ভাই বাঙালি, এখন বুঝিলে কি, কেন করি, অবোধ অশ্রু কেন পড়ে, পোড়া চোখের জল কেন বারণ মানে না, কেন মিছে অরণ্যে রোদন, অস্থানে ক্রন্দন করিয়া মরি! নীরব হৃদয়ের জ্বালা ব্যক্ত হইল কি, এই ভস্মীভূত প্রাণের শিখা দেখিতে পাইলে কি, শুষ্ক অশ্রুধারা দুই কপোল বাহিয়া কি প্রবাহিত হইল? যে ধ্বনি কখনো শোন নাই তাহার প্রতিধ্বনি শুনিলে কি, যে আশা কখনো হৃদয়ে স্থান দাও নাই তাহার নৈরাশ্য তিলমাত্র অনুভব করিলে কি, যাহা বুঝাইতে গেলে বুঝানো যায় না এবং যাহা বুঝিতে চেষ্টা করিলে বুঝা উত্তরোত্তর অসাধ্য হইয়া উঠে তাহা কি আজ তোমাদের এই ঊনবিংশ শতাব্দীর সভ্যতারুদ্ধ বধির কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল।–
সম্পাদক মহাশয়, আজ এই পর্যন্ত প্রকাশ করা গেল। কারণ ইহার পরের প্যারাগ্রাফেই আমাদের লেখক আরম্ভ করিয়াছেন, “যদি না করিয়া থাকে তবে আমি ক্ষান্ত হইলাম, নীরব হইলাম, তবে আমি মুখ বন্ধ করিলাম, তবে আমি আর একটি কথাও কহিব না–না, একটিও না।’ এই বলিয়া কেন কথা কহিবেন না, শ্মশানক্ষেত্রে কথা বলিলেই বা কিরূপ ফল হয় এবং সমাধিক্ষেত্রে কথা বলিলেই বা কিরূপ নিষ্ফল হয়, এবং কথা বলিলেই বা কিরূপ হৃদয় বিদীর্ণ হয় এবং হৃদয় বিদীর্ণ হইলেই বা কিরূপ কথা বাহির হইতে থাকে, তাহাই ভাই বাঙালিকে পুনরায় বুঝাইতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন এবং কিছুতেই কৃতকার্য হইতে পারিতেছেন না। এই অংশটি এত দীর্ঘ যে, আপনার কাগজে স্থান হইবে না। পাঠকদিগকে আশ্বাস দেওয়া যাইতেছে, প্রবন্ধটি অবিলম্বে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হইবে। মূল্য ৫৪০ মাত্র, কিন্তু যাঁহারা ডাক-মাশুল-স্বরূপে উক্ত ৫৪০ পাঠাইবেন তাঁহাদিগকে বিনা মূল্যে গ্রন্থ উপহার দেওয়া যাইবে।
–সাহিত্য এজেন্সির কার্যাধ্যক্ষ
সারবান সাহিত্য
সম্পাদক মহাশয়,
আজকাল বাংলা সাহিত্যে রাশি রাশি নাটক-নভেলের আমদানি হইতেছে। কিন্তু তাহাতে সার পদার্থ কিছুমাত্র নাই। না আছে তত্ত্বজ্ঞান, না আছে উপদেশ। কী করিলে দেশের ধনবৃদ্ধি হইতে পারে, গোজাতির রোগনিবারণ করিবার কী কী উপায় আছে, দ্বৈত দ্বৈতাদ্বৈত এবং শুদ্ধাদ্বৈতবাদের মধ্যে কোন্ বাদ শ্রেষ্ঠ, কফ পিত্ত ও বায়ু-বৃদ্ধির পক্ষে দিশি কুমড়া ও বিলাতি কুমড়ার মধ্যে কোনো প্রভেদ আছে কি না,অশোক এবং হর্ষবর্ধনের মধ্যে কে আগে কে পরে–আমাদের অগণ্য কাব্যনাটকের মধ্যে এ-সকল সারগর্ভ বিশ্বহিতকর প্রসঙ্গের কোনো মীমাংসা পাওয়া যায় না। একবার কল্পনা করিয়া দেখুন, যদি কোনো নাটকের পঞ্চমাঙ্কের সর্বশেষভাগে এমন একটি তত্ত্ব পাওয়া যায় যদ্দারা জৈবশক্তি ও দৈবশক্তির অন্যোন্য সম্বন্ধ নিরূপিত হয় অথবা সৃষ্টিবিকাশের ক্রমপর্যায় নাটকের অঙ্কে অঙ্কে বিভক্ত হইয়া দুর্গম জ্ঞানশিখরের মরকত-সোপান-পরম্পরা রচিত হয়, তবে রসগ্রাহী সহৃদয় পাঠকেরা কিরূপ পুলকিত ও পরিতৃপ্ত হইতে পারেন। এখন যে-সকল অসার ম্লেচ্ছভাবসংস্পর্শদূষিত গ্রন্থ বাহির হইতেছে তাহা পাঠ করিয়া বাবুরা সাহেব এবং ঘরের গৃহিণীরা বিবি হইতেছেন। বঙ্গসাহিত্যের এই কলঙ্ক অপনোদন করিবার মানসে আমি নাটক-উপন্যাসের ছলে কতকগুলি জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থ প্রণয়ন করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি। প্রথম সংখ্যায় পঞ্জিকা নাট্যাকারে বাহির করিব স্থির করিয়াছি। গ্রহ-ফলাফলের প্রতি বর্তমান কালের ইংরাজি-শিক্ষিত বাবু-বিবিদিগের বিশ্বাস ক্রমশ হ্রাস হইতেছে। সেই নষ্ট বিশ্বাস উদ্ধার করিবার জন্য আমি এই কৌশল অবলম্বন করিয়াছি। সাধারণের চিত্ত-আকর্ষণের অভিপ্রায়ে এই নাটকের কিঞ্চিৎ নমুনা মহাশয়ের জগদ্বিখ্যাত পত্রের এক পার্শ্বে প্রকাশ করিতে ইচ্ছা করি।
নাটকের পাত্রগণ
হর
পার্বতী
প্রথম অঙ্ক। দৃশ্য কৈলাসপর্বত
হরপার্বতী
পার্বতী । নাথ!
হর। কেন প্রিয়ে?
পার্বতী। শ্বেতবরাহ কল্পাব্দ হইতে কয়জন মনুর আবির্ভাব হইয়াছে সেই মনোহর প্রসঙ্গ শুনিবার জন্য আমার একান্ত বাসনা হইতেছে।
হর। (সহাস্যে) প্রিয়ে, পঞ্জিকার প্রথম সৃষ্টিকাল হইতে আজ পর্যন্ত প্রত্যেক বর্ষারম্ভদিনে এই পরমজিজ্ঞাস্য প্রশ্নের উত্তরে তোমার কৌতূহল নিবৃত্ত করিয়া আসিতেছি। জীবিতবল্লভে, আজও কি এ সম্বন্ধে তোমার ধারণা জন্মিল না?
পার্বতী। প্রাণনাথ, জানই তো আমরা বুদ্ধিহীন নারীজাতি, বিশেষত আজকালকার বিবিদের মতো ফিমেল ইস্কুলে পড়ি নাই। (বোধ করি সকলে বুঝিতে পারিয়াছেন, এইখানে বর্তমান শিক্ষিতা মহিলাদের প্রতি তীব্র বিদ্রূপ করা হইল। ইহাতে স্ত্রীশিক্ষা অনেকটা নিবারণ হইবে।–লেখক) হৃদয়নাথ, অহর্নিশি একমাত্র পতিচিন্তা ব্যতীত যাহার আর কোনো চিন্তা নাই তাহার স্মৃতিপটে অতগুলা মনুর কথা কিরূপে অঙ্কিত হইবে? হাজার হউক, তাহারা তো পরপুরুষ বটে। (বর্তমান কালের পাঠিকারা এইস্থল হইতে পতিভক্তির সুন্দর উপদেশ পাইবেন। –লেখক)
হর। প্রিয়তমে, তবে অবহিত হইয়া মনোহর কথা শ্রবণ করো। শ্বেতবরাহ কল্পাব্দের পর হইতে ছয় জন মনু গত হইয়াছেন। প্রথম স্বায়ম্ভুব মনু। দ্বিতীয় স্বরোচিষ মনু। তৃতীয় ঔত্তমজ মনু। চতুর্থ তামস মনু। পঞ্চম রৈবত মনু। ষষ্ঠ চাক্ষুষ মনু। সম্প্রতি সপ্তম মনু বৈবস্বতের অধিকার চলিতেছে। সপ্তবিংশতি যুগ গত হইয়াছে। অষ্টবিংশতি যুগে কলিযুগের প্রারম্ভ। তত্র চতুর্যুগের পরিমাণ বিংশতিসহস্রাধিক ত্রিচত্বারিংশল্লক্ষ-পরিমিত বর্ষ।