পিতামহ ব্রহ্মা বৈদিক ভাষায় উদাত্ত অনুদাত্ত এবং স্বরিত-সংযোগপূর্বক কহিলেন, “ভো ভো দেবগণ শৃন্বন্তু।
“আমার কথা স্বতন্ত্র। আমি তো এই বিশ্বসৃষ্টি এবং বেদরচনা সমাপ্ত করিয়া সমস্ত কাজকর্ম ছাড়িয়া দিয়া পেন্শন লইয়াছি। এমন-কি, আমার কাছে আর কোনো প্রত্যাশা নাই বলিয়া সকলে আমার পূজা পর্যন্ত বন্ধ করিয়াছে। এবং আমার প্রথম বয়সের বিশ্ব এবং বেদ-নামক দুটো রচনা লইয়া লোকে নির্ভয়ে স্ব স্ব ভাষায় অনুবাদ এবং সমালোচনা করিতে আরম্ভ করিয়াছে। কেহ বলে, রচনা মন্দ হয় নাই, কিন্তু আরও ঢের ভালো হইতে পারিত; কেহ বলে, আমাদের হাতে যদি প্রুফ-সংশোধনের ভার থাকিত তাহা হইলে ছত্রে ছত্রে এত মুদ্রাকরপ্রমাদ থাকিত না। আমি চুপ করিয়া থাকি, মনে মনে তাহাদের সম্বোধন করিয়া বলি, বাবা, ওই আমার প্রথম রচনা। তোমরা অবশ্য আমার চেয়ে অনেক পাকা হইয়াছ, কিন্তু তখন যে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না; একেবারে সমস্তই মন হইতে গড়িতে হইয়াছিল। তৎপূর্বে তোমরা যদি একটু মনোযোগ করিয়া জন্মগ্রহণ করিতে তাহা হইলে সমালোচনা শুনিয়া অনেক জ্ঞানলাভ করিতাম, একটি মস্ত স্ট্যাণ্ডাড্ পাওয়া যাইত। দুর্ভাগ্যক্রমে তোমরা বড়োই বিলম্বে জন্মিয়াছ। যাহা হউক, যখন দ্বিতীয় সংস্করণ আরম্ভ হইবে তখন তোমাদের কথা স্মরণ রাখিব।
“আবার কেহ কেহ, রচনা দুটো যে আমার তাহা একেবারে অস্বীকার করে। হয়তো অনায়াসে প্রমাণ করিতে পারিত ওটা তাহাদের নিজের, কিন্তু তাহা হইলে তাহাদের কল্পনাশক্তি ও প্রতিভার খর্বতা স্বীকার করা হয় বলিয়া ক্ষান্ত আছে। হরি হরি! এই দীর্ঘজীবনে ওই দুটো বৈ আর কোনো দুষ্কর্ম করি নাই, ইহাতেই এত কথা শুনিতে হইল।
“যাহা হউক এ তো গেল আমার আক্ষেপের কথা। কিন্তু তোমরা কী মনোদুঃখে, মর্তলোকের প্রতি কী অভিমানে তোমাদের বহুকালের পদ পরিত্যাগ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছ?’
তখন দেবতারা কেহ বা বৈদিক, কেহ বা পৌরাণিক ভাষায়, কেহ-বা ত্রিষ্টুভ,কেহ-বা অনুষ্টুভ ছন্দে, দন্ত্য ন মূর্ধন্য ণ অন্তঃস্থ ব বর্গীয় ব এবং তিন সয়ের উচ্চারণ রক্ষা করিয়া বলিলেন, “ভগবন্, সায়ান্স-নামক একটা দানব অত্যন্ত জুলুম আরম্ভ করিয়াছে। ইহার নিকটে বৃত্র প্রভৃতি প্রাচীন অসুরদিগকে গণ্যই করি না।’
বৃদ্ধ পিতামহ মনে মনে হাসিলেন; ভাবিলেন, কোনোমতে মানে মানে তাহার হাত হইতে উদ্ধার পাইয়াছ, এখন তাহাকে গণ্য না করিলেও চলে। কিন্তু তখন যে নাকালটা হইয়াছিলে সে বেশ মনে আছে। কিন্তু সে কথা আর উত্থাপন না করিয়া গম্ভীরভাবে চারিটি মস্তিক নাড়িয়া কহিলেন, “অবশ্য অবশ্য।’
সুরগুরু বৃহস্পতি কহিলেন, “আর্য, শত্রুটাকে তত ডরাই না, কিন্তু মিত্রদের উপদ্রবে অতিষ্ঠ হইয়াছি। এতদিন আমরা ছিলাম মানুষের হৃদয়লোকে বিশ্বাসের স্বর্গধামে; এখন তাহারা সায়ান্সের সহিত গোপনে সন্ধিস্থাপনপূর্বক সেখান হইতে নির্বাসিত করিয়া আমাদিগকে মাথার খুলির এক কোণে অত্যন্ত শুষ্ক সংকীর্ণ জায়গায় একটুখানি স্থান দিতে চায়। সেখানে একফোঁটা বিশ্বাসের অমৃত নাই। বলে, দেখো, তোমাদের কত গৌরব বাড়িল। ছিলে অজ্ঞানান্ধ হৃদয়গহ্বরে, এখন উঠিলে মস্তিষ্কঘৃতজ্বালিত জ্ঞানালোকিত মস্তকচূড়ায়। ভাগ্যে আমরা কয়জনা বুদ্ধিমান ছিলাম, নতুবা স্বর্গে মর্তে কোথাও তোমাদের স্থান হইত না। আমরা সকলের কাছে প্রমাণ করিয়াছি যে, তোমরা আর কোথাও যদি না থাক, নিদেন আমাদের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার মধ্যে আছ। প্রতিবাদ করিয়া সেখান হইতে তোমাদিগকে বিচলিত করে এমন বুদ্ধিমান এখনো কেহ জন্মগ্রহণ করে নাই। বিষ্ণুর মীন কূর্ম বরাহ প্রভৃতি অবতারগুলিকে আমরা এভোল্যুশন থিওরি বলিয়া প্রচার করিয়াছি। দেবতাদের উদ্ধারের জন্য আমরা এত প্রাণপণ চেষ্টা করিতেছি।
“ভগবন্, যথার্থ আন্তরিক ভক্তি কখনোই নিজের দেবতাকে লইয়া এরূপ ছেলে ভুলাইবার চেষ্টা করে না। দেব চতুরানন, এতকাল দেবতা ছিলাম, কেবল মাঝে মাঝে দৈত্যদের উপদ্রবে স্বর্গছাড়া হইয়াছি, কিন্তু এপর্যন্ত আমাদিগকে কেহ এভোল্যুশন থিওরি করিয়া দেয় নাই। প্রভু, তুমি যদি আমাদিগকে সৃষ্টি করিয়া থাক তুমি জান আমরা কী, কিন্তু আজকাল তোমার অপেক্ষা যাহারা কিঞ্চিৎ বেশি শিখিয়াছে তাহাদের হাত হইতে আমাদিগকে রক্ষা করো। বড়ো আশা দিয়াছিলে তোমরা দেবতারা অমর, কিন্তু এইভাবে যদি কিছুদিন চলে, আমাদের মানববন্ধুরা যদি সাংঘাতিক স্নেহভরে আরও কিছুকাল আমাদের ব্যাখ্যা করিতে থাকেন,তবে সে আশা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইবে।’
বৃহস্পতির মুখে এই-সমস্ত সংবাদ শ্রবণ করিয়া পিতামহ ব্রহ্মা আর উত্তর করিতে পারিলেন না, চারিটি শুভ্র মস্তক নত করিয়া চিন্তিতভাবে বসিয়া রহিলেন।
তখন দেবতাগণ স্ব স্ব পদ সম্বন্ধে পরিবর্তন প্রার্থনা করিলেন। বিজ্ঞ দেবতা প্রজাপতি এবং বালক দেবতা কন্দর্প সুরসভায় দাঁড়াইয়া কহিলেন, “সকলেই জানেন, বিবাহ- ডিপার্টমেন্টে বহুকাল আমাদের কিঞ্চিৎ কর্তৃত্ব ছিল; সেজন্য আমাদের কোনোরূপ নিয়মিত নৈবেদ্য অথবা উপরি-পাওনা ছিল না বটে, কিন্তু কৌতুক যথেষ্ঠ ছিল। সম্প্রতি টাকা-নামক একটা চক্রমুখো হঠাৎ-দেবতা টঙ্কশালা হইতে নিষ্কলঙ্ক পূর্ণ- চন্দ্রাকারে আবির্ভুত হইয়া একপ্রকার গায়ের জোরে আমাদের সে কাজ কাড়িয়া লইয়াছে। অতএব উক্ত ডিপার্ট্মেন্ট্ হইতে আমাদের নাম কাটিয়া আজ হইতে সেই প্রবলশক্তি নূতন দেবতার নাম বাহাল হউক।’