পৃথিবী জুড়ে আগের থেকে নারীর অবস্থা কিছুটা ভালো, অবশ্য খারাপও হয়েছে অনেক দেশে : ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ও কযেকটি মুসলমান রাষ্ট্রে দু-তিন দশক আগের থেকে অনেক শোচনীয় এখন নারীর অবস্থা। তবে অধিকাংশ দেশে আগের থেকে কিছুটা ভালো আছে নারী, কিন্তু বেশি ভালো নেই; এখন এমন সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন মহাদেশে যে শিগগিরই নারীর অবস্থা হবে খুবই খারাপ। নারী এখন কয়েকটি মুসলমান দেশ ছাড়া এক ঘর থেকে বেরোতে, ভোট দিতে, শিক্ষা লাভ করতে, কিছু পেশায় জড়িত হতে পারে, এবং কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করে। শোনা যায় পৃথিবীর খুব উন্নতি ঘটেছে, ঘাঁটি চলছে দ্রুত পরিবর্তন; কিন্তু ওই উন্নতি আর পরিবর্তন যতোটা কিংবদন্তি ততোটা বাস্তব নয়। গত আড়াই শো বছরের বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের ফলে পৃথিবীর ঘটেছে নানা বাহ্যিক পরিবর্তন; মানুষ চাঁদে গেছে, ঘরে বসে আজ সারা পৃথিবী দেখা যায়, টেস্টটিউবে উৎপাদিত হচ্ছে শিশু, কিন্তু নারীকে এখনোও রেখে দেয়া হয়েছে আদিম অবস্থায়ই। সংখ্যাধিক্যবশত পৃথিবী নারীদেরই গ্রহ, কিন্তু তারা রখনো এখানে পরবাসী, পুরুষের শোষণসামগ্ৰী। পুত্বপশ্চিমে মুক্তির স্বাদ পেয়েছে, পুরুষতন্ত্রের কাছ থেকে কিছুটা সুবিধা আদায় ক’বে নিয়েছে কিছু নারী, কিন্তু অধিকাংশ নারীর অবস্থা শোচনীয়। গত দুশো বছরে গৃহপালিত পশুর অবস্থার যতোটা উন্নতি ঘটেছে নারীর অবস্থার ততোটা উন্নতি ঘটে নি। কিছু নারী এখন বিখ্যাত, কিছু নারী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শক্তিধর, কিন্তু তা নারীর অবস্থার সূচক নয়; বিখ্যাত ও শক্তিধর নারীরাও পুরুষাধীন, পুরুষশোষিত; কেননা পৃথিবী পুরুষতান্ত্রিক।
নারীপুরুষের বিশুদ্ধ সাম্য কোথাও এখনো প্রতিষ্ঠিত হয় নি; নারী তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার অধিকার পায় নি, যদিও তার অধিকার আন্দোলনের বয়স দুশো বছর। নারীর সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা ও বিধান তৈরি করছে এখনো পুরুষই, পুরুষই স্থির করছে কী মঙ্গলজনক নারীর জন্যে। শোষণমুক্তির জন্যে শোষিতরা এক সময় স্বপ্ন দেখেছে সমাজতন্ত্রের, কিন্তু সমাজতন্ত্রের সাম্প্রতিক ব্যর্থতা মুক্তির স্বপ্ন দেখার সম্ভাবনাও নষ্ট ক’রে দিয়েছে; এবং যারা মনে করছে সমাজসংগঠন সম্পূর্ণ বদলে দিতে না পারলে মুক্তি আসবে না। নারীর, তারা নারীমুক্তিকে সমর্পণ করছে অনিশ্চিত সময়ের হাতে। আসলে তারা চায় প্রথমে পুরুষের মুক্তি, পরে ভেবে দেখবে নারীর মুক্তি, সাম্য, অধিকার প্রভৃতির কথা। কবে সমাজসংগঠন সম্পূর্ণ বদলাবে, তার জন্যে যদি অপেক্ষা করতে হয় নারীকে, তাহলে হয়তো নারী সম্পূর্ণ ভুলে যাবে নিজের মুক্তির কথা। নারীমুক্তিকে সময়ের হাতে ছেড়ে দেয়া যায় না; সম্পূর্ণ সমাজসংগঠন বদলের অপেক্ষায়ও স্থগিত ক’রে রাখা যায় না। নারীর মুক্তি। আর সমাজসংগঠন বদলালেই যে মুক্তি পাবে নারী, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই; কেননা দেখা গেছে সামজতন্ত্রের মধ্যেও নারী পুরুষের সমান অধিকার পায় নি। তবে সব ধরনের সমাজতন্ত্রই নারীর জন্যে মঙ্গলজনক, যদিও তা-ই যথেষ্ট নয়; নারীমুক্তির জন্যে দরকার সমাজতন্ত্রাতিরিক্ত কিছু: এবং গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদের মধ্যেও অর্জন করা সম্ভব অনেক অধিকার। নারীর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। শুধু ধর্মতান্ত্রিক মৌলবাদের মধ্যে, মৌলবাদ নারীর চরম শত্র। আড়াই শতকের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো পৃথিবীর বাহ্যিক বদল ঘটিয়েছে, আভ্যন্তর বদল বিশেষ ঘটাতে পারে নি; মানব মন ও সমাজের আজো মৌলিক পরিবর্তন ঘটে নি, মৌলিক বদল ঘটানো ওই আবিষ্কারগুলোর লক্ষ্যও নয়। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলোর থেকে আজো মানুষের ওপর বেশি প্রভাবশালী পুরোনো পুরুষাধিপত্যবাদী সংহিতাগুলো, বিজ্ঞানকে ওগুলোকে প্রতিরোধ করার কাজেও ব্যবহার করা হয় নি; বরং বিজ্ঞানকে নতজানু ক’রে রাখা হয়েছে ওই সব পুরোনো কুসংস্কারের কাছে। তাই আধুনিক পৃথিবীও যথেষ্ট আধুনিক নয়; এর ভেতরে আদিমতারই প্রাধান্য। নারী ওই আদিমতারই শিকার। বিজ্ঞান পুরুষতন্ত্রের নিজস্ব জিনিশ, তাই ব্যবহৃত হচ্ছে পুরুষতন্ত্র ও বিশেষ একগোত্র পুরুষের স্বার্থে।
যে-সব ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে টিকিয়ে রাখা হচ্ছে পুরুষাধিপত্য ও নারী-অধীনতা, সেগুলো হচ্ছে পরিবার, বিয়ে, শিক্ষা, পেশা, রাজনীতি, ও ধর্ম। পিতৃতান্ত্রিক সব সংঘ আর ব্যবস্থাই নারীর বিরুদ্ধে। এগুলো প্রথাগত সমাজব্যবস্থা স্থায়ী ক’রে রাখার প্রয়াসে লিপ্ত। পুরুষাধিপত্য টিকিয়ে রাখার ক্ষুদ্রতম প্রতিষ্ঠান পরিবার, বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র রাষ্ট্র কাজ ক’রে চলছে পরিবারের মধ্য দিয়ে, তাই পুরুষতন্ত্র খুবই ব্যাকুল পরিবারসংগঠন অপরিবর্তিত রাখার জন্যে। পরিবারে আজো প্রধান পুরুষ; সমাজ তাকে এ-প্রাধান্য দিয়েছে, এবং এমন ব্যবস্থা করেছে, যাতে রক্ষা পায় তার প্রাধান্য। পুরুষকে দিয়েছে আর্থনীতিক অধিকার; আজো পুরুষই সাধারণত আয় ও সংসার ভরণপোষণ করে, তাই পুরুষই আধিপত্য করে সংসারে। নারী পরিশ্রম করে পুরুষের থেকে অনেক বেশি, তার শ্রম পুরুষের শ্রমের থেকে অনেক বেশি ক্লান্তিকর, কিন্তু তা নিরর্থক। দরিদ্র নারীদেব শ্রমের শেষ নেই, সংসার সচল রাখার পেছনে তাদের শক্তি তারা পুরোপুরি নিয়োগ করে; কিন্তু তাদের সাংসারিক শ্রমের কোনো মূল্য নেই। পৃথিবী জুড়ে এখন প্রধান শ্রমিক শ্রেণী নারী, তারা উৎপাদন করে দেশের অধিকাংশ সম্পদ, কিন্তু তাদের পারিশ্রমিক নূ্যনতম। বাঙলাদেশে এবার বৈদেশিক আয়ের প্রায় সবটাই উপার্জন করেছে নারীরা, বস্ত্ৰবালিকারা; কিন্তু তারা তার ভাগ পায় নি, পরিবারেও তাদের স্থান গৌণ, সমাজে তারা অসম্মানিত ৷ যে-বস্ত্ৰবালিকার আয়ে সংসার চলে, তার স্বামী বা পিতা হয়তো কোনো আয়ই করে না, কিন্তু সেই প্রাধান্য করে পরিবারে ও সমাজে। শিক্ষিত নারীদের বেলা একই ঘটনা ঘটে, তারা তাদের যোগ্যতাব থেকে আয় করে অনেক কম। তাদের, দরিদ্র নারীদের থেকেও, অনেক বেশি নির্ভর করতে হয় স্বামীর আয়ের ওপর; এক নিজের আয়ের ওপর নির্ভর করতে হ’লে অধিকাংশ শিক্ষিত নারীই বস্তিজীবন কাটাতে বাধ্য হতো। শিক্ষা আজো নারীকে আর্থনীতিক স্বনির্ভরতা দেয় নি; কাজে আসে নি নারীমুক্তিতে।