বাঙলাদেশে প্রতিক্রিয়াশীলতার যে-বিস্তার ঘটছে, তা প্রগতির জন্যে উদ্বেগজনক, এবং নারীর জন্যে বিশেষভাবেই ভীতিকর। চারপাশে এখন কালো বোরাখার ভৌতিক প্রচ্ছায়া দেখা যাচ্ছে, নারীদের এখন বেরোতে হয় আগের থেকে অনেক সাবধানে, নারী এখন আগের থেকে অনেক বেশি পরিমাণে নিজের শরীর ঢেকে রাখতে বাধ্য হয়; এবং সবচেয়ে শোচনীয় হচ্ছে অনেক নারীও দীক্ষিত হচ্ছে মৌলবাদে। শ্বশুরবাড়ি হচ্ছে তরুণীদের জন্যে কারাগার, প্রতিক্রিয়াশীলতায় দীক্ষার মন্দির, যেখানে তাদের বাধ্য করা হয়। পুরুষাধিপত্য ও মধ্যযুগীয়তা মেনে নিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বোরখা প’রে যে-ছাত্রীরা আসে, তারা বিবাহিত বা জামাতের সদস্য;–এ-দুটির একটি, বা দুটিই; বোরখাপরা বিবাহিত ছাত্রীরা কেউ বিয়ের আগে বোরখা পরতো না, বিয়েই তাদের তুলে দেয় মধ্যযুগের হাতে। এতে তারা সবাই খুবই পীড়িত বোধ করে, কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল পরিবার টিকিয়ে রাখার জন্যে তারা বাধ্য হয় মধ্যয়ুগকে মেনে নিতে। কিছু কিছু মেয়ের জন্যে এটা এতো পীড়াদায়ক যে তারা আক্রান্ত হয় মানসিক রোগে। আধুনিক তরুণীর মুখের ওপর কালো বোরখা চাপিয়ে তাকে কেমন বিকৃত ক’রে দেয়া হয়, তার কিছু অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে, তার মধ্যে একটি কখনো ভুলবো না। কয়েক বছর আগে জাতীয় উদ্যানে বিভাগীয় বনভোজনে একটি ঝোপের মাঝে দুটি অত্যন্ত রূপসী আকর্ষণীয় প্রাণবন্ত তরুণী আমাকে ঘিরে ধরে। তারা জিজ্ঞোস করে, ‘আমাদের চিনলেন, স্যার?’ আমি তাদের চিনতে পারি নি। তখন তারা আরেকটুকু ঘনিষ্ঠ হয়ে বলে, ‘যে-দুজনকে ক্লাশে আপনি বোরখাপরা দেখেছেন, যাদের মুখ কখনো দেখেন নি, আমরা সে-দুজন।’ আমি অত্যন্ত আহত বোধ করি এজন্যে যে এমন সুন্দর প্রাণবন্ত দুটি তরুণী বোরখাচাপা পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকে নিম্প্রাণ। তারা কেনো বোরখা পরে জানতে চাইলে তারা জানায়, কারণ হচ্ছে শ্বশুরবাড়ি ও এক অধ্যাপক-চিকিৎসক চাচা। বনভোজনে ওই তরুণী দুটি ছিলো সবচেয়ে প্রাণবন্ত, তারা উদ্যানের নিসর্গের স্তরে স্তরে সেদিন প্রাণসঞ্চার করেছিলো, কিন্তু জীবনে তারা বোরখাচাপা পড়ে নিজেরাই থাকে নিম্প্রাণ। এ-ক-বছরে হয়তো তারা সম্পূর্ণ নিজীব হয়ে পড়েছে, বা শিকার হয়েছে মনোব্যাধির। এখন বোরখা বেড়ে চলছে, ষাটের দশকে বোরখা খুঁজে পাওয়া যেতো না কলাভবনে, এখন কলাভবনের বারান্দায় চলে অন্ধ বোরখার মিছিল।
মুসলমান পিতৃতন্ত্র একটি কথার ব্যাপক প্রচার দিয়েছে যে সপ্তম শতক থেকে ইসলামই নারীকে মুক্তি দিয়েছে; নারীকে দিয়েছে সামাজিক অধিকার। পাকিস্তানপর্ব থেকে এ-প্রচারটি ধ্রুবপদের মতো উচ্চারিত হতে থাকে, এ-অঞ্চলে; নারীরাও এতে বিশ্বাস করে, এবং কী অধিকার দিয়েছে, সে-সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন না ক’রে তারাও এটা আবৃত্তি করে। কোনো ধর্মই নারীকে প্রকৃত অধিকার দেয় নি, ইসলামও দেয় নি; চোদো। শো বছর ধ’রে নারীর অধিকার যতোটা বুলি ততোটা বাস্তব সত্য নয় [দ্র ‘পিতৃতন্ত্রের খড়গ’]। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারীর অবস্থা দেখলেই তা বোঝা যায়। ইসলামের আগে আরবে নারীর অবস্থা যতোটা খারাপ ছিলো বলে প্রচারিত, ততোটা খারাপ ছিলো না; ঐতিহাসিকদের মতে নারী অনেক বেশি স্বাধীন ছিলো অন্ধকার যুগের আরবে [দ্র ফাতিমা (১৯৭৫, ৬৪-৭৩)]। বাঙলাদেশে কিছু শিক্ষিত নারীও না বুঝে, বা কপটতাবশত, বা নিজেদের সুবিধার জন্যে চোদো শো বছর ধরে নারীর অধিকার ও ধর্মের জয়গানে এমন মুখর হয় যে সমগ্র পরিবেশ অতিপ্রাকৃতিক হয়ে ওঠে। টেলিভিশনে পুরুষতন্ত্রের আজ্ঞায় এবং কিছুটা লোভে যে-নারী ধর্মের গাথা প্রচার করে, সে জানে না। অন্যদের আত্মত্যাগের ফলে সে ধর্মের অনেক কঠোর বিধি অমান্য করতে পেরেছে ব’লেই টেলিভিশনে যেতে পেরেছে; যদি তার প্রশংসিত ধর্মের সব বিধি তার ওপর আবার চাপিয়ে দেয়া হয়, তাহলে তাকে অবরুদ্ধ থাকতে হবে অন্ধকারে। মৌলবাদ যেদিন সমস্ত প্ৰগতিশীলতাকে ধ্বংস ক’রে, সেদিন কখনো না। আসুক, তাকে মানতে বাধ্য করাবে সমস্ত বিধান, সেদিন সে শুধু টেলিভিশন নয়, অন্য কোথাও কোনো কথা বলার অধিকার পাবে না। সে জানে না ব্যক্তিগত সুবিধার জন্যে সে কাজ ক’রে চলছে নিজের, ও নারীমণ্ডলির বিরুদ্ধে।
রাজনীতি সবখানেই আজো পুরুষতান্ত্রিক; মৌলবাদী রাজনীতি উগ্র পুরুষাধিপত্যবাদী; আর গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্রও আজো পুরুষের কবল থেকে মুক্তি পায় নি। চিরকালই নারী থেকেছে রাজনীতিক ক্ষমতার বাইরে; ইতিহাসে মাত্র কয়েকজন নারীর নাম মেলে, যারা রাজ্য শাসন করেছেন; তবে তারা এতো মুষ্টিমেয় যে পরিণত হয়েছেন কপকথায়। শাসক ও শাসিতদের মাঝামাঝি চিরকাল থেকেছে একদল মধ্যস্থতাকারী, তাদের অধিকাংশ সরকারি আমলা, এবং কিছু থাকে অসরকারি ব্যক্তি, যারা ব্যক্তিগত সম্পর্কবশত প্রভাব বিস্তার করে শাসকদের ওপর। ব্যক্তিগত সম্পর্কবশত শাসকদের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী উপদেষ্টাদের মধ্যে নারীই বেশি; তারা রানী, স্ত্রী, রক্ষিতা হিশেবে শাসকদের প্রভাবিত করেছে, আজো করে। তবে রানী, ও স্ত্রীদের থেকে রক্ষিতারা শাসকদের প্রভাবিত করেছে অনেক বেশি, কেননা রানী ও স্ত্রীদের থেকে রক্ষিতারাই বেশি প্ৰিয় শাসকদের। পুরুষতন্ত্র ‘রাজা করিতেছে রাজ্য শাসন, রাজারে শাসিছে রানী’ তত্ত্বে বিশ্বাস করে, কারণ এটা রক্ষিতার কাজ; পুরুষ নারীকে রক্ষিতা হিশেবেই দেখতে পছন্দ করে, সরাসরি শাসক হিশেবে দেখতে পছন্দ করে না। শাসকদের উপদেষ্টার ভূমিকায় নারী এসেছে রক্ষিতারূপে; তাই নারীশাসকেরা উপদেষ্টা হিশেবে নারী নেয় না, তাদের উপদেষ্টামণ্ডলিতে সাধারণত নিয়োগ করে পুরুষই। আধুনিক রাষ্ট্রের উৎপত্তির পর শুধু রাজা নয়, দেখা দিয়েছে বিচিত্র ধরনের শাসক, যারা বাজনীতিক, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, আমলা ও আরো নানা ভূমিকায় ক্ষমতা ভোগ করে। কিন্তু এটা হয়ে থাকে পুরুষের অধিকার, নারীর নয়। বিশশতকের দ্বিতীয় দশকের আগে পশ্চিমের সর্বজনীন মানবাধিকারবাদীরাও নারীদের কোনো রাজনীতিক অধিকার দেয়। নি; এমনকি দেয় নি প্ৰায়-নিরর্থক ভোটাধিকারও। আজো, নব্বইয়ের দশকেও, নারীর বিরুদ্ধে রাজনীতিক বৈষম্যের অভাব নেই; নারী আজো রাজনীতিতে অনভিপ্ৰেত, যদিও পুরুষতন্ত্র নিজের সুবিধার জন্যে তাকে কাজে লাগায,। পুরোনো কুসংস্কার আজো এতো প্রবল যে নারী আজো রাজনীতিতে প্ৰবেশাধিকারহীন; অনেক দেশ রয়েছে যেখানে নারীর রাজনীতিক অধিকার সাংবিধানিকভাবেই নিষিদ্ধ। আরব আমিরাত, ইয়েমেন, ওমান, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন, সৌদি আরব প্রভৃতি মুসলমান রাষ্ট্রে নারীকে রাখা হয়েছে রাজনীতির বাইরে; তারা ভোটও দিতে পারে না, অবশ্য অনেক দেশে ভোট দেয়ার ব্যাপারই নেই।