নিরুপমা শ্যামলীতে (১৯১৮) নিয়েছেন শ্যামলী নামের এক ‘কালা বোবা পাগলী’কে, কাব্যিক নামটি ছাড়া আর সবই যার শোচনীয়। তার নায়িকা যে কালা বোবা পাশলী, এটা তাৎপর্যপূর্ণ। নিরুপমা হয়তো এমন একটি নায়িকা বেছে নিয়েছিলেন চরম ভাবাবেগ উৎপাদনের জন্যে, কিন্তু এটাকে আমার মনে হয় অত্যন্ত তাৎপৰ্যপূর্ণ নারীমাত্রই, পুরুষতন্ত্রের কাছে, কালা বোবা পাগলী; তারা যতোই শুনতে বলতে চিন্তা করতে পারুক। পুরুষতন্ত্র সব নারীকেই কালা বোবা পাগলী ক’রে রেখেছে। শ্যামলী কালা বোবা পাগলী, তবে তাকে কেন্দ্ৰ ক’রেই আবর্তিত হয়েছে সব কিছু। শ্যামলী নারীর চরম দুৰ্দশার রূপ, তবে নিরুপমা তাকে দিয়েছেন এমন একটি স্বামী, যে তাকে মানুষের জীবন দিয়েছে। পুরুষের ওপর দিয়েছেন তিনি কালা বোবা পাগলীকে অর্থাৎ নারীকে মানুষ ক’রে তোলার ভার। এ-কাহিনী বাস্তবের নয়, ইচ্ছাপূরণের; সব নারীই যদি পেতো এমন পুরুষ, তাহলে তাদের জীবন মানুষের জীবন হয়ে উঠতো। শ্যামলী নারী, তার জীবন নিৰ্ম্মফল হওয়ার জন্যে এ-ই যথেষ্ট, তার ওপর সে কালা বোবা পাগলী: অন্যরা ও নিরুপমা তাকে বার বার জন্তু’, ‘জানোয়ার’ ব’লেই নির্দেশ করেছেন। সমস্ত নারীর মতো বিয়েই তার প্রধান সংকট। তার বিয়ের কোনো সম্ভাবনা ছিলো না; কিন্তু তার পিতার এক উন্মত্ততায় তার বিয়ে হয়ে যায় তারই ছোটোবোনোর বর অনিলের সাথে। শ্যামলী নিজের জন্যে যতোটা সমস্যা, তার চেয়ে বড়ো সমস্যা পিতার জন্যে : ‘কিন্তু কালা বোবা এবং পাগল এই ত্রিবিশেষণ-বিশিষ্টা কন্যাকে নামে মাত্র সম্প্রদানের জন্য ও স্বজাতি এবং সমকুলস্থ এমন কোন পাত্রই তিনি তখন খুজিয়া পাইলেন না যে তাঁহাকে জাতিচু্যতি হইতে রক্ষা করে।’ তাই পিতা এক অদ্ভুত উন্মাদের কাজ করে, তার ভাষায়, ‘আমি সমাজের এই অত্যাচার থেকে বঁচবার জন্যই এই অভাগা জীবটাকে একবার গোটাকতক মন্ত্র পড়িয়ে বিজলীর বিয়ের আগে সম্প্রদান করে নিলাম মাত্ৰ ’ শ্যামলী তার বাবার চোখেও ‘একটি জানোয়ার মাত্র। নিজেকে বাচানোর জন্যে সে মন্ত্ৰ পড়িয়ে নেয়, ৩বে মেয়েকে বাচানোর কোনো আগ্রহ তার নেই; সে অনিলকে বলে, ‘এখন এ ঘটনা তুমি মন থেকে শীগগিরই মুছে ফেলো, ভাল মেয়ে দেখে বিয়ে কোরো–সুখী হয়ো, এই আমার তোমায় আন্তরিক আশীৰ্ব্বাদ। অনিল আদর্শবাদী পুরুষ; সে শ্যামলীর ছোটো বোন বিজলীকে আর বিয়ে করতে রাজি হয় নি, বরং তখনি বিজলীর বিয়ের ব্যবস্থা করেছে বন্ধু শিশিরের সাথে। এরপর নিরুপমা দীর্ঘ কাহিনী ব’লে একটি আদর্শবাদী স্বামীকে দিয়ে শ্যামলীকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন জীবনে। নিরুপমা নারীকে প্রথাগত ছক অনুসারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সাথে সাথে প্রকাশ করেছেন নারীর বেদনা। অনিল তাকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসার পর শ্যামলীর অব্যক্ত আর্তনাদে প্ৰকাশ পায় সব নারীর যন্ত্রণা : ‘মাগোকোথায় তুমি! এ আমি কোথায় আসিলাম মা?… এখানে যে আমি আর একদণ্ডও বঁচিতে পারিতেছি না।’ পৃথিবীতে পা দিয়ে প্রতিটি নারীই এমনভাবে চিৎকার ক’রে উঠতে পারে।
শ্যামলীর ভাগ্য ভালো সে অনিলের মতো দেবতার পায়ে পড়েছে। অনিল আর বিয়ে করতে রাজি হয় নি, এটা তার মহত্ত্ব; তবে শ্যামলীর কি রয়েছে আবার বিয়ের অধিকার? আনিলের মনে নিরুপমা যে-প্রশ্ন জাগিয়ে দিয়েছেন, সেটি আসলে নারীর প্রশ্ন : ‘সমাজ পুরুষের দ্বিতীয়বার বিবাহ স্বচ্ছন্দে অনুমোদন করিবে। আর স্ত্রীলোকের পক্ষে তাহা খাটিবে না, সেই জন্যই কি এ ব্যবস্থা? এই অৰ্দ্ধমনুষ্য প্রাণীটির পক্ষেও কি এই নিয়ম! অনিলের যদি এ বিবাহ অসিদ্ধ হয়, তাহারই বা কেন না হইবে? তাহাকে আর কেহ বিবাহও করিবে না এবং যাহার সহিত বিবাহ হইল তাহারও গ্রহণযোগ্য সে হইবে না? তবু অনিলকে মনে মনে স্বামী বলিয়া তাহাকে চিরদিন জানিতে হইবে। তাহার বিবাহের সম্ভাবনা না থাকিলেও অন্য ভয়ের সম্ভাবনা যথেষ্ট আছে, সেইজন্যই তাহার জানিতে হইবে তাহার বিবাহ হইয়াছে, তাহার স্বামী আছে, অমুক তাহার স্বামী!’ অনিলের বন্ধু ব্যক্তি করেছে। পুরুষতন্ত্রের সিদ্ধান্ত : ‘তুমিও জান এবং আমিও জানি যে স্ত্রীপুরুষের এ সাম্যবাদের নীতি বহু দেশে বহু তর্কের সঙ্গে চললেও সমত্ব কখনই মানুষে তাদের দিতে পারবে না। কিসে পারবে-প্রকৃতিই যে তাদের দুৰ্ব্বল করে রেখেছে।… হাজার শিক্ষা দাও, সুবিধা দাও, স্বাধীনতা দাও, ভগবান তাদের নীড় বািধকার জন্যেই তৈরী করেছেন; তৰ্ক মীমাংসা শুতি স্মৃতি ঘটিবার জন্যে বা যুদ্ধ করুবার জন্যে নয়।. সাধারণতঃ নারীদের ভগবান স্নেহদুৰ্ব্বল স্বভাবীদুৰ্ব্বল করে যে সৃষ্টি করেছেন।. গৃহের মেরুদণ্ড স্বরূপেই ভগবান স্ত্রীজাতিকে সৃষ্টি করেছেন। তাঁরা শিক্ষাদীক্ষা বা অন্যান্য সব অধিকারে পুরুষের তুল্য হোন ক্ষতি নেই, কিন্তু তাঁরা এই গৃহকে না অতিক্রম করেন, তাদের নারীত্ব না ভুলে যান! তা হলেই ধৰ্ম্মনাশ হবে!’ নিরুপমা প্রথাগত, তবে তিনিও পুরুষতান্ত্রিক এ-বক্তৃতায় বিশ্বাস করেন না।
অনিল আদর্শবাদী হ’লেও নিরুপমা একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটিয়েই শুধু অনিলকে দিয়ে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করিয়েছেন শ্যামলীকে। অনিলকে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত ক’রে কুৎসিত পুরুষে রূপান্তরিত করেন। যখন সে সুদর্শন ছিলো, যোগ্য ছিলো যে-কোনো রূপসী তরুণীব স্বামী হওয়ার, তখন সে তার আদর্শবাদ সত্ত্বেও নিদ্বিধায় শ্যামলীকে স্ত্রী হিশেবে গ্রহণ করতে পারে নি, পেরেছে বসন্তে বিকৃত হয়ে যাওয়ার পর। একটি বিকৃত কুদৰ্শন পুরুষ একটি ‘অৰ্দ্ধমনুষ্য’, ‘অসম্পূর্ণ জীবকে স্ত্রী হিশেবে নিতে পারে, এটা সমাজের কাছে স্বস্তিকর; একটি যোগ্য পুরুষ গ্ৰহণ করবে একটি অযোগ্য নারীকে, এটা স্বস্তিকর নয়। সে জন্তুর সমতুল্য হ’লেও মাঝে মাঝে দেখা যায় তার ‘কেমন এক রকম দৃষ্টি,–মুখের ও সারা অঙ্গের বিদ্রোহসূচক ভাব!’ অনিল তাকে মুক-বধিরদের শেখানোর রীতিতে শিক্ষা দিতে থাকে, জাগিয়ে তুলতে থাকে তার প্রকৃত নারীত্ব’। তার নারীত্ব জেগে ওঠে ঈর্ষার মধ্য দিয়ে : ‘এই অৰ্দ্ধমনুষ্য জীবটি, যাহাকে এতদিন উন্মাদ জড় বলিয়াই সকলে জানিত, অনিলও যাহাকে এতদিন পূর্ণ নারী বলিয়া অনুভব করিতে পারে নাই, যাহার বুদ্ধি স্নেহ ভালবাসা রাগ বা দুঃখ সমস্ত একেবারে এতদিন বালকের মতই ছিল, সেই শ্যামলীতে নারীত্ত্বের এই নিকৃষ্ট অংশটি সহসা এমনই ভাবে কি ফুটিতে পারে? সে হিংসা করিতেছে?’ নিরুপমা প্রশ্ন করেছেন : ‘এই ঈর্ষা, নারীত্বের এই রহস্য, এ যে বিধাতারই নিজহস্তে দত্ত নারী-জীবনের অভিশাপ!— ইহা হইতে কোন নারী মুক্ত?’ বিধাতা! যে-শ্যামলীকে জন্তু হিশেবে সৃষ্টি করেছিলো, অনিল, এক পুরুষ, তাকে পুনরায় সৃষ্টি করে মানবী ও দেবীরূপে : ‘সেই জড়বুদ্ধিসম্পন্ন অৰ্দ্ধোন্মাদ শ্যামলীতে প্রথমে মানবীত্ব আনিয়া পরে ক্রমশঃ তাহতে আজিকার এই দিবীত্বের ক্ষুদ্রণ ইহাও আনিলের জীবন-ঢালা ব্ৰতেরই ফল বলিয়া রেবার মনে হইল।’ শ্যামলীতে একটি জন্তুকে উন্নীত করা হয়েছে ছকবাধা নারীর স্তরে, এতে ভূমিকা পালন করেছে একটি পুরুষ: পুরুষই হয়ে উঠেছে নারীর স্রষ্টা।