[পাঁচ] আর্থ ও শিক্ষা
নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে পিতৃতন্ত্র সমস্ত আর্থ কর্তৃত্ব রেখেছে পুরুষের হাতে। সমস্ত পিতৃতন্ত্ৰেই, হিন্দু-ইহুদি-খ্রিস্টান-মুসলমান, নারীর কোনো আর্থ অস্তিত্ব নেই। কোরানে আছে : ‘পুরুষ নারীর কর্তা,… আর এজন্যে যে পুরুষ ধনসম্পদ থেকে ব্যয় করে’ [৪:৩৪]। নারী নিজের অধিকারে কোনো সম্পত্তি অর্জন করতে বা সম্পত্তির মালিক হতে পারতো না। এখন এ-বিধি কিছুটা শিথিল হয়েছে, কিন্তু তাতে নারীর আর্থভিত্তি শক্ত হয় নি। নারী চিরকালই খেটেছে, পুরুষের চেয়ে বেশিই খেটেছে; কিন্তু তার পারিশ্রমিক পায় নি। আধুনিক ভদ্র পিতৃতন্ত্রে নারী কিছুটা আর্থ অধিকার পেয়েছে, কিন্তু সেখানেও নারীরা পুরুষের সমান পারিশ্রমিক পায় না। অর্থের ওপরই যেখানে নির্ভর করে সম্মান ও স্বাধীনতা, সেখানে এর অভাবের পরিণতি মারাত্মক। তারই শিকার নারী। নারীদের অধীনতার মূল কারণ আর্থিক পরনির্ভরতা; অর্থের অভাবেই তারা পরাশ্রিত। নারীরা খেখানে কোনো পেশায় নিযুক্ত হয়, বেতন পায় পুরুষদের থেকে কম; উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন নারীরাও কম যোগ্যতাসম্পন্ন পুরুষদের থেকে কম বেতন পায়। চাকুরিতে তাদের উন্নতিও ঘটে না। আধুনিক পুঁজিবাদী দেশগুলোতে নারীদের রাখা হয় সংরক্ষিত শ্রমশক্তি হিশেবে। বিপদে পড়লে উগ্র পিতৃতান্ত্রিক দেশগুলোও অবরোধ ও বোরখার ভেতর থেকে বের করে আনে তাদের সতীসাধ্বী নারীদের। যুদ্ধ বা সংকটের সময় পুরুষতন্ত্র ঘর থেকে বের ক’রে এনে নানা কাজে লাগায় নারীদের, আবার শান্তির সময় তাদের দলবেঁধে ঢোকোনো হয়। ঘরে। তখন বলা হয় গৃহই নারীর নিজের ভুবন, নারীই গৃহের শান্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পশ্চিমের দেশগুলো নারীদের লাগায় সমস্ত কাজে–এমনকি সৈনিকদের চিত্ত ও শরীরবিনোদনের কাজে, এবং যদ্ধের পর ঢোকায় ঘরে। ১৯৯১-এর উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ঘটে যুদ্ধের থেকেও তাৎপৰ্যপূর্ণ এক ঘটনা। যুদ্ধের পূর্বমুহূর্তে সৌদি আরবের মতো কঠোর পিতৃতন্ত্ৰও নারীদের ঘর থেকে বের ক’রে লাগায় নানা ‘সেবামূলক’ কাজে। যুদ্ধের সময় গৌণ হয়ে যায় পিতৃতন্ত্রের বিধান; কিন্তু যুদ্ধশেষেই তা আবার প্রবলভাবে জেগে ওঠে, নারীদের পালে পালে ঢোকানো হয় ঘরে । যুদ্ধের পরে সৌদি পিতৃতন্ত্র নারীদের সাথে আদিম আচরণ করতে ভোলে নি; তাদের এমনকি গাড়ি চালানোর অধিকারও দেয় নি। কয়েকজন উচ্চশিক্ষিত নারী বিদ্রোহ করেন, নিজেরা গাড়ি চালিয়ে বেড়িয়ে পড়েন; সৌদি পিতৃতন্ত্র তাঁদের গ্রেফতার করে, চাকুরিচ্যুত করে, এবং আরো নানা হিংস্ৰ শাস্তি দেয়, যা বাইরের জগত আজো জানতে পারে নি। সমাজতান্ত্রিক দেশে নারীদের অধিকাংশই নিয়োজিত নিচের শ্রেণীর কাজে, তবে কিছু পেশায় সেখানে নারীদের আধিক্য রয়েছে, যেমন চিকিৎসায়। কিন্তু এখানেও পিতৃতন্ত্র কৌতুক করে নারীদের নিয়ে। যে-পেশায়ই নারীরা ঢোকে, হ্রাস পায় সে-পেশারই মূল্য, কমে যায় বেতন। নারীরা যেমন বিনাবেতনে পরিবারের সেবা করে, তেমনি রাষ্ট্র ও সমাজও মনে করে যে নারীর চাকুরি হচ্ছে সেবা । পুরুষের কাছে সেবা প্রত্যাশা করা হয় না, কিন্তু নারী যেখানেই কাজ করে সেখানেই তার কাছে সেবা চাওয়া হয়, যেনে টাকার তার কোনো দরকার নেই। নারীকে অসহায় ক’রে রাখার জন্যে এটা এক সুন্দর চক্রান্ত ।
নারীর আর্থ স্বাধীনতাকে দেখা হয় কুটিল সন্দেহের চোখে । তাই পিতৃতন্ত্রের সমস্ত সংস্থা প্রচার চালায় নারীর, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারীর, পেশাগ্রহণের বিরুদ্ধে। নিম্নবিত্ত নারী নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই, তারা তো নিম্নকাজের জন্যেই জন্মেছে, খুব সস্তায় পাওয়া যায় তাদের; কিন্তু বড়োই উদ্বিগ্ন তারা মধ্যবিত্ত নারীকে নিয়ে। পরিবার, ধর্ম, মনোবিজ্ঞান, প্রচারমাধ্যম ও আরো নানা সংস্থা তিরষ্কার করতে থাকে পেশাজীবী নারীদের। বাঙলার প্রথম উচ্চশিক্ষিত নারীরা পিতা, বা স্বামীর পবিবারের আদেশে, বা সামাজিক নিন্দায় পেশাগ্ৰহণ থেকে বিরত থেকেছেন বা পেশাগ্রহণে বিলম্ব করেছেন: অনেকে বিয়ের পর বিয়েকেই পেশারূপে গণ্য ক’রে আর্থিক চাকুরি ছেড়ে দিয়েছেন। নিম্নশ্রেণীর নারীদের কাজ নিয়ে পিতৃতন্ত্রের দুশ্চিন্তা নেই, বরঙ তারা কাজ না করলেই আতংকিত বোধ করে করে পিতৃতন্ত্র; কারণ তারা শস্তা। তারা মধ্যবিত্ত নারীদের মতো ভয়াবহ নয়, তাদের নিয়ে কোনো ভয় নেই। মধ্যবিত্ত নারীরা যদি কাজ করে-বিচার, চিকিৎসা, অধ্যাপনা করে, আমলা হয়, তাহলে তা পিতৃতন্ত্রের বা পুরুষতন্ত্রের আর্থ ও মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তিটাকেই ভেঙে দিতে পারে। পেশাজীবী নারীরা আসলে নিযুক্ত থাকে দুটি পেশায়;— তাদের ঘরসংসার দেখতে ও সন্তান পালন করতে হয়, আর পালন করতে হয় পেশার দায়িত্ব। পেশাকে তারা পুরোপুরি পেশা হিশেবে নিতে পারে না, পরিবারই হয়ে থাকে তাদের মূলপেশা। পৃথিবী জুড়ে নারীরা যে-সব পেশায় এখন জড়িত, তা শ্রমিকের পেশা: তাই তাদের নির্দেশ করা যায় সাম্প্রতিক বিশ্বের প্রধান শ্রমিক শ্রেণীরূপে।
পৃথিবী জুড়ে নারী এখনো শিক্ষা থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে; আর যারা শিক্ষা পাচ্ছে, তারাও ঠিক শিক্ষা পাচ্ছে না। পুরুষতন্ত্র তাদের সে-শিক্ষাই দিতে আগ্রহী, যা নারীদের নারী ক’রে রাখে, যা পরিশেষে কল্যাণে আসে পুরুষের। পুরুষ প্রথমে নারীদের লেখাপড়া শেখাতেই রাজি হয় নি, বা মূর্খের মতো কিছুটা ধর্মশাস্ত্ৰ শিখিয়েছে; পরে যখন বিদ্যালয়ে পাঠাতে বাধ্য হয়েছে, তখনো বের করেছে বিশেষ একধরনের নারীশিক্ষা। উনিশশতকের বাঙলার নারীশিক্ষার এ-রূপ সম্পর্কে রাজনারায়ণ বসু (১৮৭৪, ৪৭-৪৮) বলেছেন, ‘স্ত্রীলোকদিগকে যেরূপ শিক্ষা দেওয়া হইতেছে, তাহা তাহাদিগকে কেবল অশ্লীল গল্প ও নাটক পাঠে পারগ করে’, আর ‘তাহারা কেবল কার্পেটই বুনছে, কার্পেটই বুনছে। যদি তাহা না করিয়া পিরাণ শিলাই করিতে শিখে, তাহা হইলেও জানিলাম যে, কিছু উপকারে আইল।‘ পুরুষ নিজের স্বার্থে নারীদের যে শিক্ষা দেয়, তা হয়ে ওঠে এমনই নিরর্থক ও হাস্যকর। পুরুষদের একটি যুক্তি হচ্ছে নারীর দেহ সব রকম শিক্ষার উপযুক্ত নয়। ক্রীতদাস একসময় বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। প্রভুর দর্শনে, নারীরাও প্রচার করে পুরুষের দর্শন। এর পরিচয় পাওয়া যায় শিক্ষিতা ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর উক্তিতে। এ-আধুনিকাও মনে করেন, ‘গৃহধর্ম নারীজীবনের সারবস্তু, যাহার জন্য সমাজে নারীর স্থান ও মান’, আর নারীর দেহ খুবই পেলাব, তাই তিনি ‘বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষকে মনে রাখতে’ বলেছেন যে ‘পরীক্ষা দেওয়াই নারীজীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য নহে।’ এ-আধুনিকার মতে, বঙ্গরমণীর শরীর মন ও ভবিষ্যৎ জীবনের গঠন স্মরণ রাখিয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার কঠিন সংগ্রামে তাহাদের যোগ দিতে না দেওয়াই ভালো।‘ কারণ ‘স্ত্রীলোক ও পুরুষের ভবিষ্যৎ জীবন এমন স্বতন্ত্র ছাচে ভগবান টালিয়াছেন, তখন শেষ পর্যন্ত তাহাদের একই রকম শিক্ষা দেওয়া কখনই সমীচীন নহে’ [ দ্র ইন্দিরা (১৯২০, ১৩-১৫)। এ হচ্ছে নারীর কণ্ঠে পুরুষতন্ত্রের উক্তি, বা দাসীর মুখে প্রভুর ভাষা। আধুনিক পিতৃতন্ত্রগুলো এখন নারীদের জন্যে উচ্চশিক্ষার সমস্ত দরোজা খুলে দিয়েছে; তবে নারীপুরুষের উচ্চশিক্ষার বিষয় ও মানে পরিকল্পিত পার্থক্য রাখতে তারা ভোলে নি। শৈশব থেকেই পিতৃতন্ত্র ঠিক ক’রে দেয় ছেলেরা ঢুকবে কোন দরোজা দিয়ে আর মেয়েরা কোন দরোজা দিয়ে। শিক্ষার ক্ষেত্রেও রয়েছে কিছু নারীর বিষয় কিছু পুরুষের বিষয়। মনে করা হয় যে নারীরা পড়বে মানববিদ্যা ও সমাজবিদ্যার কিছু গৌণ বিষয়; আর পুরুষেরা পড়বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা, প্রকৌশল, ব্যবসাশাস্ত্র প্রভৃতি। আজকের পৃথিবীতে মান-সম্মান-অর্থ রয়েছে। পুরুষের বিদ্যাগুলোতে; আর এগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণের অর্থ হচ্ছে রাজনীতিক আধিপত্য বা শক্তি। পিতৃতন্ত্র লিঙ্গানুসারে মর্যাদা স্থির করে; যে-সমস্ত এলাকায় পুরুষের আধিপত্য সেগুলো ভোগ করে অবিমিশ্র মর্যাদা, আর যেগুলোতে পুরুষের প্রাধান্য নেই বা রয়েছে নারীর অংশ, সেগুলোর মর্যাদা কম। তাই মানববিদ্যা পায় কম মর্যাদা, কেননা এগুলোতে পুরুষাধিপত্য নেই; আর বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, ব্যবসা, সামরিক বাহিনী পায় নিরঙ্কুশ মর্যাদা, কেননা এগুলোতে পুরুষতন্ত্রের প্রতাপ অপ্রতিহত।