[ছয়] বলপ্রয়োগ
পিতৃতন্ত্র নিজের আদর্শ বিশ্বজনীনভাবে বাস্তবায়নের জন্যে প্রধানত আশ্রয় নেয় সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার; কিন্তু দরকার হলে বলপ্রয়োগ করতেও দ্বিধা করে না। সামাজিকীকরণের পেছনে বলপ্রয়োগের ভয়টাকে সব সময়ই জাগিয়ে রাখে; ত্রস্ত ক’রে রাখে সবাইকে, যাতে তারা মেনে নিতে বাধ্য হয় পিতৃতন্ত্রের অনুশাসন। অধিকাংশ পিতৃতন্ত্র বলপ্রয়োগ ক’রে থাকে তার আইনপদ্ধতির মাধ্যমে; আইনপদ্ধতি হচ্ছে পিতৃতন্ত্রের বলপ্রয়োগসংস্থা। যেমন, ইসলামে যৌনবিধি লংঘনের শাস্তি খুব কঠোর। বিধান হচ্ছে পাথর ছুড়ে মৃত্যুদণ্ড। সৌদি আরবে রখনো একজন মোল্লার নেতৃত্বে পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয় ব্যভিচারিণীদের। আগে অনেক সমাজে পুরুষের ব্যভিচারকে কোনো অপরাধ ব’লেই ধরা হতো না। যখন অপরাধ গণ্য করা হতো, তখন সেটাকে মনে করা হতো কোনো পুরুষের সম্পত্তির ওপর অন্য পুরুষের হস্তক্ষেপ বলে। ব্যভিচারের শাস্তির বিধিও ছিলো একক শ্রেণীর জন্যে একেক রকম; যেমন জাপানে সামুরাইরা নিজেদের মহিমা রাখার জন্যে হত্যা করতে বাধ্য হতো তাদের ব্যভিচারিণী স্ত্রীদের; কিন্তু সাধারণ নাগরিকদের তেমন বাধ্যবাধকতা ছিলো না। প্ৰায় সব সমাজেই দেখা গেছে নিম্নশ্রেণীর কোনো পুরুষ যখন উচ্চ শ্রেণীর নারীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছে, তখন শিরচ্ছেদ করা হয়েছে দুজনেরই; কিন্তু উচ্চশ্রেণীর পুরুষ যখন ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছে নিম্নশ্রেণীর নারীর সাথে, তখন নারীটি অসতী ব’লে সমাজচ্যুত হ’লেও পুরুষটির কোনো শাস্তি হয় নি। এখনো এই নিয়ম। নিম্নশ্রেণীর পুরুষ যখন উচ্চশ্রেণীর নারীর সাথে ব্যভিচারে জড়িত হয়, তখন তারা অপরাধ করে উচ্চশ্রেণীটির বিরুদ্ধে, তাই তারা দুজনেই পায় চরম শাস্তি। এটা দ্রোহিতার শাস্তি, চলে ব্যভিচারের নামে।
পিতৃতন্ত্র তার বলপ্রয়োগের অধিকার অর্পণ করেছে পুরুষের ওপর। সমাজের নিম্নশ্রেণীর পুরুষেরা তাদের এ-অধিকার নিয়মিত প্রয়োগ ক’রে থাকে; আর উচ্চশ্রেণীর পুরুষেরা তা শারীরিকভাবে প্রয়োগ না করলেও মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রয়োগ করে ভালোভাবেই। পুরুষ মানেই সে পীড়নের অধিকার রাখে, যদিও সে পীড়ন নাও করতে পারে-এটা তার স্বাধীনতা; আর পিতৃতন্ত্র নারীকে এমনভাবে দীক্ষা দেয় যেনো সে পীড়নের শিকার হাতে বাধ্য থাকে, পীড়নকে সঙ্গত বলে মেনে নেয়। কোনো পুরুষ যখন কোনো নারীকে আক্রমণ করে, নারীটি সশস্ত্ৰ হ’লেও সহজেই অসহায় হয়ে পড়ে, কেননা পিতৃতন্ত্র তাকে শারীরিক মানসিকভাবে এভাবেই তৈরি করেছে। পিতৃতন্ত্রের নারীর ওপর বলপ্রয়োগের হিংস রূপ হচ্ছে বলাৎকার বা ধর্ষণ। আমাদের দেশে বলাৎকার নিয়মিত ঘটনা, যাতে প্ৰকাশ পায় আমাদের পিতৃতান্ত্রিক হিংস্রতা। অধিকাংশ বলাৎকারের ঘটনাই লোকলজ্জার ভয়ে নারীরা প্ৰকাশ করে না। আগে অনেক সমাজে বলাৎকারকে কোনো নারীর ওপর পীড়ন ব’লেও গণ্য করা হতো না, গণ্য করা হতো এক পুরুষের কাছে আরেক পুরুষের অপরাধ বলে, যাতে একটি পুরুষ দূষিত করেছে আরেকটি পুরুষের নারীসম্পত্তি। ফ্রয়েড তো এমন সিদ্ধান্তেই তার অনুসারীদের পোঁছে দেন যে বলাৎকার নারীর জন্যে এক ধরনের সুখ! ধর্ষণ লিঙ্গরাজনীতির এক চরম রূপ। সাহিত্যেও বলাৎকার ব্যাপারটি পুরুষেরা উপভোগ করে থাকে, লেখকেরাও ধর্ষণ বর্ণনার সময় উপভোগ করেন নারীকে চরমভাবে পর্যুদস্ত করার সুখ।
বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসেও মুক্তি ও যুদ্ধের থেকে অনেক সময় বড়ো হয়ে উঠেছে ধর্ষণ। সৈয়দ শামসুল হকের নিষিদ্ধ লোবান (১৯৮১, ১৫১) থেকে একটি উদাহরণ দিচ্ছি। পাকিস্তানি মেজরটি বিলকিসকে শারীরিক ধর্ষণের আগে ধর্ষণ করে মানসিকভাবে, যা শারীরিক ধর্ষণের থেকে অনেক বেশি হিংস্র। মানসিক ধর্ষণের রূপটি এমন :
‘আমাকে একটা কথা বলো, হিন্দুরা কি প্রতিদিন গোসল করে?’
নীরবতা।
‘হিন্দু মেয়েদের গায়ে নাকি কটু গন্ধ?’
নীরবতা।
‘তাদের জায়গাটা পরিষ্কার?’
নীরবতা।
‘আমি শুনেছি, মাদী কুকুরের মতো। সত্যি।’
‘নীরবতা।
‘শুনেছি, হয়ে যাবার পর সহজে বের করে নেয়া যায় না?’
নীরবতা।
‘আমাকে কতক্ষণ ওভাবে ধরে রাখতে পারবে?’
ধর্ষণের আগে এই যে মানসিক ধর্ষণ ও জাতিবিদ্বেষ, এতে শুধু পাকিস্তানি মেজরটি অংশ নেয় নি, অংশ নিয়েছেন লেখক নিজে ও সমগ্র পিতৃতন্ত্র। এমন পুরুষ পাওয়া যাবে না যে বাস্তবে না হ’লেও মনে মনে কোনো নারীকে বলাৎকার করে নি। পিতৃতন্ত্রের নারীবিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে বিপুল পরিমাণে রচিত নারীবিদ্বেষমূলক সাহিত্যে। ভারতে, চীনে, জাপানে ও ইউরোপে লেখা হয়েছে। এ-ধরনের বিপুল সাহিত্য। পিতৃতন্ত্র নারীর প্রতি নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে নানাভাবে : ভারতে সতীদাহ, চীনে কাঠের জুতো, আফ্রিকার কোনো কোনো দেশে মেয়েদের ভগান্ধুর কেটে ফেলা নিষ্ঠুরতার উদাহরণ। নারীর ওপর পুরুষের বলপ্রয়োগের শেষ নেই। পুরুষ চায় নারীকে সব সময় ত্রাসের মধ্যে রাখতে।
[সাত] নৃতাত্ত্বিক : পুরাণ ও ধর্ম
পিতৃতন্ত্র নারী সম্পর্কে পোষণ করে যে-সব বদ্ধমূল ধারণা, নারী তার কোনোটিরই স্রষ্টা নয়। ওই সব ধারণা সৃষ্টি করেছে পুরুষ। নারীর যে-ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে কয়েক হাজার বছরে, তার শিল্পীও পুরুষ। নারীর ওই ভাবমূর্তি পুরুষ সেভাবেই তৈরি করেছে, যা পুরুষের চাহিদা মেটায়। নৃতত্ত্ব, ধর্মীয় ও সাহিত্যিক পুরাণে রূপায়িত হয়ে আছে নারী সম্পর্কে পুরুষতন্ত্রের বিচিত্র ধারণা। পুরুষতন্ত্রের নারীধারণার মূলকথা নারী নিকৃষ্ট; কেননা নারীর শরীর ভিন্ন। নারীকে পুরুষ নিজের গোত্রের ব’লে মনে করে নি, মনে করেছে। ‘অপর’ বা শত্রু; তাই তাকে পীড়ন করার জন্যে তার ওপর বিস্তার করেছে। ব্যাপক আধিপত্য। তাকে বলেছে বিকলাঙ্গ, ঘেন্না করেছে তাকে কলুষিত বা অশুচি বলে; রেখেছে নিজের পবিত্র সীমা থেকে দূরে। নারীর যৌন বা শারীর ব্যাপারগুলোকে বিশ্বজনীনভাবেই গণ্য করা হয় অশুচি ব’লে, যার পরিচয় পাওয়া যায় পুরাণে, ধর্মগ্রন্থে, সাহিত্যে। নারীদের সৃষ্টিশীল পর্বের একটি নিযামত ব্যাপার ঋতুস্রাব। পুরাণ ও ধর্মগ্রন্থে একে অত্যন্ত অশুচি ব’লে বার বার উল্লেখ করে নারীকে দেখানো হয়েছে একটি অসুস্থ অশুচি প্রাণীরূপে, যদিও ব্যাপারটি রোগও নয় অশুচিতাও নয়। আদিম সমাজে ঋতুকালে নারীদের গ্রামের প্রান্তে কুঁড়েঘরে রাখা হয়; এবং সভ্য সমাজেও এ-সময় নারীকে গণ্য করা হয় অস্পৃশ্য। নারী ঋতুকালে যে-যন্ত্রণা বোধ করে, তার অনেকটাই মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক, কিন্তু তা-ই পুরুষতন্ত্রের বিধিবিধানের ফলে শারীরিক হয়ে ওঠে।