সাফল্যমণ্ডিত; খুব কম পুরুষই পাওয়া যাবে, যাদের বিবাহপূর্ব কামের অভিজ্ঞতা নেই, এবং বিবাহবহির্ভূত কামের সুযোগ নেয় নি। কিন্তু পৃথিবী জুড়ে, বিশেষ ক’রে প্রথাগত সমাজগুলোতে, নারীর বিবাহপূর্ব পুরুষসংসৰ্গ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, এবং বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বিপজ্জনক। তাই নারীর কামতৃপ্তির একমাত্র পথ বিয়ে, যদিও বিয়েও পুরুষেরই কামতৃপ্তির জন্যে আয়োজিত হয়; নারীর তৃপ্তি ওপরিপাওনামাত্র, না পেলেও তা উদ্বেগের কারণ নয়। নারী বহু শতাব্দী ধ’রে প্রথাগত সতীর ভাবমূর্তি বহন ক’রে ক্লান্ত, প্রথাগত সতীর ধারণা তাকে মুক্ত হ’তে দিচ্ছে না, প্রথাগত সতীর ভাবমূর্তি নারীর জন্যে ক্ষতিকর। প্রথাগত সতী পুরুষের এমন দাসী, যার শরীরটিও তার নিজের নয়; একটি পুরুষের। প্রথাগত সতীর ধারণা চূড়ান্তে নিয়ে গিয়েছিলো হিন্দুরা, যারা নারীর দেহকে জন্মজন্মান্তর ধ’রে একটি পুরুষের সম্পত্তিতে পরিণত করেছিলো, যার সতীত্ব অক্ষুন্ন রাখার জন্যে ব্যবস্থা করেছিলো সতীদাহের। পশ্চিমে এখন প্রথাগত সতী নেই, কেউ চায়ও না; কিন্তু উগ্ৰ পিতৃতন্ত্রগুলোতে সতীত্ব আজো ঐশী ব্যাপার। এ-পিতৃতন্ত্রগুলো দ্বৈত মান বজায় রাখার জন্যে ব্যস্ত; পুরুষের জন্যে এক নৈতিকতা, নারীর জন্যে আরেক নৈতিকতা এগুলোর আদর্শ। এ-অনৈতিক নৈতিকতার কবল থেকে নারী বাচতে পারে শুধু আর্থনীতিকভাবে স্বাধীন হয়ে। সব অঞ্চলের নারীই, পুরুষের মতোই, নিজের শরীর উপভোগ পছন্দ করে; নারী জৈবিকভাবে একপুরুষতৃপ্ত নয়, যদিও পুরুষতন্ত্র এটা ভাবতে পছন্দ করে। একটি মাত্র পুরুষের সংসৰ্গকে নারী তার জীবনের ধ্রুব লক্ষ্য মনে করে না; পুরুষের মতো নারীও বহু শরীরের সংসর্গ কামনা করে। বদ্ধ সমাজের নারী যখন মুক্ত সমাজে যায়, তার তখনকার যৌন আচরণ বুঝিয়ে দেয় যে সতীত্ব তার কাছে মূল্যবান নয়; শুধু সমাজের পীড়নেই সে সতীর ভূমিকায় অভিনয় করে। সতীত্ব অনেকটা অভিনয়। প্রথাগত সমাজগুলো নারীকে সতী ক’রে রেখেছে দুটি প্রক্রিয়ায়; দারিদ্র্য ও কঠিন বিধিনিষেধে। যেমন, বাঙলাদেশে নারী বাধ্যতামূলকভাবে সতীর ভূমিকায় অভিনয় করছে দারিদ্র্যবশত, এটি সচ্ছল সমাজ হ’লে অনেক আগেই ভেঙে পড়তো ওই দেয়ালটি; আব্ব সৌদি আরবে নারী সতীর ভূমিকায় অভিনয় করছে হিংস্ৰ বিধানের ফলে। সমাজ যদি কামসততা চায়, তবে চাইতে হবে নারীপুরুষ উভয়েরই জন্যে; শুধু নারীর জন্যে সতীত্বের বিধান হচ্ছে নারীপীড়ন।
মানুষের প্রধান শত্রু এখন মৌলবাদ, নারীরও প্রধান শক্ৰ এখন মৌলবাদ: তবে নারীর জন্যে মৌলবাদ অনেক বেশি মারাত্মক। সব ধরনের মৌলবাদেরই লক্ষ্য নারীকে আবার অবরোধে ঢুকিয়ে পুরুষের ভোগ্যবস্তু ও দাসী ক’রে তোলা। মৌলবাদীর কাছে নারীপুরুষের এলাকা ও ভূমিকা সম্পূর্ণ বিপরীত; মৌলবাদী বিশ্বাস করে না মুক্তি ও সাম্যে। নারী থাকবে গৃহে, অবরোধের মধ্যে, পালন করবে। ভোগ্যবস্তু ও গর্ভধারিণীর ভূমিকা, এ-ই মৌলবাদীর স্থির সিদ্ধান্ত। শিক্ষা নারীকে মুক্তি দেয় এ-ভূমিকা ও অবস্থান থেকে, যা মৌলবাদীর কাছে অত্যন্ত আপত্তিকর; তাই মৌলবাদী প্রচণ্ড প্রতিপক্ষ নারীর শিক্ষা, ব্যক্তিত্ব, ও মুক্তির। মুসলমান দেশগুলোতে মৌলবাদীরা এখন শরিয়া আইন প্রবর্তনের জন্যে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে, কারণ ওই আইনের সাহায্যেই তারা নারীকে চূড়ান্তরূপে পযুঁদিস্ত করতে পারবে। নারীকে আবার অন্ধ বোরখা পরানো হচ্ছে, বোরখায় জানোলা লাগানো হচ্ছে, সামান্য বিচূতির জন্যে নারীকে দেয়া হচ্ছে লোমহর্ষক শাস্তি: কিন্তু শাস্তির বাইরে থেকে যাচ্ছে পুরুষ। ইসলামে জিনা অবৈধ সঙ্গম নারীর জন্যে মারাত্মক অপরাধ। নারী এক জিনা করতে পারে না, কিন্তু এ-অপরাধের জন্যে দণ্ডিত হয় শুধু নারী। পুরুষটি সাধারণত মুক্তি পেয়ে যায়, কারণ সে নিজের শরীরে জিনার কোনো চিহ্ন রাখে না; কিন্তু নারীটি পায় কঠোর দণ্ড, কারণ নারী জিনার প্রমাণ অনেক সময় অবৈধ সন্তানরূপে ধারণ করে গর্ভে। পাকিস্তানে সাফিয়া বিবির ঘটনা মৌলবাদী পুরুষতন্ত্রের অন্ধ নির্বিবেক নারীপীড়নের এক ভয়ঙ্কর উদাহরণ। সাফিয়া, আঠারো বছরের অন্ধ চাষীকন্যা, দাসীর কাজ করছিলো জমিদার বাড়িতে। তাকে প্রথম ধর্ষণ করে জমিদারপুত্র, তারপর জমিদার নিজেই। সফিয়া এর ফলে জন্ম দেয় এক অবৈধ সন্তান। সাফিয়ার বাবা তাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনে, কিন্তু শরিয়া আইনের বিধি অনুসারে পুরুষ দুটি মুক্তি পায়, ধরা পড়ে নারীটি তার গর্ভই প্রমাণ করে সে অপরাধী, সে ইসলামি আইন অমান্য করেছে। শরিয়া বিচারক ওই অন্ধ ধৰ্ষিত নারীটিকে ব্যভিচারের অপরাধে দণ্ডিত করে প্রকাশ্যে ১৫টি বেত্ৰাঘাত, ৩ বছর কারাদণ্ড, ও ১০০০ টাকা জরিমানায় মমতাজ ও শহীদ (১৯৮৯, ৫১-৫২)। এ হচ্ছে মৌলবাদীর শরিয়াপ্রয়োগ। ইরানে নারী এখন নৃশংস পুরুষতন্ত্রের শিকার; এক সময়ের মুক্ত ইরানি নারী এখন বোরখার ভেতরে ঢুকে প্রশংসা করতে পারে শুধু আল্লা, মেহেদি ও আয়াতুল্লার।
ইসলামে নারী ফিৎনা বা বিশৃঙ্খলা, যে তার কাম দিয়ে বিপর্যস্ত করে সমাজ, তাই তাকে অবরুদ্ধ ক’রে রাখতে হবে অবরোধে। ফাতিমা মেরনিসসির (১৯৭৫, ৩৪) মতে নারীপুরুষ সম্পর্ক ইসলামি সমাজে রয়েছে দুটি তত্ত্ব, একটি স্পষ্ট, আরেকটি অন্তর্নিহিত : স্পষ্ট তত্ত্বটি হচ্ছে পুরুষ সক্রিয়, আক্রমণাত্মক; নারী অক্রিয়, মর্ষকামী; অন্তর্নিহিত তত্ত্বটি হচ্ছে নারীর কাম অসীম। অন্তর্নিহিত তত্ত্বটির চূড়ান্ত রূপ মেলে। গাজ্জালির ইহয়া উলুম আল-দিন বা ধর্মতত্ত্বের পুনরুজ্জীবন-এ। তাঁর মতে সভ্যতা নিরন্তর সংগ্ৰাম ক’রে চলছে নারীর সর্বগ্রাসী সর্বনাশী শক্তির সাথে তাই পুরুষ যাতে অবিচলিতভাবে সামাজিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করতে পারে, সেজন্যে দরকার নারীকে নিয়ন্ত্রণ করা। সমাজ টিকে থাকতে পারে এমন সব সংস্থা তৈরি করে, যেগুলোর কাজ নারীকে অবরুদ্ধ ও পুরুষের বহুবিবাহের ব্যবস্থা ক’রে পুরুষাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। নারীপুরুষ সম্পর্কে ইসলামি স্পষ্ট তত্ত্বটি হচ্ছে পুরুষ নারীর থেকে শ্রেষ্ঠ; পুরুষের প্রবণতা জয়লাভ ও আধিপত্য করা; নারীর প্রবণতা পরাভূত, অধীনস্থ হওয়া। ইসলামি মৌলবাদীর মধ্যে এ-দুটি বিশ্বাসই কাজ করে; সে নারীকে যেমন ভয় পায়, নারীর মুখোমুখি। যেমন অসহায় বোধ করে, তেমনই তাকে অবরুদ্ধ, পর্যুদস্ত ক’রে রাখতে চায়। শুধু ইসলামি মৌলবাদী নয়, সব মৌলবাদীর স্বপ্নই এক : নারীকে পর্যুদস্ত করা। হিন্দু মৌলবাদী নারীকে মনুসংহিতানুসারে আবদ্ধ ও দগ্ধ করতে চায়; খ্রিস্টান মৌলবাদী নারীর ওপর চাপাতে চায় মানুষের সমস্ত পাপের ভার।