এক শ্রেণীর শিক্ষিত নারীই সহযোগিতা ক’রে চলছে। পুরুষাধিপত্য ও নারী-অধীনতা রক্ষায়; ওই নারীরা পরগাছা, তারা আজো সুখ পায় সুখকর ক্রীতদাসীত্বে। নারীর প্রধান শত্ৰু শিক্ষিত গৃহিণীরা, যারা শিক্ষিত কিন্তু শুধুই গৃহিণী। ওই নারীরা শুধুই মাংস, তারা পুরুয্যের প্রমোদসঙ্গিনী, স্বামীর প্রমোদবালা; তারা বেছে নিয়েছে অধীনতা। তারা অনেক বেশি অসহায় শ্রমিক নারীর থেকেও, শ্রমিক নারী যে-স্বাধীনতা ভোগ করে তারা তাও ভোগ করে না, এবং স্বামী তাদের ছেড়ে দিলে পথনারী হওয়া ছাড়া আর কোনো যোগ্যতা তাদের থাকে না। তারা এটা জানে, তাই নিজেদের স্বার্থে সেবা ক’রে চলে পুরুষতন্ত্রের; তাবা সুবিধার বিনিময়ে বাতিল ক’রে দেয় নিজেদের সত্তা ও স্বাধীনতা। শুধু নিজেদের নয়, তারা শত্ৰুতা৷ ক’রে চলে স্বাধীন নারীর সাথে, নিজের স্বাধীনতা হারানোর পর অন্যের স্বাধীনতা নষ্ট করা হয় তাদের কাজ। শিক্ষিত ধনী গৃহিণীরা যে-সচ্ছলতার মধ্যে থাকে শিক্ষিত কর্মজীবী নারীরা সাধারণত ততোটা সচ্ছলতায় থাকে না; তারা বিচিত্র বিলাসের মধ্যে থেকে উপহাস করে চলে কর্মজীবী শিক্ষিত নারীদের। তাদের কৃতিত্ব তারা ধনী স্বামী ধরতে পেরেছে। একটি শিক্ষিত নারী যখন দেখে সে কাজ করে, কিন্তু ওই বিলাস নেই তার জীবনে, তখন তার মনে এমন বোধ জন্ম নেয়া স্বাভাবিক যে শিক্ষিত না হয়ে বা পেশা গ্ৰহণ না করে একটি ধনী স্বামী ধরাই ছিলো অনেক ভালো। এ-বোধটা আরো প্রবল হয়ে উঠতে পারে। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে;–কোনো বালিকা যখন দেখে তার মায়ের মতো পেশা গ্ৰহণ করে কষ্ট করার চেয়ে পাশের বাড়ির মহিলাটির মতো একটা ধনী স্বামী ধরলে জীবন অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে, তখন সে স্বাধীন হওয়ার ইচ্ছে ছেড়ে দিতে পারে। এমন ঘটছে এখন বাঙলাদেশে। পরগাছারা এখন এতো আকর্ষণীয় যে অনেক বালিকাই নিজের শেকড় গভীরে ছড়ানোর অভিলাষ ছেড়ে দিয়ে সোনালি পরগাছা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। পরগাছারা ওই বিলাস কেনে নিজেদের সত্তার বিনিময়ে, তারা সুস্বাদু মাংসের থেকে বেশি মূল্য পায় না।
বিয়ে ও সংসার আজো নারীর জন্যে প্রধান পেশা হয়ে আছে, প্রতিক্রিয়াশীলতা যেভাবে প্রবল হচ্ছে তাতে অচিরেই তা আবার একমাত্র পেশা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। সমাজ নারীকে আজো হ’তে বলে সুগৃহিণী ও সুমাতা, তার কাছে দাবি করে সতীত্ব ও পাতিব্ৰত্য! সমাজ পুরুষকে দেয় বাস্তব শর্ত, অর্থাৎ পুরুষের কাজ সংসার চালানো: নারীকে দেয় নৈতিক শর্ত, তাকে হতে হবে সুমাতা, সুগৃহিণী, সতী। নারীর সুমাতা, সুগৃহিণীত্বকে ঐশী ভাবাদর্শে পরিণত করা হয়েছে নারীকে পুরুষাধীন রাখার জন্যে। মা হওয়ার অর্থ গর্ভধারণ, তবে সুমাতার অর্থ নারী গর্ভধারণ করবে: সমাজসম্মতভাবে, সমাজের জন্যে, নিজের জন্যে নয়; শঙ্ধারণ করবে নারী বিবাহিত হয়ে, বিবাহিত না হয়ে নারী সন্তান চাইতে পারবে না। এর অর্থ তার শরীর, তার জরায়ু তার নয়, তার মালিক পুরুষ ও পিতৃতন্ত্র। পুরুষ এসব বিধি প্রচার করেছে বিধাতার নামে, তবে এসব হচ্ছে বিশেষ এক ধরনের সমাজ সংরক্ষণের বিধিনিষেধ। নারীর গৰ্ভধারণ একান্ত পাশবিক কাজ! নারীকে কি চিরকালই ধারণ ক’রে যেতে হবে গর্ভ, পালন ক’রে যেতে হবে পশুর ভূমিকা? গৰ্ভবতী নারী দেখতে অনেকটা গর্ভবতী পশুরই মতো, দৃশ্য হিশেবে গর্ভবতী নারী শোভন নয়, আর গর্ভধারণ নারীর জন্যে অত্যন্ত পীড়াদায়ক। এক দিন হয়তো গৰ্ভধারণ গণ্য হবে আদিম ব্যাপার ব’লে, মানুষ বেছে নেবে সন্তানসৃষ্টির বিকল্প উপায়; তখন গর্ভধারণই নারীত্ব বলে মনে হবে না। নারী গর্ভধারণে আনন্দ পায় না। পুরুষতন্ত্রের শিক্ষার ফলে নারী আজো মনে করে গর্ভধারণেই তার জীবনের সার্থকতা, কিন্তু এটা তা নয়। অধিকাংশ নারী এখনই গৰ্ভধারণপ্রক্রিয়া থেকে রক্ষা থেলে আনন্দে তা গ্ৰহণ করবে; গর্ভবতী হওয়ার মধ্যে জীবনের কোনো সার্থকতা, মহত্ত্ব, পুণ্য নেই। এক সময় নিয়ত গর্ভিণী থাকাই ছিলো নারীর কাজ, এখন গর্ভের সংখ্যা কমেছে, তাতে ক্ষতি হয় নি, বরং সমাজরাষ্ট্র এই চায়। আমূল নারীবাদীরা মনে করেন মানবপ্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নারীর নয়, পুরুষকে উদ্ভাবন করতে হবে সন্তানসৃষ্টির বিকল্প পথ; এবং কয়েক শো বছর পর গৰ্ভধারণ যে আদিম পাশবিক কাজ ব’লে গণ্য হবে তাতে সন্দেহ নেই।
সুমাতার ভুল ধারণাও আজো প্রবল সমাজে। উনিশশতকে মনে করা হতো যে সুমাতার কাজ মহাপুরুষ জন্ম দেয়া ও লালনপালন করা। পুরুষতন্ত্রের মহাপুরুষেরা’ নারীর কাছে বারবাব সুমাতা দাবি করেছে, সমাজকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে নারী যদি তাদের সুমাতা দেয়, তবে তারা দেশকে উন্নতির চুড়োয় পৌঁছে দেবে। এর অর্থ নারী নষ্ট হযে গেছে, তার জবায়ুর অপরাধেই মহাপুরুষেরা সম্পন্ন করতে পারছে না দেশের উন্নতি; অর্থাৎ যে-অপরাধ তাদের, তারা তা চাপিয়ে দিয়েছে নারীর ওপর। উনিশ শতক নারীর কাছে দাবি করে দলে দলে নেপোলিয়ন, জর্জ ওয়াশিংটন বিয়োনো; কিন্তু কারো পক্ষে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ওয়াশিংটন বা আইনস্টাইন বা রবীন্দ্রনাথ বা একটি একনায়ক জন্ম দেয়া সম্ভব নয়। আর যে-মায়ের এ-ধরনের মহাপুরুষ জন্ম দিয়েছেন, তারা যে সুমাতা ছিলেন, তাও নয়। রবীন্দ্রনাথের মা তো রবীন্দ্রনাথকে লালনপালনই করেন নি, ওই মহাকবি পালিত হয়েছেন ভৃত্যদের দ্বারা। এটা প্রমাণ করে যে মহাপুরুষ লালনের জন্যে কোনো সুমাতা’ দরকার করে না; এবং কোনো মায়ের পক্ষে লালনপালন ক’রে মহাপুরুষ তৈরি করা সম্ভব নয়। লালনপালনের ওপর মানুষের বিকাশ খুব নির্ভর করে না। সুমাতা বলতে সমাজ বোঝায় এমন মা, যে এমনভাবে চালাবে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া, যার ফলে তার সন্তানরা মেনে নেবে সমাজের সমস্ত বিধিনিষেধ, এবং রোধ করবে সমাজের বিবর্তন। সুমাতার সন্তানরা পৃথিবীকে বদলায় না, তারা পৃথিবীকে অচল ক’রে রাখে। শিশু অবশ্যই মায়ের এবং পিতার কাছে থেকে স্নেহপ্ৰীতি ও অনেক কিছু পাবে, এটা তাদের অধিকার; কিন্তু প্রথাগত সুমাতা দরকার শুধু প্রথাগত সমাজ রক্ষার জন্যে।