পুরুষ কুমারীকে ভয় পায়, তবে কামনাই করে বেশি। পুরুষ কুমারী কামনা করে, চায় কোমল কুমারী দেহলতা। কুমারীর তনু পুরুষের কাছে অনাবাদী জমি, ঘুমের দেশ, অনাঘ্রাত গোলাপ। ওই দেহে আছে গোপন ঝরনার জলের স্বাদ, ওই উদ্যানে পত্রপুটে ঢাকা অনাঘ্রাত দুটি পুজোর ফুল। পুরুষ তীব্র আকর্ষণ বোধ করে গোপন উদ্যান, মন্দির, ও নানা রকমের রুদ্ধ ও ছায়াসুনিবিড় এলাকার প্রতি: তার প্রতি পুরুষের আকর্ষণ, যার এখনো ঘুম ভঙে নি। পুরুষ রুদ্ধগৃহ খুলতে চায়, ঢুকতে চায় ওই গৃহে; পুরুষ তার ঘুম ভাঙাতে ও তাকে প্ৰাণ দিতে চায়; চায় তাকে অধিকার ও খনন করতে। পুরুষের রয়েছে ধ্বংসাত্মক প্রবণতা। সতীচ্ছদ ছিন্ন ক’রে পুরুষ নারীকে পায় অন্তরঙ্গতমভাবে; লোকশ্রুত পদটি ছিড়ে পুরুষ নারীর দেহটিকে পরিণত করে অক্রিয় বস্তুতে ও তার ওপর ওড়ায় নিজের পতাকা, স্থাপন করে সাম্রাজ্য। পুরুষ অবশ্য নারীর কুমারীত্বের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে যতোদিন নারীর যৌবন থাকে, তারপর কুমারীত্ব তার কাছে হয়ে ওঠে পীড়াদায়ক ভীতিকর। যে-নারীর শরীরে কোনো পুরুষ প্রবেশ করে নি, সে যখন আইবুড়ো হয় তখন পুরুষ তাকে মনে করে ডাইনি, অভিচারিণী। অনেকে বিশ্বাস করে আইবুড়ো অক্ষত মেয়েরা সহবাস করে শয়তানের সাথে। যেহেতু ওই নারী পুরুষের কাছে দেহ সমৰ্পণ করে নি, পুরুষের বশ্যতা স্বীকার করে নি, তাই পুরুষের চোখে সে শয়তানী। পুরুষের কাছে পোষ-না-মানা, বিদ্রোহী, নারীমাত্রই দানবী বা ডাইনি; কেননা সে পুরুষের সূত্র ও অনুশাসন মেনে নেয় নি। পুরুষ বিশ্বাস করে এ-দানবীরা এতো অশুভ যে ঘুমের মধ্যেও তারা পুরুষের শরীর নিয়ন্ত্রণ করে, যেমন স্বপদোষে। আমাদের দেশে এমন বিশ্বাস রয়েছে যে স্বপ্নে পুরুষকে প্রলুব্ধ করে ফোনো অভিচারিণী নারী, তাই ঘটে নৈশস্থলন; এবং হানি ঘটে স্বাস্থ্যের। ইহুদিপুরাণের লিলিথ এমন এক দানবী। রুডউইন লিলিথ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘লিলিথের করাল প্রভাব শুধু শিশুদের ওপরেই পড়ে না। সে আরো ভয়াবহ পুরুষের জন্যে, বিশেষ ক’রে তরুণদের জন্যে। লিলিথ পুরুষসম্মোহনকারিণী। লিলিথ হচ্ছে রূপসী ব্যভিচারিণী অবিবাহিতা বেশ্যার সেমেটীয় নাম, যে হাটেমাঠেঘাটে পুরুষদের সম্ভোগ করে’ [দ্র প্রাৎস (১৯৩৩, ২৮২);। ডাইনিদের বীভৎস ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে উপকথা রয়েছে সব জাতির ভাণ্ডারেই; এবং সব জাতির ডাইনিদেরই রয়েছে কতকগুলো সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ডাইনিদের মূল বৈশিষ্ট্য তারা কামার্ত পুরুষখেকো; তারা সম্ভোগের মধ্য দিয়ে পুরুষদে্র পরিণত করে নিজেদের খাদ্যে। তারা সঙ্গম করে শয়তানের সাথে, শয়তান পানিপাত্ৰ ভ’রে পান করে তাদের ক্ষরিত ৱক্ত। এদিকে ম্যালিনোস্কির ট্রোব্রিয়ান্ড দ্বীপপুঞ্জের বর্বরদের সাথে কোনো পার্থক্য নেই সভ্য ইউরোপীয় বা ভারতীয়দের। বর্বরদের কল্পনায় ডাইনিরা বেরোয় রাতে, নিজেদের রূপান্তরিত করে জোনাকি বা উড়ন্ত শেয়ালে, শব খায়, ও শয়তানের সাথে রমণ করে। ইউরোপে কয়েক শতক ধ’রে চলেছিলো ডাইনিশিকার; ওই হিংস্র শিকারীদের দুজন, জ্যাকব স্প্রেংগার ও হেনরি ক্র্যামার, একটি বই লিখেছিলেন ডাইনিদের হাতুড়ি নামে পনেরোশতকের শেষাংশে। তাঁরা লিখেছিলেন, ‘সব রকম ডাকিনীবিদ্যার মূলে রয়েছে কামক্ষুধা, নারীরা যাতে তৃপ্তিহীন। তিনটি জিনিশ রয়েছে যাদের ক্ষুধার শেষ নেই; না, আছে চতুর্থ একটি, যেটি কখনো বলে না, যথেষ্ট হয়েছে; সেটি হচ্ছে জরায়ুর মুখ। তাই নারীরা নিজেদের কামতৃপ্তির জন্যে এমনকি শয়তানের সাথেও সঙ্গমরত হয়’ [দ্র নেলসন (১৯৭৫, ৩৩৯)]। ডাইনি নাম দিয়ে ১৪০০ থেকে ১৭০০ অব্দের মধ্যে ইউরোপে পাঁচ লাখ নিরপরাধ নারীকে পুড়িয়ে মারে ঈশ্বরের পুরাহিতেরা। ওই নারীরা ডাইনি ছিলো না, তাদের অধিকাংশ নারী কেনো কোনো পুরুষের সাথেও সঙ্গমের সুযোগ পায় নি। তারা ছিলো কর্মজীবী নারী, যারা আর্থনীতিক কারণেই সমাজের প্রথাগত বিধি অমান্য করতে বাধ্য হয়েছিলো। তারা ছিলো অবিবাহিত; পুরুষ ও অর্থের অভাবে তারা বিয়ে করতে পারে নি, তারা নিয়েছিলো নানা পেশা জীবনধারণের জন্যে। অৰ্থাৎ তারা অমান্য করেছিলো সামাজিক ও ধর্মীয় বিধি: তারা ছিলো বিদ্রোহী, তাই তারা পুরুষের চোখে হয়েছিলো ডাইনি; এবং আগুনে ছাই হয়ে গিয়েছিলো। আজো যে-নারী সামাজিক বিধি অমান্য করে, পুরুষকে পাত্তা দেয় না, যাপন করে স্বায়ত্তশাসিত জীবন, তাকে মনে করা হয় আধুনিক ডাইনি বা দানবী। ডাইনির ভয়ে আধুনিক সভ্যতার হৃৎপিণ্ডও কম্পমান।
নারীকে অভিচারিণী বা ডাইনিরূপে দেখা হচ্ছে আবহমান কাল ধ’রে, আজো দেখা হয় সেভাবেই। যেনো তার কাজ ইন্দ্ৰজাল ছড়িয়ে পুরুষকে মেষ বানানো। নারী যাদুকর। যাদুকর ভয়ানক মানুষ, সে কাজ করে দেবতা ও রীতির বিরুদ্ধে, নিজের স্বার্থে। নারী সমাজের সাথে জড়িয়ে গেছে, কিন্তু পুরুষের মনে ভয় রয়ে গেছে যে নারী তাকে যে-কোনো সময় নিজের যাদুতে মজাবে। পাশের বাসার মেয়েটিকেও মনে হয় অভিচারিণী, যে চোখের পলকে সুবোধ ছেলেটিকে নির্বোধ মেষে পরিণত করতে পারে। তার চোখে ইন্দ্রজাল, ঠোঁটে যাদু, আঙুলে রহস্য, শরীরের বাঁকে বাঁকে ফাঁদ। পশ্চিমি পুরাণে পাওয়া যায় অনেক অভিচারিণী। যেমন সাইরেন। নারী হচ্ছে সাইরেন, যার গানে মুগ্ধ নাবিকেরা জাহাজসহ আছড়ে পড়ে পাথরের ওপর; নারী হচ্ছে কির্কি, যে তার প্রেমিকদের রূপান্তরিত করে পশুতে। পুরুষ তার যাদুপাশে জড়িয়ে হারায় নিজেকে, নিজের বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে। নারী পুরুষকে পান করায় বিস্মৃতির পানীয়। ফ্রয়েড ‘সভ্যতা ও তার অতৃপ্তি’তে এ-কুসংস্কারকেই বিজ্ঞানের মুখোশ পরিয়ে দেখিয়েছেন নারী শুধু পুরুষ নয়, সভ্যতারই শত্রু। এ-দানবীর কাজ সভ্যতাকে বিচলিত করা। খ্রিস্টান ধর্মে যৌনতাকে ভয়ের চোখে দেখা হয়, কারণ তারা নারীকে দেখে দানবীরূপে। ওই ধর্মে বিচ্ছিন্ন ক’রে নেয়া হয়েছে দেহ থেকে আত্মাকে; এবং শরীরকে করে তোলা হয়ছে আত্মার শত্ৰু। ওই বিশ্বাসে শরীরের সাথে সমস্ত সম্পর্কই পাপ ও অশুভ। খ্রিস্টানের কাছে দেহ আর মাংস পাপ; তবে পুরুষের দেহ পাপ নয়, নারীর দেহই পাপ। খ্রিস্টানের চোখে নারীর শরীর প্রলোভনের সোনার কলস, তার দেহ শয়তান। নারীই পাপের পথে নিয়ে গেছে আদমকে; তাই খ্রিস্টান সাহিত্য নারীঘৃণায় ও তিরষ্কারে মুখর। তারতুলিয়ানের চোখে নারী ‘পয়ঃপ্ৰণালির ওপর নির্মিত প্রাসাদ’ ; অগাষ্টিন বলেছেন, ‘আমাদের জন্ম হয়েছে মলমূত্র থেকে’ [ দ্র দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ২১৯-২২০)]। খ্রিস্টানের চোখে নারীর শরীর এতোই পাপীয়সী যে তারা ক্রাইস্টকে জন্ম দিয়েছে কুমারীর গর্ভ থেকে। ওই ধর্মের অনেক সন্তের মতে মেরি নারীদের মতো স্বাভাবিক রীতিতে জন্ম দেয় নি। ক্রাইস্টকে; অ্যামব্রোস, অগাস্টিনের মতে মেরির রুদ্ধ দেহ থেকেই জন্ম হয়েছিলো জেসাসের। খ্রিস্টানের কাছে নারীর দেহ কলঙ্ক, কাম হচ্ছে পাপ; তাই তারা দেহ ও কামের নিন্দায় মুখর থেকেছে, এবং উদ্ভাবন করেছে নিরন্তর নতুন নতুন শাস্তি। তারা পবিত্র মেরির দেহ থেকে নিঃশেষে বের ক’রে দিয়েছে অপবিত্ৰ কামকে তাকে পরিণত করেছে এক কামশূন্য বিদেহী নারীতে বা বিমূর্ত যন্ত্রে।