শুরুতেই মিলেট হেনরি মিলারের সেক্সাস, নরম্যান মেইলারের অ্যান আমেরিকান ড্রিম, জাঁ জোনের দি থিফ্স্ জর্নাল ও আওয়া্র লেডি অফ দি ফ্লাওয়ার্স থেকে নারীপুরুষের অন্তরঙ্গতম সম্পর্ক সঙ্গমে লৈঙ্গিক রাজনীতির পরিচয় দিয়েছেন; দেখিয়েছেন সঙ্গমেও সক্রিয় থাকে আধিপত্য ও ক্ষমতা (বা শক্তি)। এটা শুধু জৈব ও শারীরিক ক্রিয়া নয়, ব্যক্তিগত পর্যায়ে সঙ্গম হচ্ছে লৈঙ্গিক রাজনীতি। প্রশ্ন উঠবে। সঙ্গমের মতো অন্তরঙ্গ মিলনকে এবং নারীপুরুষের সম্পর্ককে রাজনীতির সীমার মধ্যে আনা যায় কিনা? এটা নির্ভর করে ‘রাজনীতি’ বলতে কী বুঝি আমরা, তার ওপর। রাজনীতি বলতে মিলেট বুঝিয়েছেন ক্ষমতাসংগঠন বা বিন্যাসকে, যার সাহায্যে একদল মানুষ নিয়ন্ত্রণ করে আরেক দল মানুষকে। শুধু এ-রাজনীতি ধারণার সাহায্যেই বোঝা সম্ভব নারীপুরুষের ঐতিহাসিক ও বর্তমান অবস্থান বা মৰ্যাদা। ‘রাজনীতি’ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ, তবে নারীপুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ আপত্তিকর বা অশ্লীল মনে হতে পারে অনেকের কাছে; কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে যে অশ্লীল এখন সত্য আর সত্য এখন অশ্লীল! আগে জন্মসূত্রেই একদল আধিপত্য করতো আরেক দলের ওপর, এখন করে না; কিন্তু এখনো, পুরোনো কাল থেকেই, চলছে জন্মাধিকারবশতই মানুষের একদলের ওপর আরেক দলের আধিপত্য; সেটা লিঙ্গের, নারীপুরুষের, এলাকায়। এখন, ও ঐতিহাসিকভাবে, নারীপুরুষের সম্পর্ক হচ্ছে আধিপত্য ও অধীনতার। পৃথিবী জুড়েই চলছে, কিন্তু চোখে পড়ে না বা স্বীকার করা হয় না যে জন্মাধিকার বলেই পুরুষেরা শাসন করছে নারীদের। এ-পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। চমৎকার একধরনের ‘আভ্যন্তর ঔপনিবেশিকতা’। এর কারণ হচ্ছে সমস্ত পুরোনো ও আমাদের ‘সভ্যতা’ পিতৃতান্ত্রিক। এটা এতো স্পষ্ট যে চোখে পড়ে না : সামরিক, শিল্পকারখানা, বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান, রাজনীতিক কাৰ্যালয়, পুলিশ,-সমাজের ক্ষমতার সমস্ত এলাকাই পুরুষের হাতে। রাজনীতির মূলকথা হচ্ছে ক্ষমতা। ওই ক্ষমতা পুরুষের নিয়ন্ত্রণে; আর অলৌকিক ঈশ্বর, রাষ্ট্রপতি ও তার মন্ত্রণালয়, সমস্ত নীতি ও মূল্যবোধ, দর্শন ও শিল্পকলা সবই পুরুষের তৈরি। পিতৃতন্ত্রের বড়ো ষড়যন্ত্র হচ্ছে যে পুরুষ আধিপত্য করবে নারীর ওপর। আবহমান কাল ধ’রে পথিবী জুড়ে এটা চলছে। পিতৃতন্ত্র নারীর ওপর আধিপত্য করার জন্যে গ্ৰহণ করেছে সার্বিক পরিকল্পনা। মিলেট (১৯৬৯, ২৬-৫৮) সেগুলোকে ভাগ করেছেন : [এক] ভাবাদর্শগত, [দুই] জৈবিক, [তিন] সমাজতাত্ত্বিক [চার] শ্রেণী, [পাঁচ] আর্থ ও শিক্ষাগত, [ছয়] বলপ্রয়োগ, [সাত] নৃতাত্ত্বিক : পুরাণ ও ধর্ম, ও [আট] মনস্তাত্ত্বিক ভাগে। এগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিলে বোঝা যাবে পিতৃতন্ত্রের পুরুষাধিপত্যের ক্রূর পরিকল্পনা কতো ব্যাপক।
[এক] ভাবাদর্শ
কোনো সরকার ক্ষমতায় আসে দু-উপায়ে; সকলের সম্মতিতে, বা বলপ্রয়োগে। মানুষকে কোনো একটি ভাবাদর্শে দীক্ষিত করতে পারলে তাদের সম্মতি পাওয়া সহজ হয়ে ওঠে। লৈঙ্গিক রাজনীতি পুরুষ-নারী দু-লিঙ্গেরই সম্মতি আদায় করে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। পিতৃতন্ত্র পুরুষ ও নারীর জন্যে যে-মেজাজ, ভূমিকা, ও অবস্থান স্থির করে, সামাজিকীকরণের ফলে তা মেনে নেয় তারা। পুরুষই শ্রেষ্ঠ, এমন একটি কুসংস্কার বদ্ধমূল ক’রে তোলে পুরুষতন্ত্র, তাই অবস্থানগতভাবে পুরুষ পায় উচ্চ মর্যাদা, নারী পায় নিম্ন মর্যাদা। পুরুষ তা মেনে নেয় ও ভোগ করে তার জন্ম-অধিকার ব’লে, আর নারীও তা বিশ্বাস ও স্বীকার করে। মেজাজ গড়ে তোলে মানুষের ব্যক্তিত্ব। পুরুষতন্ত্র আপন স্বার্থে লিঙ্গ-অনুসারে পরিকল্পিত বিশেষ ছকে বেঁধে দিয়েছে নারীপুরুষের ব্যক্তিত্বকে; স্থির হয়ে গেছে যে পুরুষ হবে আক্রমণাত্মক, বুদ্ধিমান, বলশালী, ফলপ্ৰদ, আর নারী হবে নিষ্ক্রিয়, মূর্খ, বশমানা, সতী ও অপদার্থ। এর প্রকাশ দেখা যায় নারীপুরুষের লৈঙ্গিক ভূমিকায়। পিতৃতন্ত্র তাদের জন্যে তৈরি করেছে বিশদ বিধিমালা, স্থির করে দিয়েছে কীভাবে আচরণ করবে নারীপুরুষ : কেমন অঙ্গভঙ্গি করবে, ও পোষণ করবে কী প্রবণতা। স্থির করে দিয়েছে যে নারী দেখবে ঘরসংসার, পালন করবে সন্তান; আর পুরুষ অর্জন করবে অন্যান্য সাফল্য। এতে নারী রয়ে গেছে পশুর স্তরেই, পশুরাও সন্তান লালনপালন করে; আর পুরুষ উন্নীত হয়েছে মানুষের স্তরে;–যে-সব কাজ বিশেষভাবেই মানবিক, তার সবই রাখা হয়েছে পুরুষের জন্যে। পুরুষকে দেয়া হয়েছে উচ্চ অবস্থান, যা তাকে করেছে প্ৰভু আর তার ভূমিকা যেহেতু প্রভুর, তাই তার মেজাজও হয়ে উঠেছে পুভুর অর্থাৎ আধিপত্যবাদী। নারীর ভূমিকা দাসীর, তাই তার মেজাজও অধীনস্থের। পুরুষের চোখে নারীর ভূমিকা চারটি : মাতা, কন্যা, বধু; এ-তিনটির কোনোটি না হ’লে নারী হয় উর্বশী অর্থাৎ পতিতা। শুধু নারীরূপে নারী কোনো মর্যাদা পায় না।
[দুই] জৈবিক
পিতৃতান্ত্রিক ধর্ম, সাধারণ বিশ্বাস, এবং অনেকাংশে বিজ্ঞানও, মনে করে যে নারীপুরুষের সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্যের মূলে রয়েছে তাদের শারীরিক পার্থক্য। সংস্কৃতি যে মানুষের স্বভাবকে নিয়ন্ত্রণ করে, তা গোপন ক’রে পুরুষতন্ত্র প্রচার যে সংস্কৃতি বিকাশ ঘটায় স্বভাবের। এমন ধারণা তৈরি করা হয়ে গেছে যে পৌরুষ ও নারীত্ব সহজাত; কিন্তু নারীপুরুষের নারীত্ব ও পৌরুষ কোনো সহজাত ব্যাপার নয়, তাদের অবস্থান ও মর্যাদা পুরোপুরি অস্বাভাবিক। পুরুষের শরীর পেশল হয, এটা অনেকটা জৈবিকা; তবে সাংস্কৃতিকভাবেই খাদ্য, ব্যায়াম প্রভৃতির সাহায্যে নিজের পেশি গঠনে উৎসাহ দেয়া হয় পুরুষকে। যদি ধ’রেও নেয়া হয় যে পেশিতে পুরুষেবা অধিকার জন্মগত, তবু পেশি কোনো রাজনীতিক অধিকারের ভিত্তি হতে পারে না। পুরুষাধিপত্য পেশিশক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়; নির্ভরশীল কিছু অজৈবিক মূল্যবোধের ওপর। আধুনিক কালে পেশির মূল্য বেশ ক’মে গেছে। চিরকাল পেশির ওপর নির্ভর করেছে গরিবেরা, তাদের পেশিতে শক্তি না থাকলেও। পিতৃতন্ত্র শরীরের ওপর দেয় বিশেষ গুরুত্ব; আর পিতৃতন্ত্রের প্রবক্তারা মনে করেন মানুষের শারীরিক কারণেই পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব ছিলো অনিবার্য। তবে এটা মনে করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে যে মানবসমাজের শুরুতেই পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে নি; এর আগে ছিলো প্রাকপিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, যাতে নারীরই গুরুত্ব ছিলো বেশি; কারণ নারী সন্তান জন্ম দেয়। প্রথমে জন্ম দেয়ার ব্যাপারটিই ছিলো বড়ো; কিন্তু পরে পিতৃত্বের ব্যাপারটি বড়ো হয়ে উঠলে সমাজ পিতৃতন্ত্রের দিকে বাঁক নেয়। সন্তান জন্মদানে নারীর ভূমিকাকে গৌণ ক’রে সন্তান উৎপাদনের গৌরব দেয়া হয় শুধু পুরুষলিঙ্গকে। পিতৃতান্ত্রিক ধর্ম পিতৃতন্ত্রকে সুগঠিত করে পুরুষ ঈশ্বর বা দেবতা সৃষ্টি ক’রে; এ-ধর্ম বিতাড়িত বা বিচ্যুত করে আগের দেবীদের। পিতৃতান্ত্রিক ধর্মশাস্ত্র পুরোপুরি পুরুষাধিপত্যবাদী; এর মূল দায়িত্বই হচ্ছে পিতৃতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত ও রক্ষা করা। ভূমিকা, মেজাজ, ও বিশেষ করে অবস্থানের ক্ষেত্রে পুরুষের আধিপত্যের মূলে কোনো জৈব কারণ নেই, রয়েছে সাংস্কৃতিক কারণ। কিন্তু যুগেযুগে বহু পুরুষ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে যে জৈব কারণেই পুরুষ শ্ৰেষ্ঠ। অনেক চতুর পুরুষ আবার শ্ৰেষ্ঠ-নিকৃষ্ট তত্ত্বের বদলে পেশ করে পার্থক্যতত্ত্ব। যেমন, বাকলে নামক এক পুরুষ প্ৰবন্ধ লিখেছেন ‘বিজ্ঞানের ওপর নারীর প্রভাব’ নামে। তিনি প্রকাশ্যে পুরুষাধিপত্যবাদী নন, তাই তিনি পুরুষকে উৎকৃষ্ট নারীকে নিকৃষ্ট না বলে বৈজ্ঞানিকভাবে দেখিয়েছেন যে নারীপুরুষ একে অন্যের থেকে উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্ট নয়, তারা ‘পৃথক’! তিনি নারীর মন কেটেছেটে দেখিয়েছেন যে নারীর পক্ষে পুরুষের আর পুরুষের পক্ষে নারীর সমস্ত যোগ্যতা আয়ত্ত করা অসম্ভব। তিনি প্রমাণ করেন যে প্রকৃতি নারীকে করেছে বোধিবাদী আর পুরুষকে উপাত্তবাদী বা অভিজ্ঞতাবাদী। প্রকৃতি নারীকে দিয়েছে বোধি আর পুরুষকে বুদ্ধি; তাই নারী যদিও পুরুষের মতো স্পষ্ট ক’রে কিছুই দেখতে-বুঝতে পারে না, তবে নারী অনুভব করে খুব তাড়াতাড়ি [দ্র ব্লক (১৯৫৮, ৫৮)]! কিন্তু পুরুষের জগতে অনুভবের কোনো মূল্য নেই, সব মূল্য দেখার আর বোঝার!