পুরুষনারীর মধ্যে যদি থাকে কোনো সহজাত অসাম্য, তা প্রমাণ করার উপায় হচ্ছে তাদের সমান সুযোগসুবিধা দেয়া ও দেখা কোথায় রয়েছে কোন লিঙ্গের সহজাত অপকর্ষ। এমন পরিবেশ এখন কোথাও নেই। এখন নারীপুরুষের স্বভাব নিয়ে যে-সব গবেষণা হচ্ছে, তাতে দেখা যায় মেয়েলি-পুরুষালি হিশেবে যা-কিছুকে শাশ্বত ব’লে ধ’রে নেয়া হয়েছে, সে-সব আসলে সাংস্কৃতিক। বাঙলায় একটিই শব্দ আছে: লিঙ্গ, ইংরেজিতে আছে দুটি : সেক্স, ও জেন্ডার। সাম্প্রতিক লিঙ্গবিশেষজ্ঞরা, যেমন কালিফোর্নিয়া লিঙ্গশনাক্তি কেন্দ্রের রবার্ট জে স্টোলার, নির্দেশ করেছেন ‘সেক্স’ ও ‘জেন্ডার’-এর পার্থক্য। ‘সেক্স’ জৈব, আর ‘জেন্ডার’ মনস্তাত্ত্বিক, অর্থাৎ সাংস্কৃতিক। ‘পুরুষ’, ‘নারী’ বললে বোঝায় জৈবলিঙ্গ [সেক্স], আর ‘পুরুষালি’, ‘মেয়েলি’, ‘পুরুষসুলভ’, ‘নারীসুলভ’ বোঝায় সাংস্কৃতিক লিঙ্গ জেন্ডার। সাংস্কৃতিক লিঙ্গ ও জৈবলিঙ্গ অবিচ্ছেদ্য নয়; পুরুষ হতে পারে মেয়েলি, নারী হতে পারে পুরুষালি। স্টোলার বলেছেন, ‘বাহ্যিক জননেন্দ্ৰিয়গুলো (শিশ্ন, অণ্ডকোষ, মুষ্ক) যদিও সাহায্য করে পৌরুষবোধে, তবে এর জন্যে কোনোটিই প্রয়োজনীয় নয়, সবগুলোর একত্রে প্রয়োজন তো নেই-ই।… সাংস্কৃতিক লিঙ্গ নির্ধারিত হয় জন্মোত্তর বিভিন্ন শক্তির দ্বারা, বাহ্যিক জননেন্দ্ৰিয়গুলোর গঠন যাই-হোক-না কেনো’ [“দ্র মিলেট (১৯৬৯, ৩০)]। এখন তো মনে করাই হয় যে মানবভ্রূণ আদিতে থাকে নারী; গর্ভধারণের কিছু পরেই শুধু মাত্র একটি ওয়াই ক্রোমোসোমের ক্রিয়ায় ভ্রূণটি পুরুষে পরিণত হয়। নারীপুরুষ মেয়েলি বা পুরুষালি গুণ নিয়ে জন্ম নেয় না; জন্মের পরে সমাজসংস্কৃতির চাপে তারা অর্জন করে মনোলৈঙ্গিক ব্যক্তিত্ব।
জন্মের পরে মানুষকে আবার জন্ম দেয়া হয়; মানুষমাত্রই দ্বিজ। জন্মের পর থেকে শুরু হয় পুত্রকে পুরুষ আর কন্যাকে নারীরূপে দ্বিতীয় জন্ম দেয়া: এবং নারী ও পুরুষ হয়ে ওঠে দুই সংস্কৃতির অধিবাসী। তাদের জীবন, জগৎ অভিজ্ঞতা, স্বপ্ন হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। শৈশব থেকেই বাবা-মা, সমাজ-সংস্কৃতি-সভ্যতা শেখায় মেজাজ কেমন হবে তাদের; তারা হাসবে, দাঁড়াবে, বসবে কীভাবে; পালন করবে তারা কী ভূমিকা, আর কার হবে কী মর্যাদা বা অবস্থান। তাই নারী ও পুরুষ নারী ও পুরুষ হয়ে জন্ম নেয় না, সামাজিকীকরণপ্রক্রিয়ায় তাদের নারী ও পুরুষ ক’রে তোলা হয়। পিতৃতন্ত্রের জৈবিক ভিত্তি দুর্বল; তাই নারীকে নারী ও পুরুষকে পুরুষ ক’রে তোলার জন্যে চলে ধারাবাহিক সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া। তাদের, শৈশব থেকেই, অভ্যস্ত ক’রে তোলা হয় নারী বা পুরুষের ভূমিকায়। প্রতিটি সংস্কৃতি চায় ছেলেরা হবে সক্রিয় বা আক্রমণাত্মক, আর মেয়েরা হবে নিষ্ক্রিয়, অন্তর্মুখি বা আত্মসমৰ্পণাত্মক; তাই ছেলেরা হয় মাস্তান আর মেয়েরা থাকে একটি রন্ধ নিয়ে বিব্রত। এটা যে সাংস্কৃতিক ব্যাপার, তা স্বীকার না ক’রে পিতৃতন্ত্ৰ মনে করে পুরুষের পৌরুষ বাস করে তার একটি ঝুলন্ত নির্বোধ প্রত্যঙ্গে ও তার নিচে থলের ভেতরের একজোড়া অণ্ডকোষে! আধুনিক সব সংস্কৃতিই ধ’রে নেয় সক্রিয়তা বা আক্রমণাত্মকতা হচ্ছে পৌরুষ, নিষ্ক্রিয়তা বা ভীরুতা হচ্ছে নারীত্ব। তবে মার্গারেট মিড তিনটি আদিম সমাজে লিঙ্গ ও মেজাজ (১৯৩৫), দক্ষিণ সমুদ্র থেকে (১৯৩৯), নর ও নারী (১৯৫৫) প্রভৃতি গ্রন্থে দেখিয়েছেন এটা সব সংস্কৃতির জন্যেও সত্য নয়। তিনি প্রশান্ত মহাসাগরীয় নারীপুরুষের প্রকৃতি সম্পর্কিত গবেষণায় দেখিয়েছেন নারীপুরুষের সক্রিয়তা/নিষ্ক্রিয়তা ধ্রুব বিশ্বজনীন ব্যাপার নয়। ওই এলাকার আরাপেশদের নারীপুরুষ উভয়ই ‘মেয়েলি’ ও ‘মাতৃসুলভ এবং নিক্রিয়; এর কারণ তাদের ছেলেবেলা থেকে শেখানো হয় একে অন্যকে সহায়তা করতে। আবার মুন্ডুণ্ডমরদের নারীপুরুষ উভয়ই প্ৰচণ্ড, আক্রমণাত্মক, ‘পুরুষালি’; এবং চামবুলিদের নারীরা আধিপত্যপরায়ণ, আর পুরুষেরা অধীনতাপরায়ণ [দ্র ফ্রাইডান (১৯৬৩, ১২০)]। তাই পুরুষের পৌরুষ আর নারীর নারীত্ব বা মেয়েলিপনা জৈবিক তো নয়ই, এমনকি সৰ্ব্বজনীনও নয়।
[তিন] সমাজতাত্ত্বিক
পিতৃতন্ত্র সৃষ্টি করেছে নানা রকম সংস্থা, তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে পরিবার। সমাজ ও রাষ্ট্র নরনারীদেব সব সময় সরাসরি শাসন করতে পারে না, তাই পিতৃতন্ত্র পরিবারের সাহায্যে শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিটি ব্যক্তিকে। তাদের বাধ্য করে পিতৃতন্ত্রের বিধি মেনে চলতে। পরিবার কাজ করে বৃহত্তর সমাজের প্রতিনিধিরূপে: পরিবার তার সদস্যদের খাপ খাওয়ায় পিতৃতন্ত্রের আদর্শের সাথে। পরিবার অনেকটা পিতৃতান্ত্রিক রাষ্টের ভেতরে রাষ্ট্র; আর পরিবার-রাষ্ট্রের পতি হচ্ছে পরিবারের প্রধান পুরুষটি। রাষ্ট্র পরিবারের প্রধান পুরুষটির মাধ্যমে শাসন করে নাগরিকদের। এ-শাসনের বিশেষ শিকার নারীরা। যে-সব পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীদের আইনসঙ্গত নাগরিক অধিকারও দেয়া হয়েছে, সেখানেও দেখা যায় নারী শাসিত হয় পরিবারের দ্বারাই। রাষ্ট্রের সাথে সাধারণত নারীদের কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকে না, বা থাকে খুবই সামান্য।
পিতৃতন্ত্রের তিনটি সংস্থা–পরিবার, সমাজ, ও রাষ্ট্র একে অন্যের সাথে গভীরভাবে জড়িত, ও পরস্পরনির্ভরশীল। টিকে থাকার জন্যে পিতৃতন্ত্র পরিবারের প্রধান পুরুষটিকেই দিয়েছে সমস্ত কর্তৃত্ব; এবং তা ধর্মীয় বিধানের সাহায্যে বিধিবদ্ধ করেছে। মনুসংহিতায় [৯:৩] বলা হয়েছে, ‘পিতা রক্ষতি কৌমারে, ভর্তা রক্ষতি যৌবনে। রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্রমর্হতি’ : কুমারীকালে পিতা, যৌবনে স্বামী ও বার্ধক্যে পুত্ররা রক্ষা করবে নারীকে; নারী স্বাধীনতার অযোগ্য। ইহুদিধর্মে পিতা পেয়ে থাকে পুরোহিতের অধিকার; বাইবেলে সদাপ্ৰভু নারীকে বলে, ‘সে তোমার উপরে কর্তৃত্ব করিবে [মানবজাতির পাপে পতন : আদিপুস্তক]; ক্যাথলিকদের বিধান হচ্ছে ‘পিতাই পরিবারের কর্তা’; কোরানে আছে : ‘পুরুষ নারীর কর্তা’ [৪:৩৪]; এবং হাদিসে পুরুষকে দ্বিতীয় বিধাতায় পরিণত করা হয়েছে : ‘যদি আমি অন্য কাউকে সিজদা করতে আদেশ দিতাম তাহলে নারীদেরই বলতাম তাদের স্বামীদের সিজদা করতে’ [ দ্র রফিক (১৯৭৯, ১৮১)]। আধুনিক সরকারগুলো মেনে চলে এসব বিধানই; সব ক্ষেত্রেই পুরুষকে গণ্য করে পরিবারের প্রধানরূপে।