শান্তা দেবীর জীবনপোলা (?১৯৩৮) সচেতনভাবে লেখা হয়েছে নারীমুক্তির বাণী প্রচারের জন্যে, তবে তিনি বিধবার বিয়ের অধিকারকেই গণ্য করেছেন মুক্তি ব’লে। উপন্যাসটি আট বছর বয়সে বিবাহিত বালবিধবা গৌরীর উপাখ্যান। দু-খণ্ডে তিনি কাহিনী বলেছেন : প্রথম খণ্ডে দিয়েছেন বালিকা গীেরীর বিধবাজীবনের দুর্দশার বিবরণ, এবং দ্বিতীয় খণ্ডে বর্ণনা করেছেন ওই জীবন থেকে মুক্তির কাহিনী। প্রথম খণ্ডটির কোনো কোনো অংশ মর্মস্পশী, তবে দ্বিতীয় খণ্ডে তিনি গীেরীকে মুক্ত করার জন্যে যে-কাহিনী তৈরি করেছেন, তা আবেদন জাগায় না। রচনা হিশেবে আলোচিত ছটি উপন্যাসের মধ্যে জীবনদোলাই সবচেয়ে দুর্বল। শান্তা দেবী জীবন উপস্থাপনের থেকে প্রচারে বেশি মন দিয়েছেন বলে লক্ষ্য অর্জনেও তিনি সফল হন নি; তবে তাঁর কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি নারীকে মুক্ত করে ছক থেকে বের করে আনতে চেয়েছেন। শুরু থেকেই তিনি বিয়ে ও পুরুষবিরোধী মনোভাব প্রচার করেছেন; তাঁর অবোধ বালিকা গৌরী বলে, ‘ছাই বর! আমাকে মার কাছ থেকে আবার নিয়ে যাবে!… আমি ধুতি পারব, চুল কেটে ফেলব; মেয়েমানুষ হব না। আমি ঘরে-ঘরে বিয়ে করুব।’ গৌরী যেনো প্রতিশোধ নিতে চায় পুরুষের ওপর। বিয়ের পর গীেরী একবার শ্বশুর বাড়ি গিয়েছিলো : ‘একরাত্রি নয় আট রাত্রি এই অজানা পুরীতে ভয়ে শোকে দুঃখে অনিদ্রায় অৰ্দ্ধানিদ্রায় মাতৃক্রোড়চূতা গৌরীর প্রাণ কাদিয়াছিল, ফেরার পর দু-বছরেও তার মন হইতে শ্বশুরবাড়ীর সে বিভীষিকার ছবি’ মোছে নি। গৌরীর ভাগ্য সে বাড়ীর বড় আদরের মেয়ে’। তার বাবা ‘আট বছরের মেয়েটাকে দান করে পুণ্য সঞ্চয়’ করতে গিয়েছিলো; তার জন্যে যা পুণ্য গৌরীর জন্যে তা হয়ে ওঠে বিনাশ। তার শ্বশুরবাড়ি খবর যায় যে ‘বিধবা মেয়েকে হরিকেশব সধবা বেশে ত রাখিয়াছেনই। তাহার বৈধব্যের খবর পর্য্যন্ত তাহাকে জানিতে দেন নাই।’ এটা গৌরীর শ্বশুরবাড়িতে উত্তেজনা সৃষ্টি করে; এক আশ্ৰিতা বিধবা ব’লেই বসে, ‘তোমার বেয়াই মেয়েকে কলমা পড়াবে, নিকে দেবে।’ নারীর বিরুদ্ধে নারীও কাজ করতে পারে নিপুণ ও নিষ্ঠুরভাবে। গৌরীর বাবা পুরুষ, তবে মানুষ; তাই মেয়ের জীবনকে কিছুটা স্বস্তিকর করে তোলার জন্যে তিনি মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তীর্থভ্রমণে। তার বাবা জানে, ‘তারা পুত্ররা যে পুরুষ। সংসারে তারা লড়তে জন্মেছে, সংসার তাদের লড়বার অধিকারও দিয়েছে। আর এ অসহায় শিশু বালিকা; মেয়ে হ’য়ে জন্মানোই এদেশে তার এক পরম দুৰ্ভাগ্য, তার উপর নূতন একটা দুর্ভাগ্যের বোঝা আজীবনের জন্য তার কচি মাথার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ গৌরী অবশ্য জানে না। সে বিধবা, সে বোঝে না বিধবা কাকে বলে: তবে পিতৃতন্ত্র তাকে এর মাঝেই বিধবার শাস্তি দেয়ার জন্যে ব্যগ্র হয়ে পড়েছে।
শান্তা দেবী গৌরীর বাবামার মনে প্রশ্ন জাগিয়ে দিয়েছেন : ‘সেই তরুণ শৈশবের দেখা অপরিচিতপ্রায় একটি বালকের তিরোধানে তাহার জীবনমুকুল সমাজের চক্ষে চির-অভিশপ্ত হইয়া গিয়াছে?.. কিন্তু অচেনা মানুষের অজানা মৃত্যুতে শিশুকেও যে চির-সন্ন্যাসের বোঝা বহিয়া অপমান ও লাঞ্ছনায় আজীবন কৃত্রিম শোকের অভিনয় করিয়া যাইতে হয়, তাহাকেই ধৰ্ম্ম বলিয়া মানিতে হয়, সে-কথা তাহার এই আদরিণী অভিমানিনী বালিকা কন্যাকে তিনি কি করিয়া বুঝাইবেন?’ গৌরী যখন জানতে পায় যে সে বিধবা, তখন তার অবস্থা : ‘বাঙ্গালীর মেয়ে সে আপনার বঞ্চিত জীবনের কথা যতটুকু বুঝিল তাহাতেই নিরানন্দের স্নান ছায়ায় তাহার ফুলের মত মুখখানি অন্ধকার হইয়া গেল। অজানা সেই মানুষের মৃত্যু তাহার কাছে যতই অর্থহীন হোক পৃথিবীর কাছে তাহার বহু অধিকার যে সেই মানুষটিই হরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে হিন্দুর মেয়ের মনে সেকথা ধরা পড়িলই।’ শান্তা দেবী চিরস্বামীত্বের ধারণাটিকে স্পষ্টভাবেই বাদ দিয়েছেন। এমনকি গৌরীর প্রথাগত মায়ের মনেও হিন্দুবিবাহের বিধান সম্পর্কে সন্দেহ জাগিয়ে তুলেছেন : ‘তরঙ্গিনীর স্বামীর কথা মনে পড়িল, ‘আবাবা যদি ওর বিয়ে হয়।’ এমন পাপ কথা মনে আনিতে তাঁহার যতখানি ঘৃণা যতখানি লজ্জা হওয়া উচিত ছিল, তিনি আশ্চৰ্য্য হইয়া দেখিলেন কই সে লজ্জা, সে ঘূৰ্ণ৷ ত তাহার মনে আসিল না।’ শান্তা দেবী পুত্র ও কন্যার জীবনের দুই মেরুরূপের চিত্রও এঁকেছেন : ‘এই ত্যাণ সমাজ তাহার নিকট জোর করিয়া আজীবন নিষ্ঠুর মহাজনের মত আদায় করিবে; তাহার। পাচ ভাই যখন পিতার ঐশ্বৰ্য্যে ভোগ বিলাসে মাতিয়া থাকিবে তখন এই সকলের ছোট বোনটি বঞ্চিত জীবনের বোঝা বহিয়া বিস্মৃত স্বামীর প্রতি প্রেম ও ভক্তি নিবেদন করিবে।’ গৌরী বোঝে না যে সে বিধবা, কিন্তু তার মুখে শান্তা এমন কথা দিয়েছেন, যেমন, ‘আমার মেয়েকে আমি কখখনো বিয়ে দেব না। বাবা, শেষকালে যদি বিধবা হ’য়ে যায়৷’ বা ‘বিধবা হাতে আমার ভাল লাগে না। কেন মা, আমি বাইরের লোকের জন্যে বিধবা হব?’, যা তুলে ধরেছে পিত্তান্ত্রিক বিধানের নিষ্ঠুরতা। শান্তা গৌরীকে আত্মোৎসৰ্গিত বিধবার ছকের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তার মনে জাগিয়ে দিয়েছেন। মুক্তির অভিলাষ : ‘গৌরী ঠিক করিল এমন করিয়া পুতুলের মত দিন সে কাটিতে দিবে। না। যেমন করিয়াই হউক একটা পথ তাহাকে করিতে হইবে 1. তাহাকে মুক্ত হইতে হইবে।’ দ্বিতীয় বা মুক্তিখণ্ডে শান্তা প্রচুর পরিশ্রম করেছেন গৌরীর মুক্তির গল্প বানাতে : তৈরি করেছেন তিনটি স্বদেশী যুবক, প্রতিষ্ঠা করেছেন হৈমবতীর কন্যাশ্রম, সেখানে বহু দুর্গত তরুণীর সাথে রেখেছেন গৌরীকে, এবং তরুণতরুণীদের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন প্রেমাবেগ। নারীকে মুক্ত করার জন্যে পরিশেষে দিয়েছেন দুটি প্লটবাঁধা যুগ্ম বিয়ে : বিধবা গৌরীকে বিয়ে দিয়েছেন সঞ্জয়ের সাথে, আর সঞ্জয়ের পিতার অবৈধ কন্যা চঞ্চলাকে বিয়ে দিয়েছেন গৌরীর ভাই শঙ্করের সাথে। ভাইয়েরা উদ্ধার করেছে। পরস্পরের বোনদের। তিনি ছক ভেঙেছেন, নতুন ভাবমূর্তি সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন; কিন্তু ব্যৰ্থ হয়েছেন উপন্যাস লিখতে এবং নারীর সপক্ষে গভীর আবেদন সৃষ্টি করতে।
নারীর ভবিষ্যৎ
নারী কি বিপন্ন? নারী কি এমন কোনো প্ৰজাতি, যা ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে, বা ব্যাপক নিধনের ফলে পৌচেছে অবলুপ্তির প্রান্তে, যাকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জনো? না, নারী এমন কোনো প্ৰজাতি নয়; নারী সংখ্যায় হ্রাস পাচ্ছে না, ব্যাপক সংহারেরও শিকার নয়, বরং গ্রহ জুড়ে বাড়ছে নারীর সংখ্যা। তবে প্রতি প্রজন্মের রক্ষণশীলেরাই আৰ্তনাদ করেছে; এখন আর খাঁটি নারী নেই, যারা ছিলো সুখ শান্তি কল্যাণ সতীত্ব পাতিব্ৰত্য প্রভৃতি বৰ্মণীয়তার আধার, তারা অবলুপ্ত হয়েছে। প্রতি প্রজন্মের প্রতিক্রিয়াশীলেরা তাদের চারপাশে প্রাচীন পুণ্যময়ী নারীর বদলে বিকশিত হ’তে দেখেছে দানবী, যারা নষ্ট করছে সংসার, পতিকে পদচ্যুত করছে দেবাসন থেকে, এবং সন্দেহজনক যাদের সতীত্ব। উনিশশতকের বাঙলায় প্রাচীনার অবলুপ্তিতে আর্তনাদ করেছে। পুরুষতন্ত্র; দিকে দিকে, সংসারবৃক্ষের ডালে ডালে, ঝুলতে দেখেছে ‘বিষময় ফল’। বিষাক্ত নারী ফুল ফুটিয়েছে ফল ধরিয়েছে বিষবৃক্ষের। পুরুষের চোখে চিরকালই নারী নয়, নারীত্ব বিপন্ন, তাই পুরুষ সব সময়ই চেষ্টা করেছে নারীকে আদিম অবস্থায় রেখে দিয়ে ‘নারীত্ব’ উপভোগ করতে। নারীর মৃত্যুতে তাদের দুঃখ নেই, তাদের উদ্বেগ নারীত্বের মৃত্যুতে। নারীর সামনে সময় থাকে, নারীর বয়স বাড়ে, সময়ের কামড় বোধ করে নারী; কিন্তু নারীর কোনো ভবিষ্যৎ থাকে না। পুরুষ এগোয় ভবিষ্যতের দিকে, নারী এগোয় বার্ধক্য ও ভবিষ্যৎইৗনতার দিকে; তাই বিশশতকের শেষ দশকে পৌঁছেও মনে হয় নারীর কোনো ভবিষ্যৎ নেই, যদি নারী তা সৃষ্টি করতে না চায়। পুরুষের হাতে নারীর ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেয়ার অর্থ বিপন্নতা, পুরুষের হাতে পর্যুদস্ততা। প্ৰণতির অগ্ৰগতি ধারাবাহিক ব্যাপার নয়, প্রগতির পর প্রতিক্রিয়াশীলতা মাঝেমাঝেই দেখা দেয়: বিশশতকের শেষাংশে প্রতিক্রিয়াশীলতাই হয়ে উঠছে প্রবল, তাই তা নারীর জন্যে বড়ো আতঙ্কের কারণ। সব ধরনের প্রগতিশীলতা নারীর জন্যে শুভ, প্রতিক্রিয়াশীলতা অশুভ। পিতৃতন্ত্র যতো সংস্থা তৈরি করেছে, —পরিবার, বিয়ে, সমাজ, ধর্ম, বিদ্যালয় সবই মৰ্মমূলে প্রতিক্রিয়াশীল, এগুলোকে অনেক শতকেও প্রগতিশীল করা যায় নি; কেননা সমাজরাষ্ট্র যারা অধিকার ক’রে আছে, তাদের জন্যে প্রতিক্রিয়াশীলতাই আধিপত্য রক্ষার উপায়। কয়েক সহস্ৰক ধরে নারী ভবিষ্যৎইন, বিশশতকের শেষাংশেও নারী ভবিষ্য ৎইন। তার সামনে অনেক শতাব্দী, কিন্তু তার সামনে ভবিষ্যৎ নেই।