পিতৃতন্ত্রে পিতা কুলপতি; তিনিই সব কিছুর মালিক। পিতা মালিক তার স্ত্রীর বা স্ত্রীদের, সন্তানদের; পিতার অধিকার রয়েছে স্ত্রী ও সন্তানদের প্রহারের, এমনকি বিক্রি ও হত্যার! পিতৃতন্ত্রে আত্মীয়তার ধারা পুরুষপরম্পরায় প্রবাহিত হয়; উত্তরাধিকার নির্ণয় করা হয় পুত্রপৌত্রাক্রমে। দুহিতা ও দৌহিত্রাক্রম এক সময় হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন। গোত্ৰতা অনুসারে নারীপরম্পরার উত্তরাধিকারীরা সম্পত্তিব অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের ক্রিয়াকলাপ, রোমের পত্রিয়া পোতেসতেস অনুসারে, প্রথম নির্দেশ করেছিলেন হেনরি মেইন। তাঁর মতে পরিবারের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুরুষটি সার্বভৌম। তার আধিপত্য জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রসারিত; আর ওই আধিপত্য তার সন্তানাদি, তাদের ঘরবাড়ি থেকে দাসদাসীর ওপর বিস্তৃত। আদিম পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে জ্যেষ্ঠ পুরুষটির একনায়কত্বের অধীনে সবাই ও সব কিছু-স্ত্রী, সন্তান, জমিজমা, সজীব বা অজীব সম্পত্তি, দাসদাসী প্রভৃতি। মেইন অবশ্য মনে কবতেন যে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার বিশ্বজনীন ব্যাপার, কিন্তু তা নয়। অনেকেই মনে করেন যে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের প্রতিষ্ঠা হয়েছে বেশ পরে, নারীদের অধিকার ধীরেধীরে হরণ করে। সাম্প্রতিক পিতৃতন্ত্রে পুরুষের আধিপত্য কিছুটা কমানো হয়ছে নারীদের কিছুটা অধিকার দিয়ে; যেমন দেয়া হয়েছে নারীদের বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার, নাগরিকত্ব, সম্পত্তির মালিক হওয়ার অধিকার। তবে তারা এখনো স্বামীদের অস্থাবর সম্পত্তিই রয়ে গেছে। পিতৃতন্ত্র পরিবারকে দেয় একটি বড়ো দায়িত্ব, আর পরিবার সেটি পালন করে চমৎকারভাবে। পরিবারকে দেয়া হয় তার সন্তানসন্ততিদের সামাজিকীকরণের ভার। পরিবার পিতৃতন্ত্রের আদর্শানুসারে গড়ে তোলে পুত্র ও কন্যাদের, শিখিয়ে দেয়। তারা পালন করবে। কোন ভূমিকা, কার মেজাজ হবে কেমন, আর অবস্থান হবে কোথায়। রয়েছে পিতৃতন্ত্রের আরো নানা সংস্থা-বিদ্যালয়, পুরোহিত, প্রচারমাধ্যম, এবং কী নয়? প্রতিষ্ঠা করা হয় জীবনের সমস্ত এলাকায় পুরুষাধিপত্য, নারীকে করা হয় অধীন। পিতৃতন্ত্র নারীর সতীত্বের ও সন্তানের বৈধতার ওপর দিয়ে থাকে চরম গুরুত্ব; এর কারণও পুরুষাধিপত্য অক্ষুন্ন রাখা। এর সাহায্যে সন্তান ও মাতাকে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ক’রে তোলা হয় পুরুষের ওপর।
[চার] শ্রেণী
লিঙ্গের ক্ষেত্রে বর্ণ দুটি : ব্ৰাহ্মণ ও শূদ্র। পুরুষ ব্ৰাহ্মণ, নারী শূদ্র বা পুরুষ বুর্জোয়া, নারী প্রলেতারিয়েত। তবে লিঙ্গের এলাকায় শ্রেণী ব্যাপারটি ঢাকা থাকে ধুয়োজালে, তাই সত্য সহজে চোখে পড়ে না। যে-সমাজে মানুষের অবস্থান বা মর্যাদা নির্ভর করে সামাজিক, আর্থিক, শিক্ষাগত পরিস্থিতির ওপর, সেখানে কিছু নারী কিছু পুরুষের ওপরে মর্যাদা পায়; এ-কারণেই ঘোলাটে হয়ে ওঠে লিঙ্গগত শ্রেণীর ব্যাপারটি। একটি উদাহরণ দিই। হিন্দুসমাজের একজন শূদ্র চিকিৎসক বা আইনজীবী শিক্ষা ও অর্থের কারণে একজন ব্ৰাহ্মণ চাষীর থেকে বেশি গুরুত্ব পায়, কিন্তু ব্ৰাহ্মণটি বর্ণের কারণেই ভোগ করে বেশি মর্যাদা। নিম্নবর্ণের চিকিৎসক বা আইনজীবী অর্থ ও শিক্ষা দিয়েও ওই মর্যাদা আয়ত্ত করতে পারে না, বরং ভোগ করে মানসিক যন্ত্রণা। ঠিক তেমনই একটি শ্রমিক বা রিকশাআলা নিজের পৌরুষের জন্যেই উচ্চ শ্রেণীর নারীর থেকেও বেশি মর্যাদা পায় বা দাবি করে। তৈক্তিরীয় সংহিতায় আছে, ‘সর্বগুণান্বিতা নারীও অধমতম পুরুষের থেকে হীন।’ ইসলামে একজন পুরুষ দুজন নারীর সমান; ওই পুরুষটি যে-ই হোক, ওই দুই নারী যারাই হোক। কোরানে আছে : ‘তোমাদের পছন্দ মতো দুজন পুরুষকে সাক্ষী রাখবে, আর যদি দুজন পুরুষ না থাকে, তবে একজন পুরুষ ও দুজন স্ত্রীলোক’ [২ : ২৮২]; তাই একটি বিকলাঙ্গ ভিখিরিও একজন মহিলা রাষ্ট্রপতির দ্বিগুণ মৰ্যাদাসম্পন্ন। পাকিস্তানে একটি পুরুষ চোরকে শনাক্ত করতে দরকার হয় দুটি নারীপুলিশ! জনহীন কক্ষে নারী প্রধান মন্ত্রীও অসহায় হয়ে উঠতে পারে তার ভূত্যের কাছে; ভূত্য হয়ে উঠতে পারে প্রভু আর নারী প্রধান মন্ত্রী দাসী। যে-অঞ্চলে পিতৃতন্ত্র যতো উগ্র, সেখানে নারীর শ্ৰেণী-অবস্থান ততো নিচে ও ততো স্পষ্ট। পাশ্চাতো পিতৃতন্ত্র কিছুটা নমনীয় ব’লে সেখানে নারীর শ্রেণীগত অবস্থান ততোটা নিচে নয়, কিন্তু প্রাচ্যে উগ্র অনমনীয় পিতৃতন্ত্র নারীকে শূদ্র করে রেখেছে। হিন্দু আর মুসলমানদের একটি বড়ো অংশ উগ্ৰ পিতৃতন্ত্রের ধারক বলে এ-দু-সমাজে আজো নারীদের শ্রেণীগত অবস্থান অত্যন্ত নিচে।
পিতৃতন্ত্রের একটি সুন্দর ষড়যন্ত্র হচ্ছে নারীদের এক শ্রেণীকে লাগিয়ে রাখা আরেক শ্রেণীর বিরুদ্ধে; বেশ্যার বিরুদ্ধে লাগিয়ে রাখা সতীকে, কর্মজীবী নারীর বিরুদ্ধে লাগিয়ে রাখা গৃহিণীকে। একদল ঈর্ষা করে আরেক দলের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নিরাপত্তাকে; আবার আরেক দল নিরাপত্তা মৰ্যাদার অবরোধের মধ্যে বাস ক’রে ঈর্ষা করে অন্য দলের স্বাধীনতা ও মুক্তিকে। পুরুষ বিচরণ করে ঘরে-বাইরের দু-জগতেই; আর নিজের সামাজিক আর্থনীতিক ক্ষমতার সাহায্যে নারীদের দু’দলকে লিপ্ত রাখে চিরশত্ৰুতায়। নারী জন্মসূত্রে কোনো এক বিশেষ পরিবার ও শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত; কিন্তু আসলে নারী কোনো পরিবার বা শ্রেণীর সাথেই অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত নয়। নারী যেহেতু আর্থিকভাবে পুরুষনির্ভর, তাই যে-কোনো শ্রেণীর সাথে তার সম্পর্ক অস্থির ও অনিশ্চিত, যে-কোনো সময় তা ছিন্ন হয়ে নারী নেমে যেতে পারে নিম্নতম শ্রেণীতে। নারীর কখনোই শ্রেণী-উন্নতি ঘটে না; যদি জন্মশ্রেণীতে থাকতে না পারে, তাহলে ঘটে তার শ্রেণী-অবনতি। হিন্দুসমাজে অনুলোম ও প্রতিলোম বিবাহ বলে দু-রকম বিয়ে রয়েছে। নিম্নবর্ণের পুরুষ ও উচ্চবর্ণের নারীর বিয়ে প্রতিলোম বিবাহ; এবং উচ্চবর্ণের পুরুষ ও নিম্নবর্ণের নারীর বিয়ে অনুলোম বিবাহ। অনুলোম বিবাহে উচ্চবর্ণের পুরুষকে বিয়ে ক’রেও নারীর বর্ণোন্নতি ঘটে না, আর প্রতিলোম বিবাহের ফলে নারীর ঘটে বর্ণচ্যুতি; অর্থাৎ সমাজচ্যুতি। জর্মনিতেও ছিলো একই রীতি। মধ্যযুগে জার্মনিতে একজন নিম্নশ্রেণীর পুরুষ যখন উচ্চশ্রেণীর নারীকে বিয়ে করতো, প্রতিলোম বিয়ের মতো নারীটি থাকতো জাতিচ্যুত; আবার নিম্নশ্রেণীর নারী যখন কোনো উচ্চশ্রেণীর পুরুষকে বিয়ে করতো তখন সে স্বামীর শ্রেণীতে উঠতো না [দ্র ভূপেন্দ্রনাথ (১৯৪৬, ৮৬-৮৯)]। মুসলমানদের মধ্যেও একই রকম ঘটে; উচ্চশ্রেণীর মুসলমানেরা দাসীসম্ভোগে উৎসাহ বোধ করে, ধর্মে তার বিধানও রয়েছে, এবং বাধ্য হয়ে বিয়েও করে; কিন্তু ওই নারীটির শ্রেণী-উন্নতি ঘটে না। এখনো শিক্ষিত কোনো নারী যদি বিয়ে করে কোনো অশিক্ষিত পুরুষকে, তবে পুরুষটির উন্নতি ঘটে না; সৃষ্টি হয় এক কেলেঙ্কারি, নারীটি সমাজের তলদেশে নেমে যায়। তার কোনো ভবিষ্যৎ থাকে না। শুধু নিজের ওপর নির্ভর করতে হ’লে খুব কম নারীই শ্রমিক শ্রেণীর চেয়ে কোনো উচ্চশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হবে। কোটিপতির স্ত্রী একদিনে দাসী হয়ে উঠতে পারে। তাই তারা পরগাছার মতো জীবন ধারণ করে–তারা হয় পরগাছার পরগাছা; এবং নিজেদের রক্ষার জন্যেই হয়ে ওঠে রক্ষণশীল, যারা তাদের ভরণপোষণ করে তাদের সমৃদ্ধির সাথে আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজেদের জীবনকে জড়িয়ে রাখার। দাস যেমন প্রভুর সমৃদ্ধিকে মনে করে নিজের সমৃদ্ধি নারীও স্বামীর বা পুত্রের, অর্থাৎ পুরুষের, সমৃদ্ধিকে মনে করে নিজের সমৃদ্ধি। তারা নিজেদের মুক্তির কথা ভাবতেও পারে না।