতো। নারী এখন অধিকাংশ দেশে ভোট দিতে পারে, তার রাজনীতিক অধিকারও রয়েছে, কিন্তু সে-তুলনায় তাদের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের হার অত্যন্ত তুচ্ছ। আজো নারী রাজনীতিক রূপকথা বা রাজনীতিতে উৎকট দৃশ্য। এখন পৃথিবীর ৯৬ শতাংশ নারীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে, কিন্তু অধিকাংশ দেশে রাজনীতিক পদে অধিষ্ঠিত নারীর সংখ্যা শোচনীয়রূপে স্বল্প। অধিকাংশ দেশে সংসদে নারী প্রতিনিধির সংখ্যা খুবই কম; কোনো কোনো দেশে-যেমন বাঙলাদেশ, পাকিস্তান, ঘানায়-সংসদে নারীদের জন্যে আসন সংরক্ষিত রাখা হয়। এ-বোধ থেকে যে নারীরা সরাসরি নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য। সংরক্ষিত নারী আসনগুলো নারীমুক্তির পক্ষে নয়, বিরুদ্ধে; এর ফলে দেখা দেয় এমন সুবিধাবাদী নারী, যারা শুধু ক্ষমতাশালীদের অনুগত থাকার ফলেই ওই আসন লাভ করে। তাদের কোনো রাজনীতিক যোগ্যতা থাকে না, তারা হয়ে থাকে সুযোগসন্ধানী সুবিধাবাদী, পুরুষ রাজনীতিকদের মতোই দুশ্চরিত্র: তারা নারীদের যোগ্যতা অর্জনের বদলে শুধু শক্তিশালীদের অনুগত, এমনকি রক্ষিতা, হাতে শেখায়। গত কয়েক দশকে কয়েকটি দেশে নারী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে : শ্ৰীলঙ্কায় শ্ৰীমাভো বন্দরনায়েকে, ইসরাইলে গোল্ড মেয়ার, ভারতে ইন্দিরা গান্ধি, আর্জেন্টিনায় ইসাবেলা পেরন, যুক্তরাজ্যে মাৰ্গারেট থ্যাচার, ফিলিপিনসে কোরাজান অ্যাকিনো, পাকিস্তানে বেনজির ভট্টো, বাঙলাদেশে খালেদা জিয়া অধিকার করেছেন সর্বোচ্চ রাজনীতিক ক্ষমতা। কিন্তু তারা, গোল্ড মেয়ার ও মার্গারেট থ্যাচার বাদে, সবাই ক্ষমতায় এসেছেন কোনো মৃত বা নিহত পুরুষের উত্তরাধিকারী ও পুরুষতন্ত্রের পুতুল রূপে। কেউ কেউ অবশ্য পুতুল হয়ে থাকেন নি; যেমন ইন্দিরা গান্ধি। তারা যতোটা রূপকথা ততোটা বাস্তব নন; তারা অনেকাংশে নারীর জন্যে পুরুঘের থেকেও ক্ষতিকর। পুরুষতন্ত্রের কোনো পীড়িত পক্ষ যখন পুরুষতন্ত্রের অন্য কোনো হিংস্র পক্ষের দ্বারা পর্যুদস্ত হতে থাকে, তখন তারা ব্যবহার করে এমন কোনো নারীকে যে সম্পর্কিত কোনো কিংবদন্তিতুল্য পুরুষের সাথে। এভাবেই উদ্ভব ঘটেছে শ্ৰীমাভো, ইন্দিরা, ইসাবেলা, কোরাজান, বেনজির, খালেদার। এসব দেশে নারীর অবস্থা খুবই শোচনীয়, কিন্তু শবপুজোবাদী রাজনীতির ফলে তাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন, তাই তারা নারীমুক্তির উদাহরণ নন, সম্ভাবনাও নন। রাজনীতি এখন সম্পূর্ণ পুরুষতান্ত্রিক, রাজনীতিতে শক্তিশালী নারীরাও পুরুষতন্ত্রেরই প্রতিনিধি; তাই তারা নারীদের উপকারে আসছেন না। নারীকে নিজের স্বাধীনতা ও অধিকারের জন্যে বিশ্বাস করতে ও সক্রিয় হ’তে হবে প্ৰগতিশীল রাজনীতিতে, নারীবাদী রাজনীতিতে। পুরুষদের জন্যে প্রতিক্রিয়াশীলতা সুবিধাজনক ব্যাপার, নারীর জন্যে প্রতিক্রিয়াশীলতা হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড।
নিজের ভবিষ্যতের জন্যে নারীকে ত্যাগ করতে হবে পিতৃ-ও পুরুষ-তন্ত্রের সমস্ত শিক্ষা ও দীক্ষা; ছেড়ে দিতে হবে সুমাতা, সুগৃহিণী, সতীর ধারণা; তাকে আয়ত্ত করতে হবে শিক্ষা, এবং গ্রহণ করতে হবে পেশা। তাকে হ’তে হবে আর্থনীতিকভাবে স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত; তাকে প্রস্তুত থাকতে হবে সব ধরনের প্রতিক্রিয়াশীলতার সাথে লড়াইয়ের জন্যে। তাকে কান ফিরিয়ে নিতে হবে পুরুষতন্ত্রের সমস্ত মধুর বচন থেকে, তাকে বর্জন করতে হবে পুরুষতন্ত্রের প্রিয় নারীত্ব। তাকে সাবধান থাকতে হবে পুরুষতন্ত্রের সমস্ত মহাপুরুষ সম্বন্ধে, সন্দেহের চোখে দেখতে হবে সবাইকে, কেননা কেউ তার মুক্তি চায় নি। তাকে মনে রাখতে হবে সে মানুষ, নারী নয়; নারী তার লৈঙ্গিক পরিচয় মাত্ৰ; মনে রাখতে হবে পুরুষের সাথে তার পার্থক্য মাত্র একটি ক্রোমোসোমের, এবং একটি ক্রোমোসোমের জন্যে একজন প্ৰভু ও আরেকজন পরিচারিকা হয়ে উঠতে পারে না। নারীকে ঘৃণা করতে শিখতে হবে সম্ভোগের সামগ্ৰী হ’তে, এবং হতে হবে সক্রিয়, আক্রমণাত্মক। নিজের ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করে নিতে হবে নিজেকেই, পুরুষ তাঁর ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করবে না। নারীর ভবিষ্যৎ মানুষ হওয়া, নারী হওয়া নারী থাকা নয়।
নারীবাদ, ও নারীবাদের কালপঞ্জী
নারীপুরুষ সমান, তাদের অধিকার অভিন্ন : এ হচ্ছে নারীবাদ। একে মনে হয় সরল, দিবালোকের মতো স্বচ্ছ, সত্য বলে; কিন্তু পিতৃতন্ত্রের দীর্ঘ ইতিহাসে মানা হয় নি এ-সরল সত্যটুকু। নারীবাদীরা মনে করেন মৌল যোগ্যতায় কোনো পার্থক্য নেই নরনারীতে; নারী ও পুরুষের মূল পরিচয় তাদের স্ত্রী বা পুংলিঙ্গ নয়, তাদের মূল পরিচয় তারা মানুষ। মানুষের প্রকৃতি ও যোগ্যতা লিঙ্গনিরপেক্ষ । কিন্তু পিতৃতন্ত্র এটা মানে নি। নারীবাদীদের বিদ্রোহ নারীপুরুষের আসাম্যের ধারণা ও অসম অধিকারের বিরুদ্ধে; তারা মনে করেন প্রথাগতভাবে নারীপুরুষকে যে মনে করা হয় অসম ব’লে, এবং নারীদের যে রেখে দেয়া হয়েছে নিকৃষ্ট সামাজিক অবস্থানে, তা অন্যায়। তাঁরা সবাই মনে করেন পরিবর্তন ঘটাতে হবে এ-ব্যবস্থার, তবে কী পরিবর্তন ঘটাতে হবে, সে-সম্পর্কে তারা পোষণ করেন নানা মত। নারীমুক্তির জন্যে কী কৌশল নিতে হবে, সে-সম্পর্কেই শুধু তাঁরা ভিন্ন মত পোষণ করেন না; তাঁদের ভিন্নতা আরো গভীর স্তরের। নারীর প্রকৃত স্বাৰ্থ কী, কী হ’লে প্রকৃতই মুক্তি ঘটবে নারীর, এ-সম্পর্কে বিভিন্ন নারীবাদী তাত্ত্বিক পোষেণ বিভিন্ন মত। নারীবাদে চােখে পড়ে বেশ কয়েকটি তত্ত্বদর্শ, প্রতিটিই বিশ্বাস করে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যে দরকার নারীর স্বাধীনতা ও পুরুষের সাথে সাম্য; কিন্তু বিভিন্ন মৌল বিষয়ে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে নানা ভিন্নতা। প্রকৃত স্বাধীনতা ও সাম্য কী, মানুষ বা নারীর প্রকৃত স্বভাব বা প্রকৃতি কী, রাষ্ট্রের দায়িত্ব কী হবে, এসব বিষয়ে তাঁদের মধ্যে রয়েছে দার্শনিক ভিন্নতা। নারীমুক্তি সম্পর্কে কয়েকটি তত্ত্বাদর্শ রয়েছে; এগুলো হচ্ছে ‘রক্ষণশীল মতবাদ’, ‘উদার (মানবতাবাদী) বা ব্যক্তিস্বতন্ত্র্যবাদী নারীবাদ, মার্ক্সীয় নারীবাদ’, ‘আমূল নারীবাদ’। রক্ষণশীল মতবাদটি নারীর মুক্তিবিরোধী, এটি ছাড়া অন্যগুলো বিশ্বাস করে নারীমুক্তিতে।