নিরুপমা দেবীর দিদি (১৯১৫) চেতনায় ও কাঠামোয় অনুরূপার মন্ত্রশক্তির সাথে অভিন্ন; এতেও প্রচার করা হয়েছে পিতৃতন্ত্রের বিধান। অনুরূপা ও নিরুপমা, দুজনেই, ব্যবহার করেছেন একই ছক : মন্ত্রশক্তিতে বাণী সারা উপন্যাস জুড়ে নিজের দেহ রক্ষা করেছে স্বামীর কবল থেকে, শেষে আত্মসমর্পণ করেছে মৃত স্বামীর পায়ে; দিদির সুরমাও স্বামীকে দেহ দেয় নি, কিন্তু উপন্যাসের শেষ পাতায় আশ্রয় নিয়েছে স্বামীর পায়ে। তাদের উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়গুলো নারীর জন্যে প্রলোভন, মাঝের অধ্যায়গুলো নারীর বিরুদ্ধে চক্রান্ত, আর শেষ পৃষ্ঠাগুলো বিশ্বাসঘাতকতা। কালিগঞ্জের জমিদারকন্যা সুরমা দাসীর বিয়ে হয় মাণিকগঞ্জের জমিদারপুত্র ডাক্তার অমরনাথের সাথে। তারা একটি বাসর রাত কাটিয়েছিলো পরস্পরকে না ছুয়ে–যথারীতি পাকস্পর্শ ফুলশয্যা সমস্ত হইয়া গেল। অমরনাথ ফুলশয্যার দিন জড়সড়ভাবে কোন রকমে খাটের এক পার্শ্বে শুইয়া রাত কাটাইয়া দিল। তাহার লজ্জা করিতেছিল। কন্যাটি নিতান্ত ছেলেমানুষ নয়; তোর-চৌদ। বৎসর বয়স হইতে পারে।’ পরে আকস্মিকভাবে অমরনাথ বিয়ে করে অনাথ চারুলতাকে। সুরমা এজন্যে স্বামীকে ক্ষমা করে নি; স্বামীকে ছেড়ে দেয়া সম্ভব হয় নি তার পক্ষে, তবে স্বামীকে সে গণ্য করেছে পরপুরুষ হিশেবেই। বিষবৃক্ষ-এ কুন্দকে আত্মহত্যা করতে হয়েছিলো, দিদি যেনো তার উত্তর; চারুলতাকে আত্মহত্যা করতে হয় নি, বরং সে-ই উপভোগ করে অমরনাথের স্ত্রীর ভূমিকা। সুরমা হয় তার দিদি। অমরনাথ ও সুরমা এক বাড়িতে থেকেও কখনো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে আসে নি। নারীদের উপন্যাসে একটি লক্ষণীয় ব্যাপার স্বামী-স্ত্রীর দূরত্ব, এ-উপন্যাসে তা চরম রূপ নিয়েছে।
অমরনাথ চারুলতাকে বিয়ে করার পর তার পিতা তাকে ত্যাগ করতে চেয়েছে, কিন্তু সে পুত্র, তাকে ত্যাগ করা অসম্ভব; বরং তার পিতা মৃত্যুর আগে পুত্রবধু সুরমাকে দেবীর বেদিতে বসিয়ে উৎসর্গ ক’রে যায় সুরমার জীবনটি : ‘মা, আমি একে তোমার হাতে দিয়া গেলাম। এ তোমার ছোট বোন। ছোট-বীেমা, তোমার দিদিকে প্ৰণাম কর। ইনি দেবী।’ সুরমা চরম ঘৃণায় মেনে নেয় দেবীর ছক, সে হয় এমন দেবী যে ঘৃণা করে স্বামীকে : ‘অমরকে যে তাচ্ছিল্য দেখাইয়া সে ফিরাইয়া দিতে পারিয়াছে, ইহা মনে করিয়া একটি বিজয়ানন্দে সুরমার হৃদয় পূর্ণ হইয়া উঠিল।’ নিঃশব্দ বিরোধই হয়ে ওঠে তাদের জীবন। এতে অবশ্য অমরনাথের জীবনে কোনো শূন্যতা দেখা দেয় নি, সে চারুলতাকে নিয়মিতভাবে গর্ভবতী করেছে; চরম শূন্যতায় দিদির দেবী মহিমার জ্বালার মধ্যে বাস করেছে সুরমা। দেহ তাকেও পীড়িত করেছে; কিন্তু তার কাজ সহ্য করা : ‘জীবনের প্রথম-যৌবনের আকুল বাসনার পুষ্পগুলি পরার্থপরতার দীপ্ত হোমানলে ভস্ম। করিয়া ফেলিয়া তাহার হৃদয় কি একটুও বলিষ্ঠ হয় নাই? জীবনের মেহ, ভালবাসা, আশা, তৃষ্ণা এতগুলি জিনিস এক নিমেষে পান করিয়া তাহার মৃত্যুঞ্জয় কঠিন প্ৰাণ কি এখনও এত দুৰ্ব্বল ? না, এ প্রাণকে সবল করিতেই হইবে।’ সে জানে, ‘তাহার জীবনের সমস্তটা একটা খরচেরই তালিকা-তাহার জমার ঘর একেবারে খালি।’ তার স্বামীও তাকে মনে করে আত্মোৎসর্গিত দেবী : ‘আমরা ভাবিত, চারু–চারু–চারুই তাহার স্ত্রী… সুরমার কাহারও সহিত বিবাহ হয় নাই, হইতে পারে না, কেন না পৃথিবীর কেহ কি সে? না। সে দেবী, শুধু স্নেহ দিবার জন্যই সে সংসারের সহিত আবদ্ধ।’ কিন্তু তার চোখে অমরনাথ সপত্নীপ্ৰণয়ে অবিচারক স্বামী’! আমন্বনাথ এক সময প্রলুব্ধ বোধ করে সুরমার প্রতি, সুরমা তা প্রত্যাখ্যান করে; কেননা বলা কি যাইত না, ‘আজ তুমি আমায় যাহা দিতে আসিয়াছ, তাহা ইতিপূৰ্ব্বে কোথায় ছিল? আমার নবীন বাসনাময় তরুণ-যৌবনের প্রথম আগ্রহ যে অন্ধের মত চাহিয়া দেখে নাই বা দেখিতে ইচ্ছা করে নাই, সেই তুমি! সেই অবিচারক তুমি!… যাহা আমার নিকট হইতে কাড়িয়া লইয়া অন্যের চরণতলে উপহার দিয়াছিলে, তাহাই আবার আজ আমায় দিতে চাও?’ স্বামীর সাথে বাঙালি নারীর সম্পর্ক যে পারস্পরিক প্রতিপক্ষের, তা সুরমা ও বোধ করে : ‘তাঁহাকে সুরমার এখন তাহার জীবনের সুখস্বৰ্গ হইতে ভ্ৰষ্টকারী দূরদৃষ্ট বলিয়া জীবনের সর্ব জ্বালাযন্ত্রণার মূলীভূত রুষ্ট কুগ্ৰহ বলিয়া, জন্মের সুখদুঃখের নিয়ন্তী, জন্মকেন্দ্ৰস্থিত দুষ্ট নক্ষত্ৰ বলিয়া মনে করিত।’ বাঙালি নারীর চোখে দেবতা হয়ে ওঠে। দুষ্ট নক্ষত্র, একে যুগান্তর বলা যায়।
কিন্তু এ-সুরমাকে অবশেষে নিরুপমা বিন্যস্ত করেন। পুরুষতন্ত্রের ছকে; চাপিয়ে দেয়া দেবীর ভূমিকা পালন ক’রে যে ক্লান্ত, যার জীবনে পুরুষের প্রয়োজন প্রায় কেটে গেছে, নিরুপমা বিশ্বাসঘাতকতা করেন তার সাথে, উদ্যোগ নেন তাকে অনিচ্ছায়-মেনে-নেয়া দেবীর আসন থেকে দাসীর আসনে বসানোর। তবে তিনি দাসীর গ্রানিকে অস্বীকার করেন নি : ‘একদিন একস্থানে একজনকে সে না’ বলিয়া গিয়াছিল, সেইস্থানে সেই ব্যক্তিকে আর একবার বলিতে হইবে ‘হ্যা’। বলিতে হইবে, নারী-জনের দোষ, ভাগ্যের দোষ, সৰ্ব্বোপরি বিধাতার দোষ। বলিতে হইবে ‘হে দেব, তোমারই জয় হইয়াছেঃআর কেন–সৰ্ব্বস্ব আহুতি দিয়াছি, সব পুড়িয়া গিয়াছে, এখন এ হোমাগ্নি নিবাও।’ প্ৰণাম করিয়া বলিতে হইবে, ‘ভস্ম তিলক ললাটে প্রসাদচিহ্ন-স্বরূপ নিৰ্ম্মাল্য-স্বরূপ দাও। তুমি তৃপ্ত হইয়াছ, এখন আমায় মুক্তি দাও।’ নারীজন্মের অপমান ও যন্ত্রণাকে নিরুপমা অস্বীকার করেন নি, তবে মেনে নিয়েছেন; তিনি যেনো জানেন জয় নারীর জন্যে নয় : ‘তাহার পরাজয় যেন তাহারা দিব্যচক্ষে দেখিয়াই বসিয়া আছে। এমনি নারী-জন্ম লইয়া সে আসিয়াছে! ধিক!’ সুরমা নিজের জীবন সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর উপন্যাসের শেষে বিসর্জন দেয় তার অস্তিত্বকেও বলে, ‘নারীর দৰ্প তেজ অভিমান কিছু নেই.. কেবল ভালবাসা, কেবল দাসীত্ব…।’ নিরুপমা সুরমাকে অবশেষে বসিয়েছেন পুরুষতন্ত্রের পদতলে; ‘সুরমা সহসা নতজানু হইয়া স্বামীর পাদমূলে বসিয়া পড়িল। দুই হস্তে অমরের পদযুগল জড়াইয়া ধরিয়া অজস্রবাষ্পবারিসিক্ত মুখ উৰ্দ্ধে তুলিয়া বলিল, ‘কেবল–এইটুকু, আর কিছু নয। আমায় কোথায় যেতে বল? আমার স্থান কোথায়? আমি যাব না।’ নিরুপমা তার অপচয়িত দেবীকে পরিণত করেন। অসহায় দাসীতে, জানিয়ে দেন যে নারীর মুক্তি নেই; নারীকে বন্দী থাকতেই হবে ছকে ও যন্ত্রণায়। নিজের লিঙ্গের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার এটা এক স্মরণীয় উদাহরণ।