আদিম সমাজে নারীর যোনিকে মনে করা হয় একটি ক্ষত। তারা বিশ্বাস করে ওই স্থানে কোনো পাখি বা সাপ গর্ত খুঁড়ে ক্ষত সৃষ্টি ক’রে গেছে; তাই মাসে মাসে ওই ঘা থেকে রক্ত চোয়ায়। ফ্রয়েডীয়রাও মনে করেন নারী হচ্ছে খোজা। অর্থাৎ পুরুষতন্ত্র নারীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে দেখে ঘৃণার চোখে; কিন্তু নিজের অঙ্গটিকে দেখে গর্ব ও গৌরবের চোখে। আদিম ও আধুনিক সব সমাজেই শিশ্ন বা পুরুষাঙ্গকে মনে করা হয় পৌরুষের অপরাজেয় ঝাণ্ডা। একে নিয়ে পুরুষের গর্ব গৌরব ও উদ্বেগ অশেষ। বাঙলা ‘পুরুষাঙ্গ’ শব্দটি তাৎপর্যপূর্ণ, শব্দটিতে প্রকাশ পেয়েছে বাঙালির জাতীয় বিশ্বাস : পুরুষের সব অঙ্গই পুরুষাঙ্গ, কিন্তু অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে বাদ দিয়ে নির্বোধ প্রত্যঙ্গটিকেই দেয়া হয়েছে পুরুষের সম্মান ও গৌরব। এতে বোঝা যায় বাঙালি একে কতো মহৎ মনে করে। বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় এর যে-সব নাম রয়েছে, যেমন ‘সোনা’, ‘ধন’, সেগুলোও নির্দেশ করে এটি কতো অমূল্য। সব পিতৃতন্ত্রই নারীকে নিষিদ্ধ ক’রে রেখেছে পবিত্র এলাকা থেকে; তারা যুদ্ধ ও ধর্মীয় অনেক বস্তু ছুঁতে পারে না, এমনকি খাদ্যও স্পর্শ করেতে পারে না। আদিম সমাজে, এবং আমাদের সমাজেও, পুরুষের সাথে নারীদের খাওয়া নিষেধ। এ-বিধানের মূলে রয়েছে এমন ভয় যে দূষিত নারী থেকে কোনো ব্যাধি সংক্রমিত হবে পুরুষের দেহে। নারী খাদ্য প্রস্তুত করে, কিন্তু পুরুষের সাথে খেতে পারে না; অনেক সমাজে খাবার পরিবেশনও করতে পারে না। প্রত্যেক পিতৃতন্ত্রেই পুরুষ আগে, বেশি ক’রে, ও ভালোটা খায়; আর যেখানে তারা একসাথে খায়, সেখানেও নারী পরিবেশন করে, পুরুষ খায়।
প্ৰত্যেক পুরুষতন্ত্র কুমারীত্ব ও কুমারীত্বমোচনকে ঘিরে রেখেছে একরাশ আচার ও নিষেধে। অনেক আদিম সমাজে কুমারীত্ব নিয়ে রয়েছে চমৎকার বিপরীত মনোভাব! একদিকে প্রত্যেক পিতৃতন্ত্র একটি অক্ষত যোনি পাওয়ার জন্যে ব্যগ্র, কেননা পুরুষেরা নিজের জিনিশ অব্যবহৃত টাটকা অবস্থায় পেতে চায়; আবার অনেক সমাজ সতীচ্ছদসম্পন্ন অক্ষত যোনিকে ভয়ঙ্কর ভয়ও পায়। কোনো কোনো সমাজে কুমারীত্বমোচনকে এমন ভয়ঙ্কর শুভ কাজ ব’লে মনে করা হয় যে পুরুষটি তার নারীর সতীচ্ছদ ছিন্ন করতে ভয় পায়, সে ওই পবিত্র কাজের দায়িত্ব তুলে দেয় তার চেয়ে শক্তিমান বা বয়স্ক কারো ওপর। পুরুষতান্ত্রিক পুরাণ এমন এক সোনালি যুগের কথাও বলে যখন আবির্ভাব ঘটে নি নারীর। বাস্তবে এটা রূপ নেয়। নারীসঙ্গ পরিহারের। পুরুষের পৃথিবীতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারী নিষিদ্ধ: সাম্প্রতিক পিতৃতন্ত্রে সমস্ত শক্তিমান সংঘই পুরুষ সংঘ। পুরুষ সংঘগুলো হচ্ছে পুরুষপ্রাধান্য রক্ষার দুর্গ।
আদিম সমাজের নারীবিদ্বেষ এক সময় রূপ পায় পৌরাণিক উপাখ্যানে; এবং আরো পরে তাকে দেয়া হয় নৈতিক, সাহিত্যিক, এমনকি বৈজ্ঞানিক রূপ। অনেক পৌরাণিক উপাখ্যান নারীর বিরুদ্ধে সরাসরি অপপ্রচার। পশ্চিমের দুটি বিখ্যাত পৌরাণিক উপাখ্যান হচ্ছে প্যান্ডোরার সিন্দুক ও বাইবেলের মানুষের পতনের কাহিনী। এ-দুটিই নারীবিদ্বেষের অসামান্য উপাখ্যান। নারী অশুভ; এমন একটি আদিম বিশ্বাস এ-উপাখ্যান দুটিতে সাহিত্যিক ও ধর্মীয় রূপ পেয়ে হয়ে উঠেছে অত্যন্ত প্রভাবশালী। প্যান্ডোরা সম্ভবত ছিলো ভূমধ্যসাগরীয় কোনো উর্বরতার দেবী, যে পরে মহিমাচ্যুত ও নিন্দিত হয়। কবি হেসিয়ডের মতে প্যান্ডোরাই প্রথম সূচনা করে কাম বা যৌনতার, এবং ওই কামের পাপেই পৃথিবী থেকে লোপ পায় সে-স্বর্ণযুগ, ‘যখন মানবজাতি পৃথিবীতে যাপন করছিলো নিষ্পাপ জীবন, যখন মানুষকে করতে হতো না কোনো শ্রমসাধ্য কাজ, এবং ভুগতে হতো না রোগে৷’ (দ্র মিলেট (১৯৬৯, ৫১)}। হেসিয়ডের মতে, প্যান্ডোরাই ‘সূচনা নারকীয় নারীজাতির, যে-মহামারীকে নিয়ে বাস করতে হচ্ছে পুরুষদের।‘ নারীকে দায়ী করা হয়েছে পুরুষের দুর্দশার জন্যে; এ-দুর্দশার মূল কারণরূপে দেখানো হয়েছে কামকে, যা হচ্ছে নারীর একান্ত অনন্য জিনিশ। হেসিয়ড আরো বলেছেন, প্যান্ডোরা বা নারী এক ভয়াবহ প্রলোভন, ‘যার আত্মা কুকুরীর, যার কামনাবাসনার নৃশংসতায় দেহ জীর্ণ হয়।‘ জিউস ওই ফাঁদকে পাঠায় ‘পুরুষকে ধ্বংস করার জন্যে।’ পিতৃতন্ত্র সৃষ্টি করেছে বিধাতা, এবং রেখেছে নিজের পক্ষে। নারীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে পিতৃতন্ত্র রচনা করেছে নারীর উদ্ভবের ও তার স্বভাব সম্পর্কে অশালীন উপাখ্যান; এবং তার ওপরই চাপিয়ে দিয়েছে কামের সমস্ত কলুষ, যৌনতার সমস্ত পাপ। পুরুষতন্ত্ৰ কামকে যখন মহিমান্বিত করে, তখন শিশ্নকে দেবতায় পরিণত করে; আর যখন নিন্দা করে, তখন যোনির কুৎসায় মুখর হয়। গ্রিকরা যখন কামকে গৌরব দেয়, তখন তারা উর্বরতার উৎসরূপে পুজো করে পুরুষাঙ্গের; যখন তারা কামকে নিন্দা করে তখন তিরষ্কার করে প্যান্ডোরোকে। পিতৃতন্ত্র কামের সমস্ত পাপ, কলুষতা, অপরাধ চাপিয়ে দেয় নারীর ওপর। পিতৃতন্ত্রের চোখে নারী যৌনপ্রাণী, পুরুষ হচ্ছে মানুষ। প্যান্ডোরার উপাখ্যানের সাহায্যে নারীকে দণ্ডিত করার হয়েছে যৌনতার অপরাধে। নারী যেনো মানুষ জাতিকে পাপিষ্ট করেছে তার কামে, তাই পুরুষতন্ত্র তার শাস্তিও বিধান করেছে। নারী তার পাপের ফল ভোগ করছে জীবন দিয়ে। ‘প্যান্ডোরার সিন্দুক’ নামে যে-পৌরাণিক গল্পটি রয়েছে, তাতে সিন্দুকটি যোনির প্রতীক। পিতৃতন্ত্রের চোখে ওই কামনাজাগানো সিন্দুক থেকে জন্ম নিয়েছে জগতের সমস্ত দুঃখ।