ছোটো বালিকা কোনো ভয় জাগায় না, কিন্তু যেই সে হয়ে ওঠে প্ৰজননপ্রস্তুত, নারী, সে হয় অশুচি। তার শরীর জুড়ে বিকশিত হয় পুরুষের আকর্ষণ ও আতঙ্ক। ওই শরীরের একটি বড়ো ঘটনার নাম ঋতুস্রাব। পুরুষতন্ত্র তার ঋতুস্রাবকে ঘিরে দিয়েছে একরাশ বিধিনিষেধ। অনেক সমাজ তাকে বিচ্ছিন্ন ক’রে দেয় অন্যদের থেকে, তাকে ঘোষণা করে অশুচি ব’লে। ঋতুক্ষরণকে প্রতিটি ধর্ম ও আদিম সমাজ দেখেছে দানবিক ব্যাপার রূপে। পিতৃতন্ত্রের সূচনা থেকেই নারীর স্রাবকে অশুভ ধারারূপে দেখা হচ্ছে; এবং একে এতো বিধিনিষেধে ঘিরে দেয়া হয়েছে যে আজো পুরুষেরা এর নামে শিউরে ওঠে। পশ্চিমে এক সময় বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিলো যে ঋতুকালে নারীদের সংস্পর্শে শস্য নষ্ট হয়, বাগান ধ্বংস হয়, মৌমাছি মারা যায়; এ-সময়ে নারীর ছোঁয়ায় মদ হয় ভিনেগার, দুধ টক, এবং ঘটে আরো নানা অঘটন। উনিশ শতকের শেষভাগেও চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘এটা নিশ্চিত যে ঋতুমতী নারীর ছোয়ায় মাংস পচে।‘ এ-শতকের শুরুতেও ফ্রান্সে মদের কারখানায় ঢুকতে দেয়া হতো না ঋতুমতী নারীদের; বিশ্বাস ছিলো যে ওই অভিশপ্ত নারীদের, ঋতুস্রাবকে ইউরোপের অনেকাংশে ‘অভিশাপ’ই বলা হয়, প্রভাবে চিনি কালো হয়ে যায়। নারীর ক্ষরণ সম্পর্কে কুসংস্কারের মূলে রয়েছে অলৌকিক ভীতি। রক্ত পবিত্র, কিন্তু ঋতুকালে যে-রক্ত বেরিয়ে আসে তা অপবিত্র, কেননা এ-রক্তেই রয়েছে নারীর নারীত্ব। আদিম সমাজে রজঃস্রাবভীতি খুবই প্ৰবল; সেখানে ঋতুকালে নারীদের বিচ্ছিন্ন ক’রে ফেলা হয়, রাখা হয় পল্লীর প্রান্তে একলা কুটিরে। তাদের দুধ খেতে দেয়া হয় না, দুধের পাত্র ছুঁতে দেয়া হয় না, তারা স্বামীর কোনো কিছুই ছুঁতে পারে না। তারা মনে করে ঋতুমতী কোনো নারী যদি স্বামীর কোনো সামগ্ৰী স্পর্শ করে, তবে স্বামীটি অসুস্থ হয়ে পড়বে; আর সে যদি স্বামীর কোনো অস্ত্ৰ স্পর্শ করে তবে স্বামীটি নিহত হবে যুদ্ধে। কোনো কোনো সমাজে ঋতুকালে নারীদের চাঁদতারাসূর্যের দিকে তাকানোও নিষিদ্ধ।
বাইবেলে ও কোরানে ও সব ধর্মপুস্তকে ঋতুকে দেখা হয়েছে ভয়ের চোখে, এবং ঋতুমতী নারীদের নির্দেশ করা হয়েছে নিষিদ্ধ ও দূষিত প্রাণীরূপে। বাইবেলে বলা হয়েছে : ‘যে স্ত্রী রজঃস্বলা হয়, তাহার শরীরস্থ রক্ত ক্ষরিলে সাত দিবস তাহার অশৌচ থাকিবে, এবং যে কেহ তাহাকে স্পর্শ করে, সে সন্ধ্যা পর্যন্ত অশুচি থাকিবে’ এবং ‘অশৌচকালে যে পুরুষ তাহার সহিত শয়ন করে, ও তাহার রজঃ তাহার গাত্রে লাগে, সে সাত দিবস অশুচি থাকিবে’ [লেবীয় পুস্তক : ১৫]। কোরানে আছে : ‘লোকে তোমাকে রজঃক্ষরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। তুমি বলো, তা অশুচি। তাই রজঃক্ষরণকালে স্ত্রীসঙ্গ বর্জন করবে, আর যতোদিন না তারা পবিত্র হয়, তাদের কাছে যেও না’ [২:২২২]। হিন্দুধর্মের ঋষিরা ঋতুক্ষরণের নামে শিউরে উঠে প্ৰণয়ন করেছেন শ্লোকের পর শ্লোক ও অজস্র বিধি। তাঁরা বিধান দিয়েছেন যে ঋতুকালে নারী অস্পৃশ্য থাকবে, তাকে কেউ স্পর্শ করবে না। নারী এমনভাবে থাকবে যাতে ভোজনরত কোনো ব্ৰাহ্মণের চোখে সে না পড়ে। ক্ষরণের প্রথম দিনে নারীকে গণ্য করতে হবে চণ্ডালী, দ্বিতীয় দিনে ব্ৰহ্মঘাতিনী, তৃতীয় দিনে রাজকী; এবং তাকে কোনো সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিতে দেয়া হবে না [দ্র নরেন্দ্রনাথ (১৯৭৫, ৮৬)]। মনু, অঙ্গিরা, পরাশর ও আরো অনেকে নারী দানবীর ক্ষরণ নিয়ে মূল্যবান সময় ব্যয় ক’রে তৈরি করেছেন অনেক পবিত্র বিধি। মনু বলেছেন, ‘রজস্বলা নারীতে যে-পুরুষ সঙ্গত হয়, তার বুদ্ধি, তেজ, বল, আয়ু, ও চক্ষু ক্ষয় পায়’ [মনুসংহিতা, ৪:৪১]। এর সবটাই বাজেকথা, তবে হাজার হাজার বছর ধরে এ-শ্লোকটি ভয় দেখিয়ে আসছে পুরুষদের। বরাহপুরাণের একটি সম্পূর্ণ পরিচ্ছেদই রয়েছে দানবীর ভয়ংকর রক্তপাত ও বিধিনিষেধ সম্পর্কে। বিধান দেয়া হয়েছে রাজস্বলা নারীর সাথে কেউ কথা বলবে না, তার হাতের কোনো খাদ্য গ্ৰহণ করবে না; তার সামনে মন্ত্র উচ্চারণ করা যাবে না; আর বামন বলেছেন ওই নারীর সাথে সঙ্গম মহাপাপ। ঋতুমতী নারী যদি কাউকে স্পর্শ করে, তবে তাকে প্ৰায়শ্চিত্ত করতে হবে। ছাত্রদেরও নিষেধ করা হয়েছে ঋতুমতী নারীর কাছাকাছি না আসার। কোনো ঋতুমতী নারীকে দেখা ছাত্রদের নিষেধ; আর সমাবর্তনের পর কমপক্ষে তিন দিন তারা কোনো রাজস্বলা নারীকে দেখতে পারবে না। এই যে রক্ত তা যে অশুচি, এমন নয়; আসলে পুরুষের চোখে নারী এক দানবী, নারীর প্ৰতিমাসের রক্তধারা নারীর আপনি অশুচিতার চিহ্ন।
নারীর দেবী ও দানবী রূপ, নারীর প্রতি পুরুষের ভীতি ও কামনা প্ৰকাশ পায় কুমারীত্ব সম্পর্কে পুরুষের আগ্রহ ও আতঙ্কে। কুমারী, অক্ষতযোনি, পুরুষ কামনা করে, ভয়ও পায়। কুমারী পুরুষের চোখে এক চরম রহস্য। পুরুষের কাছে কুমারী, কুমারীর দেহ, তার রন্ধের অদৃশ্য আবরণঝিল্লি একই সাথে ভীতিকর, ও পরম কামনার বস্তু। পুরুষ যখন মনে করে নারীর শক্তি তাকে পরাভূত করবে, সে হেরে যাবে ওই রহস্যের কাছে, তখন সে ভয় পায়; যখন পুরুষ ভাবে ওই শক্তিকে সে জয় করবে, আধিপত্য বিস্তার করবে ওই রহস্যের ওপর, তখন সে দাবি করে অক্ষত কুমারী। আদিম সমাজে যেখানে নারীশক্তি প্ৰবল, সেখানে পুরুষ আতঙ্কে থাকে; তাই সেখানে বিয়ের আগের রাত্রেই কনের কুমারীত্ব মোচন করে শক্তিমান কেউ, পুরোহিত বা সমাজপতি। মার্কো পলো জানিয়েছে যে তিব্বতি পুরুষেরা কেউ কুমারী নারী বিয়ে করতে রাজি নয়। কুমারীর সতীচ্ছদ ছিন্ন করাকে মনে করা হয় এক অতীন্দ্রিয় ভীতির কাজ, যা সকলের পক্ষে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। অনেক সমাজে মনে করা হয় যে যোনিতে লুকিয়ে রয়েছে সাপ, যা পর্দা ছেড়ার সাথেসাথে দংশন করবে পুরুষাঙ্গে; কোনো কোনো সমাজে মনে করা হয় যে রক্তপাতের ফলে হানি ঘটবে পুরুষের বীর্যের। ধাতু বা বীৰ্যকে সব সমাজেই অত্যন্ত দামি মনে করা হয়। পুরুষ এতো যে ভয় পায় তা নারীকে দানবী রূপে দেখারই ফল। অনেক সমাজে সতীচ্ছদ ছেড়ারই প্রশ্ন ওঠে না; সেখানে মেয়েরা কুমারী থাকে শুধু শিশুকালে। শৈশব থেকেই তারা সঙ্গমের অনুমতি পায়, সঙ্গম সেখানে বাল্যক্রীড়া। কোনো কোনো সমাজে মা, বড়ো বোন, ধাত্রী মেয়েদের সতীচ্ছদ ছিন্ন করে। কোনো কোনো সমাজে পুরুষেরা জোর ক’রে মেয়েদের গ্রামের বাইরে নিয়ে গিয়ে স্বাভাবিক বা অন্য কোনো উপায়ে ছিন্ন করে কুমারীর আবরণ। কোনো কোনো সমাজে মেয়েদের তুলে দেয়া হয় অচেনা পুরুষদের হাতে, যারা মোচন করে তাদের কুমারীত্ব। ওই সমাজ বিশ্বাস করে অচেনা পুরুষদের এতে কোনো ক্ষতি হবে না, বা হ’লেও কোনো ক্ষতি নেই। কোনো কোনো সমাজে পুরোহিত বা সমাজপতি বা গ্ৰাম্য চিকিৎসক বিয়ের আগের রাতে মোচন করে কুমারীত্ব। মালাবার উপকূলে বিয়ের আগের রাতে কুমারীত্ব মোচনের দায়িত্ব পায় ব্ৰাহ্মণেরা; তারা এমনভাবে মোচন করে কুমারীর কুমারীত্ব যেনো একটি অসম্ভব কঠিন কাজ সম্পন্ন করছে। এ-কাজের জন্যে তারা মোটা পারিশ্রমিকও নিয়ে থাকে। সব সমাজেই পবিত্র কাজ অপবিত্রের করা নিষেধ: স্বামী পবিত্র নয়, শক্তিমান নয়; সমাজপতি বা পুরোহিত শক্তিমান বা পবিত্ৰ, তাই তাদের পক্ষেই ওই কাজ সম্ভব। সামোয়ায় রীতি হচ্ছে স্বামী তার স্ত্রীর সতীচ্ছদ স্বাভাবিক উপায়ে ছিন্ন করবে, তবে বীর্যপাত করতে পারবে না; কেননা তাতে যোনির রক্তে দূষিত হবে তার বীর্য। দানবীর নানা ভয়ে ভ’রে আছে পুরুষতন্ত্রের মন।