প্রথাগত সমাজের আরেক রোগের নাম সুগৃহিণী। সুগৃহিণী হচ্ছে সে-নারী, যার জীবন নানা নিরর্থক কাজে ভারাক্রান্ত: যে একই কাজ বারবার করে, যার কাজ কখনো শেষ হয় না, যার জীবন হচ্ছে একই দিনের আমৃত্যু একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি। এক সময় গৃহিণীর ওপর চাপিয়ে দেয়া হতো সংসারের সমস্ত কাজ, এখন দরিদ্র নারীদের ওপরও ততোটা কাজের ভার নেই। সুগৃহিণীর সারাটি জীবনই অপব্যয়, এবং এক সময় তা হয়ে ওঠে। ক্লান্তিকর, নিঃসঙ্গ, নিজীব। এক বালিকার যদি বিয়ে হয় আঠারো বছর বয়সে, বাইশ বছর বয়সের মধ্যে সে যদি দুটি সন্তান প্রসব ক’রে মুক্তি নেয়। গৰ্ভধারণ থেকে, তাহলে চৌত্ৰিশ বছর বয়সে সে দেখবে তার সন্তান দুটি নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, স্বামী ব্যস্ত উন্নতি ও অন্য নারী নিয়ে, শুধু তারই হাতে কোনো কাজে নেই। সে যদি আরো ত্ৰিশ বছর বাঁচে, তাহলে ওই ত্ৰিশ বছর তাকে কাটাতে হবে অসীম ক্লান্তির মধ্যে। তখন তার পক্ষে অসম্ভব মানসিক রোগগ্ৰস্ত না হওয়া। তার জীবনের কোনো লক্ষ্য নেই, তার কোনো সত্তা নেই। এমনকি তার যৌন জীবনও তখন বিপন্ন। নারীকে ছেড়ে দিতে হবে গৃহিণীর ভাবমূর্তি যদি সে জীবনকে ক’বে তুলতে চায় তাৎপর্যপূর্ণ। এর মানে এ নয় যে সে স্বামীকে তালাক ও সন্তানদের ছেড়ে দিয়ে একলা জীবন শুরু করবে। এ-মুহূর্তেই জরুরি হচ্ছে নারীকে একটি পেশা নিতেই হবে, আর সে-পেশাটি কিছুতেই সংসার হবে না।
দরিদ্র দেশগুলো যেমন দরিদ্র, তেমনই প্রথাগত্ব। অধিকাংশ দেশে নারীর পেশা গ্রহণের সুযোগ নেই। বাঙলাদেশ এমন এক দেশ। শিক্ষিত নারীদেরই এখানে পেশা গ্রহণের সুযোগ কম, দরিদ্র নারীদের সুযোগ আরো অনেক কম; তবু এখানে দরিদ্র নারীরাই জীবিকার জন্যে পেশা গ্রহণ করে বেশি। তা গৃহপরিচারিকার পেশা হ’তে পারে, হতে পারে ছাইআলির পেশা, বা ইটভাঙানির, বা বস্ত্ৰবালিকার পেশা। কোনো পেশাই নারীর জন্যে অস্বাভাবিক নয;–পুরুষ যে-সব পেশা দখল ক’রে আছে, তার প্রতিটির জন্যেই নারী উপযুক্ত; এমনকি শারীরিক শ্রমের পেশায়ও। নারীর শারীরিক অশক্তি অনেকটা পুরুষতন্ত্রেরই সৃষ্টি: পুরুষ তার কাছে চেয়েছে অশক্তি, তাই নারী অশক্ত দুর্বল হওয়াকেই নিজের গুণ ব’লে মনে করেছে। নারীর পক্ষে হাল চাষ, মাছ ধরা, নীেকো বাওয়া কঠিন কাজ নয়; তবে নারী সাধারণত এসব করে না, কেননা সমাজ নারীকে তা করতে দেয় না! এক সময় নারীর জন্যে সমস্ত পেশাই নিষিদ্ধ ছিলো, আজ নিষিদ্ধ অধিকাংশ পেশা, যার ফলে রক্ষা পাচ্ছে পুরুষের প্রাধান্য। বাঙলায় নারীশিক্ষা এগিয়েছে অজস্র প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে, কিন্তু পুরুষতন্ত্র তা ব্যৰ্থ ক’রে দিতে কোনো আয়োজন বাকি রাখে নি। নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে বড়ো চক্রান্ত নারীর শিক্ষা নিষিদ্ধ করা নয়, সবচেয়ে বড়ো চক্রান্ত হচ্ছে শিক্ষিত নারীকে নিষ্ক্রিয় ক’রে দিযে তাকে নিজের, পরিবার, ও সমাজের কাছে বোঝা ক’রে তোলা } এটা করা হয়েছে শিক্ষা ও পেশার থেকে বিয়েকে নারীর জন্যে প্রধান ক’রে রেখে। শিক্ষা যদি নারীকে আর্থনীতিকভাবে স্বাবলম্বী করে, তখন বিয়ে হয়ে ওঠে। ঐচ্ছিক ব্যাপার; নারী তার শারীরিক বা মানসিক প্রয়োজনে বিয়ে করতে পারে, না : করতে পারে। করা না-করা তার নিজের পছন্দ; কিন্তু শিক্ষিত নারীকেও পুরুষের ওপর আর্থনীতিকভাবে নির্ভরশীল ক’রে ব্যৰ্থ ক’রে দেয়া হয়েছে শিক্ষাকে; সফল ক’রে রাখা হয়েছে বিয়ে ও সংসারকে।
নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে এখন চলছে সুগভীর সুপরিকল্পিত চক্রান্ত। বাঙালি মুসলমান সমাজে কয়েক দশকের নারীশিক্ষা নারীকে পরিণত করেছে। পুরুষের শিক্ষিত প্রমোদসহচরী, শিক্ষিত পরিচারিকায়, অর্থাৎ নারীশিক্ষা উপকারে এসেছে পুরুষের, নারীর নয়। এক সময় নারীশিক্ষার যে-যৌনাবেদন ছিলো, বর্তমানের প্রতিক্রিয়াশীলতার পর্বে নারীশিক্ষা সে-আবেদনও হারিয়ে ফেলছে; শিক্ষিত স্ত্রী আর তরুণদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে না। শিক্ষিত তরুণেরা এখন আকর্ষণ বোধ করছে অল্পশিক্ষিত কচি কিশোরীদের প্রতি, প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষিত নারীর সাথে বসবাসের প্রাপ্তবয়স্কতা হারিয়ে ফেলছে তরুণেরা। এর ফলে নারীর প্রথাগত পেশাটি নষ্ট হচ্ছে, তার সংসারের সম্ভাবনা কমছে; আবার সে যে আর্থনীতিকভাবে স্বাধীন জীবন যাপন করবে, তার সুযোগও নেই। রাষ্ট্র পুরুষদেরই কোনো পেশা দিতে পারছে না, নারীকে কোনো পেশা দেয়ার কথা তার জন্যে দুঃস্বপ্ন। এর ফলে নারীর উচ্চশিক্ষা শুধু ব্যর্থই হচ্ছে না, তা পরিহাস ও পরিহারের বিষয় হয়ে উঠছে। প্ৰবেশিকা পাশের আগে থেকেই মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্যে উদগ্রীব হয়ে পড়ছে পিতামাতা, এমনকি প্রগতিশীলেরাও নিজেদের কন্যাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার আগেই বিয়ে দিয়ে পিতৃতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করছেন। উচ্চশিক্ষিত নারীরা হয়ে উঠছেন সমাজের কৌতুক, করুণা, ও নিজের জন্যে বোঝা। এভাবেই চলছে নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রিক-সামাজিক চক্রান্ত।
পিতৃতান্ত্রিক সতীত্বের ধারণা রখনো প্রবলভাবে রক্ষা ক’রে চলছে তার মধ্যযুগীয় চরিত্র। সব পিতৃতন্ত্রেই সতীত্ব নারীর জন্যে প্রথম বিধান, সতীত্বই নারীত্ব; কিন্তু পুরুষের জন্যে সততা বা কমনিষ্ঠা গৌণ ব্যাপার। পৃথিবী জুড়েই পুরুষের বিবাহপূর্ব ও