পিতৃতন্ত্রে নারীরা নাগরিক অধিকারই পায় না, যেখানে পায় সেখানেও থাকে প্রান্তিক নাগরিক। সংখ্যায় তারা সংখ্যাগুরু, কিন্তু মর্যাদা পায় সংখ্যালঘুর। তাই তাদের মানসিকতাও হয়ে ওঠে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানসিকতা। তারা নিজেদের ঘেন্না ও অবজ্ঞা করে, ও নিজের শ্রেণীকে অবজ্ঞা করে। কয়েক হাজার বছর ধরে শুনে আসছে তারা নিকৃষ্ট, দেখে আসছে তাদের নিকৃষ্ট অবস্থান; তাই তারাও মনে করে নিজেদের নিকৃষ্ট। তাদের যে-কোনো অপরাধকে বাড়িয়ে দেখে সমাজ; সমান অপরাধের জন্যে তারা পুরুষের থেকে অনেক কঠোর শাস্তি পায়। সংখ্যালঘুরা যেমন নিজের বা নিজ সম্প্রদায়ের কারো অপরাধকে বাড়িয়ে দেখে, অনাবশ্যক ক্ষমা চায়, নারীরা তেমনি। নারীদের অনেকেই পুরুষ হতে চায়; বেগম রোকেয়ার মধ্যে এটা বেশ প্রবল ছিলো। পুরুষ হতে চায়, কেননা নারী হিশেবে তারা নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই অনিশ্চয়তায় ভোগে। তারা মনে করে পুরুষ হ’লে তারা নিশ্চয়তা পাবে। মার্কিন গবেষকেরা দেখেছেন কৃষ্ণকায়েরা ও নারীরা মানসিকতায় একই রকম। তারা বুদ্ধিতে খাটো, তাদের স্বভাব আদিম ও শিশুর মতো আবেগপরায়ণ; তারা নিজেদের ভাগ্যে সন্তুষ্ট, ছালনাপরায়ণ, ও লুকিয়ে রাখে নিজেদের অনুভূতি। পুরুষ এসবই পছন্দ করে নারীর। শাণিত নারীর থেকে নির্বোধ নারীকে বেশি পছন্দ করে, আর নিবুদ্ধিতাকে রমণীয় ব’লে প্ৰশংসা করে। ইংরেজি উপন্যাসে নির্বোধ স্বর্ণকেশিনীর কাছে হেরে যায় তীক্ষ্ণ কৃষ্ণকেশিনী; বাঙলা উপন্যাসেও মাংসস্তুপের কাছে পরাজিত হয় ব্যক্তিত্ব। অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মতো নারীদেরও এক-আধজনকে অন্যদের থেকে উচ্চ মর্যাদা দেয়া হয়। এটা নারীদের উপকারে আসে না, কেননা পুরুষতন্ত্রের স্বীকৃত নারীরা কাজ করে পুরুষতন্ত্রের পক্ষে। এ-নারীরা গ্ৰহণ করে ‘নারীত্ব’ ও পুরুষের প্রাধান্য রক্ষার দায়িত্ব। পশ্চিমে এ-ভূমিকায় রাখা হয় সাধারণত গায়িকানায়িকাদের, যারা বিরাজ করে জনগণের যৌনসামগ্ৰীরূপে। সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভাগ্যবান দু-একজনকে সুযোগ দেয়া হয় তাদের প্রভুদের চিত্তবিনোদনের। নারীরা তাদের কাম দিয়ে পুরুষদের বিনোদন যোগায়, সুখী করে, এবং একেই মনে করে তারা গৌরবের কাজ। ‘রাজা করিতেছে রাজ্য শাসন, রাজারে শাসিছে রানী’ ব’লে নজরুল নারীর শক্তির অসাধারণত্ব বোঝাতে চেয়েছিলেন; তিনি বুঝতে পারেন নি রাজাকে শাসন নারীর শক্তির অসাধারণত্ব নয়, শোচনীয়তা। নজরুল, বাহ্যিক সদিচ্ছাসত্ত্বেও, ছিলেন পুরুষতন্ত্রেরই প্রতিনিধি; এবং তিনিও পুরুষতন্ত্রের শিকাররূপেই দেখতে চেয়েছেন নারীকে। রানী রাজাকে যেটুকু শাসন করে, সেটুকু রক্ষিতার শাসন। এর বেশি নয়। পুরুষতন্ত্র খুবই আনন্দ বোধ করে ‘রাজারে শাসিছে রানী’তে; কিন্তু তার প্রবল আপত্তি নারীর শাসনে। পিতৃতন্ত্র রাজাকে বা স্বামীকে শাসন করা শিখিয়ে নারীকে ক’রে রেখেছে চিরন্তন রক্ষিতা। তাই নারীর মানসিকতাও হয়ে উঠেছে রক্ষিতার। পুরুষতন্ত্রের প্রিয় নারীমাত্রই পুরুষতন্ত্রের রক্ষিতা, তারা পুরুষতন্ত্রকে গ্রহণযোগ্য করার সাধনা করে তাদের সমস্ত কাজে।
দেবী ও দানবী
পুরুষের কাছে নারী এক অনন্ত অস্বস্তি; নারী তার চোখে দুই বিপরীত মেরু- আলো ও অন্ধকার; সুখ ও ব্যাধি। পুরুষের চোখে নারী দেবী ও দানবী; প্রথমে দানবী, তারপর দেবী। নারী করালী দানবী পুরুষের কাছে, যে তাকে পাপিষ্ঠ ও স্বৰ্গচ্যুত করেছে; যে তাকে প্রলুব্ধ প্ররোচিত প্ৰতারিত ক’রে চলেছে। পুরুষ সারাক্ষণ ভয়ে থাকে যে ওই পাপীয়সী তার মতো দেবতাকে নামিয়ে দিতে পারে যে-কোনো রসাতলে। পুরুষ তাকে ভয় করে, তবে এড়িয়ে চলতে পারে না; কাম ও পার্থিব প্রয়োজনে সে নারীর সাথে জড়িয়ে আছে : তাকে আলিঙ্গনে বাঁধে, চুমো খায়, তার ঐন্দ্ৰজালিক মাংসকে নিয়তির মতো মানে, কিন্তু অবচেতন ও সচেতনভাবে নারীকে ভাবে দানবী। পুরুষের চোখে নারী দেবীও; তবে নারীর দেবীত্ব তাকে যতোটা সুখী করে, বরাভয় দেয়, তার চেয়ে অনেক বেশি তাকে সন্ত্রস্ত করে নারীর দানবীত্ব। ওই অপ্রতিরোধ্য দানবীর কাছে পুরুষ বোধ করে অসহায়। নারী যখন দেবী তখন পুরুষ তাকে ভয় পায় না, কেননা দেবীকে পুরুষ দাসীও ক’রে তুলতে পারে; কিন্তু তার ভয় দানবীকে। দেবীও পুরুষের কাছে সম্ভোগের অসম্ভব সামগ্ৰী। ‘দেবী, অনেক ভক্ত এসেছে তোমার চরণতলে/অনেক অর্ঘ্য আনি;/আমি অভাগ্য এনেছি বহিয়া নয়নজলে/ব্যৰ্থ সাধনখানি’, বা ‘আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর’ বলে যে-পুরুষ, তার বাসনা হচ্ছে মন্দিরের বেদীতলে বা মালঞ্চের পুষ্পিত পরিবেশে দেবীৱ দেহখানি উপভোগ। পুরুষ কখনো নারী হ’তে চায় না, কিন্তু সব পুরুষই চায় পৃথিবীতে নারী থাকুক, নারীর জন্যে পুরুষ কৃতজ্ঞ প্রকৃতির কাছে। পুরুষের কাছে নারী এক সুখকর দুর্ঘটনা, যে-দুর্ঘটনা তাকে অমরত্বের আস্বাদ দিয়েছে; কিন্তু নারীকে নিয়ে তার মহাজাগতিক দুঃস্বপ্নের শেষ নেই। নারীকে ঘিরে পুরুষ সৃষ্টি করেছে নানা কিংবদন্তি বা পুরাণ, যাতে প্ৰকাশ পেয়েছে পুরুষের আশা ও ভয়। পুরুষের চোখে নারী মাংস, মাংসের অবর্ণনীয সুখ ও আতঙ্ক। পুরুষের কাছে নারী দেবী ও দানবী, খ্রিস্টানের কাছে সে পাপীয়সী হাওয়া ও পবিত্ৰ মেরিমাতা। দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ১৭৫) বলেছেন, ‘সে হচ্ছে মূর্তি, পরিচারিকা, জীবনের উৎস, অন্ধকারের শক্তি, সে হচ্ছে সত্যের মৌল নিঃশব্দতা, সে কৃত্রিম সামগ্ৰী, গুজব, এবং মিথ্যা; সে শুশ্রুষা ও অভিচারিণী; সে পুরুষের শিকার, তার পতন, পুরুষ যা নয় এবং যা কিছু কামনা করে। নারী তার সব কিছুঃ সে পুরুষের নঞর্থকতা।‘ পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীর প্রতিটি জাতি ও সভ্যতা নারীকে দেখেছে ভয়ের চোখে; আজো সে ভয় কাটে নি।