সর্বসম্মতিক্রমে তাহাই স্থির হইল।
তখন যম উঠিয়া কহিলেন, “এতকাল আমিই নরলোকের সর্বাপেক্ষা ভয়ের কারণ ছিলাম, কিন্তু এখন সেখানে আমা অপেক্ষা ভয় করে এমন-সকল প্রাণীর উদ্ভব হইয়াছে। অতএব, পুলিস-দারোগাকে আমার যমদণ্ড ছাড়িয়া দিয়া আমি অদ্য হইতে কাজে ইস্তফা দিতে চাই।’
অধিকাংশ দেবতার মতে যমরাজের প্রভাব নিতান্ত অসংগত না হইলেও ব্যাপারটা গুরুতর বিধায় আগামী মীটিঙে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আপাতত স্থগিত রহিল।
কার্তিকেয় উঠিয়া কহিলেন, “গুরুদেবের বক্তৃতার পর আমাকে আর অধিক কিছু বলিতে হইবে না। আমি দেবসেনাপতি। কিন্তু দেবতাগণকে রক্ষা করা আমার অসাধ্য হইয়া উঠিয়াছে, অতএব, হয় আমার পোস্ট্ অ্যাবলিশ করিয়া এস্টাব্লিশ্মেন্ট্ কমানো হউক, নয় কোনো সাময়িক পত্রের সম্পাদকের উপর স্বর্গরক্ষাকার্যের ভার দেওয়া হউক। এমন-কি, আমার বহুকালের ময়ূরটিও আমি বিনা মূল্যে তাঁহাদিগকে ছাড়িয়া দিতে প্রস্তুত আছি। ইহার পেখম ছড়াইলে তাঁহাদের অনেকটা বিজ্ঞাপনের কাজ হইবে।’
দেবতাদের সম্মতিক্রমে সেনাপতির পোস্ট্ অ্যাবলিশ হইল, এখন হইতে ময়ূরের খোরাকি তাঁহার নিজের তহবিল হইতে পড়িবে।
বরুণ উঠিয়া অশ্রুজল বর্ষণ করিয়া কহিলেন, “নরলোকে আমার কি আর কোনো আবশ্যক আছে? খোলাভাঁটিবাহিনী বারুণী আমাকে উচ্ছেদ করিবার সংকল্প করিয়াছে। এইবেলা মানে মানে সময় থাকিতে সরিতে ইচ্ছা করি।’
দেবতাগণ বহুল চিন্তা ও তর্কের পর স্ট্যাটিস্টিক্স্ দেখিয়া অবশেষে স্থির করিলেন, এখনো সময় হয় নাই। কারণ, এখনো সময়ে সময়ে বারুণীর প্রাখর্য নিবারণের জন্য দুর্বল মানব বরুণের সহায়তা প্রার্থনা করিয়া থাকে।
তখন ধর্ম বলিলেন, “লোকাচারকে আমার অধীনস্থ কর্মচারী বলিয়া জানিতাম, কিন্তু সে তো আমার সঙ্গে পরামর্শমাত্র না করিয়া আপন ইচ্ছামতো যাহা-তাহা করে,তবে সেই ছোঁড়াটাকেই সিংহাসন ছাড়িয়া দিলাম।’ বায়ু কহিলেন, “পৃথিবীতে এখন উনপঞ্চাশ দিকে উনপঞ্চাশ বায়ু বহিতেছে,চাই-কি, এখন আমি অবসর লইতে পারি।’ আদিত্য কহিলেন, “মানবসমাজে বিস্তর খদ্যোত উঠিয়াছে; তাহারা মনে করিতেছে, সূর্য না হইলেও আমরা একলা কাজ চালাইতে পারি। জগৎ আলোকিত করিবার ভার তাহাদের উপর দিয়া আমি অস্তাচলে বিশ্রাম করিতে ইচ্ছা করি।’ ভগবান চন্দ্রমা শুক্লপ্রতিপদের কৃশমূর্তি ধারণ করিয়া কহিলেন, “নরলোকে কবিরা তাঁহাদের প্রেয়সীর পদনখরকে আমা অপেক্ষা দশগুণ প্রাধান্য দিয়া থাকেন, অতএব যে পর্যন্ত কবিরমণী-মহলে পাদুকার সম্পূর্ণ প্রচলন না হয় সে পর্যন্ত আমি অন্তঃপুরে যাপন করিতে চাই।’ এমন-কি, ভোলানাথ শিব অর্ধনিমীলিত নেত্রে কহিলেন, “আমা অপেক্ষা বেশি গাঁজা টানে পৃথিবীতে এমন লোকের তো অভাব নাই; সেই-সমস্ত সংস্কারকদিগের উপর আমার প্রলয়কার্যের ভার দিয়া আমি অনায়াসে নিশ্চিন্ত থাকিতে পারি। এমন-কি, আমি নিশ্চয় জানি, আমার ভূতগুলারও কোনো আবশ্যক হইবে না।’
সর্বশেষে যখন শুভ্রবসনা অমলকমলাসনা সরস্বতী উঠিয়া বীণানিন্দিত মধুর স্বরে দেবসমাজে তাঁহার নিবেদন আরম্ভ করিলেন, তখন দেবগণ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন এবং মহেন্দ্রের সহস্র চক্ষের পল্লব সিক্ত হইয়া উঠিল।
দেবী কহিলেন, “অন্যান্য নানা কার্যের মধ্যে বালকদিগকে শিক্ষাদানের ভার এতদিন আমার উপর ছিল, কিন্তু সে কার্য আমি কিছুতেই চালাইতে পারিব না। আমি রমণী, আমার মাতৃহৃদয়ে শিশুদিগের প্রতি কিছু দয়ামায়া আছে– তাহাদের পাঠের জন্য আজকাল যে-সকল পুস্তক নির্বাচিত হয় সে আমি কিছুতেই পড়াইতে পারিব না। আমার হৃদয় বিদীর্ণ হয় এবং তাহাদের ক্ষুদ্র শক্তি ভাঙিয়া পড়ে। এ নিষ্ঠুর কার্য একজন বলিষ্ঠ পুরুষের প্রতি অর্পিত হইলেই ভালো হয়। অতএব সুরসভায় আমি সানুনয়ে প্রার্থনা করি, যমরাজের প্রতি উক্ত ভার দেওয়া হউক।’
যমরাজ তৎক্ষণাৎ উঠিয়া প্রতিবাদ করিলেন, “আমার কোনো আবশ্যক নাই, কারণ, ইস্কুলের মাস্টার এবং ইন্স্পেক্টর আছে।’
শিশুশিক্ষা-বিভাগে যমরাজের বিশেষ নিয়োগ যে বাহুল্য এ সম্বন্ধে দেবতাদের কোনো মতভেদ রহিল না।
পয়সার লাঞ্ছনা
আমাদের আপিসের সাহেব বলে, বাঙালির বেশি বেতনের আবশ্যক নাই। সে স্থির করিয়া রাখিয়াছে, ভদ্র বাঙালির ছেলের পক্ষে মাসিক পঁচিশ টাকা খুব উচ্চ বেতন। আমাদের অবস্থা এবং আমাদের দেশের সম্বন্ধে সাহেবরা যখন একটা মত স্থির করে তখন তাহার উপর আমাদের কোনো কথা বলা প্রগল্ভতা। কেবল সাহেবের প্রতি একটা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কুটুম্বিতাসূচক বিশেষণ-প্রয়োগপূর্বক মনের ক্ষোভে আপনা-আপনির মধ্যে বলাবলি করি–সাহেব সবই তো জানেন।
শোনা যায় জগতে হরণ-পূরণের একটা নিয়ম আছে। সে নিয়মের অর্থ এই–যাহার একটার অভাব তাহার আর-একটার বাহুল্য প্রায়ই থাকে। আপিসেও তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। আমাদের যেমন বেতন অল্প তেমনি খাটুনি এবং লাঞ্ছনা অধিক এবং সাহেবের ঠিক তাহার বিপরীত।
কিন্তু জগতের এ নিয়ম কোনো কোনো জগদ্বাসীর পক্ষে যেমনই আনন্দজনক হউক আমাদের পক্ষে ঠিক তেমন সুবিধার বোধ হয় নাই। কেবল অগত্যা সহিয়াছিলাম, কিন্তু যেদিন আমাদের উপরে একটা কর্ম খালি হইল এবং বাহির হইতে একটা কাঁচা ইংরাজের ছেলেকে সেই কর্মে নিযুক্ত করিয়া আমাদের প্রমোশন বন্ধ করা হইল, সেদিন আমাদের ক্ষোভের আর সীমা রহিল না। ইচ্ছা হইল তখনই কাজ ফেলিয়া যদি চলিয়া যাই, একটা মিউটিনি করি,ইংরাজকে দেশ হইতে দূর করিয়া দিই, পার্লামেন্টে একটা দরখাস্ত করি, স্টেট্স্ম্যান কাগজে একটা বেনামি পত্র লিখি। কিন্তু তাহার কোনোটা না করিয়া বাড়িতে চলিয়া গিয়া সেদিন আর জলখাবার খাইলাম না, খোকার সর্দি হইয়াছে বলিয়া স্ত্রীকে যৎপরোনাস্তি লাঞ্ছনা করিলাম, স্ত্রী কাঁদিতে লাগিল, আমি সকাল সকাল শুইয়া পড়িলাম। শুইয়া শুইয়া ভাবিতে লাগিলাম, হায় রে পয়সা, তোর জন্য এত অপমান!