- বইয়ের নামঃ ব্যঙ্গকৌতুক
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ বুক সেন্টার
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
কথামালার নূতন-প্রকাশিত গল্প
একদা কয়েক জন কাঠুরিয়া এক পার্বত্য সরল বৃক্ষের শাখাচ্ছেদনে মনোযোগী হইয়াছিল। শ্রম লাঘব করিবার অভিপ্রায়ে বিস্তর পরামর্শপূর্বক তাহারা এক নূতন কৌশল অবলম্বন করিল। যে শাখা ছেদনের আবশ্যক কয়েক জনে মিলিয়া তাহারই উপর চড়িয়া বসিল এবং নিভৃতে বসিয়া সতর্কতার সহিত অস্ত্রচালনা করিতে লাগিল।
যথাসময়ে শাখা ছিন্ন হইয়া পড়িল এবং কাঠুরিয়া কয়েকটিও তৎসঙ্গে ভূতলে পড়িয়া পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল।
কাঠুরিয়ার সর্দার এই সংবাদ-শ্রবণে অধীর হইয়া সেই তরুসমীপে উপস্থিত হইল এবং কুঠার আস্ফালন করিয়া কহিল, “তুমি যে অপরাধ করিয়াছ আমি তাহার বিচার করিতে চাহি।’
বনস্পতি সাতিশয় বিস্মিত হইয়া কহিল, “হে জনপুঙ্গব, আমার স্কন্ধের উপর আরোহণ করিয়া আমারই শাখাচ্ছেদন করিয়াছ, এক্ষণে কে কাহার বিচার করিবে?’
মানব আরক্তলোচনে কহিল, “আমার কয়েক জন কাঠুরিয়া যে অকালে কালগ্রাসে পতিত হইল, তাহার জন্য কেহই দণ্ড পাইবে না এ কখনো হইতে পারে না।’
বনস্পতি ভীত হইয়া কম্পিত মর্মরস্বরে কহিল, “প্রভু, তাঁহারা সুবুদ্ধিসহকারে মানবচাতুরী অবলম্বন করিয়া যেরূপ কাণ্ড করিয়াছিলেন, আশ্চর্য কার্যনৈপুণ্যবশত অবিলম্বেই তাহার ফললাভ করিয়াছেন–আমি মূঢ় বৃক্ষ, তাহার প্রতিবিধান করি এমন সাধ্য ছিল না।’
মানব কহিল, “কিন্তু তোমারই শাখা ভাঙিয়া পড়িয়াছিল, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই।’
বনস্পতি কহিল, “সে কথা যথার্থ, কারণ আমারই শাখায় তাঁহারা কুঠারাঘাত করিয়াছিলেন এবং প্রকৃতির নিয়ম অনিবার্য।’
মানব সুযুক্তিসহকারে কহিল, “অতএব তোমাকেই দণ্ড স্বীকার করিতে হইবে। তোমার যাহা-কিছু বক্তব্য আছে বলিতে থাকো, আমি এক্ষণে কুঠারে সান দিতে চলিলাম।’
তাৎপর্য
অনবধানবশত যদি হুঁচট খাইয়া থাক, চৌকাঠকে পদাঘাত করিবে। সেই জড়পদার্থের পক্ষে এই একমাত্র সুবিচার।
১২৯৮
ডেঞে পিঁপড়ের মন্তব্য
দেখো দেখো, পিঁপড়ে দেখো! খুদে খুদে রাঙা রাঙা সরু সরু সব আনাগোনা করছে– ওরা সব পিঁপড়ে, যাকে সংস্কৃত ভাষায় বলে পিপীলিকা। আমি হচ্ছি ডেঞে, সমুচ্চ ডাঁইবংশসম্ভূত, ওই পিঁপড়েগুলোকে দেখলে আমার অত্যন্ত হাসি আসে।
হা হা হা, রকম দেখো, চলছে দেখো, যেন ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে গেছে; আমি যখন দাঁড়াই তখন আমার মাথা আকাশে ঠেকে! সূর্য যদি মিছরির টুকরো হ’ত আমার মনে হয় আমি দাঁড়া বাড়িয়ে ভেঙে ভেঙে এনে আমার বাসায় জমিয়ে রাখতে পারতুম। উঃ, আমি এত বড়ো একটা খড় এতখানি রাস্তা টেনে এনেছি, আর ওরা দেখো কী করছে– একটা মরা ফড়িং নিয়ে তিন জনে মিলে টানাটানি করছে। আমাদের মধ্যে এত ভয়ানক তফাত! সত্যি বলছি, আমার দেখতে ভারি মজা লাগে।
আমার পা দেখো আর ওদের পা দেখো! যতদূর চেয়ে দেখি আমার পায়ের আর অন্ত দেখি নে, এতোবড়ো পা! পদমর্যাদা এর চেয়ে আর কী আশা করা যেতে পারে! কিন্তু পিঁপড়েরা আমাদের খুদে খুদে পা নিয়েই সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট আছে। দেখে আশ্চর্য বোধ হয়। হাজার হোক, পিঁপড়ে কিনা।
ওরা একে ক্ষুদ্র, তাতে আবার আমি বিস্তর উঁচু থেকে দেখি– ওদের সবটা আমার নজরে আসে না। কিন্তু আমি আমার অতি দীর্ঘ ছ পায়ের উপরে দাঁড়িয়ে কটাক্ষে দৃকপাত করে আন্দাজে ওদের আগাগোড়াই বুঝে নিয়েছি। কারণ, পিঁপড়ে এত ক্ষুদ্র যে ওদের দেখে ফেলতে অধিক ক্ষণ লাগে না। পিঁপড়ে-জাতি সম্বন্ধে আমি ডাঁই ভাষায় একটা কেতাব লিখিব এবং বক্তৃতাও দেব।
পিঁপড়ে-সমাজ সম্বন্ধে আমার বিস্তর অনুমানলব্ধ আছে। ডেঞেদের সন্তানস্নেহ আছে, অতএব পিঁপড়েদের তা কখনোই থাকতে পারে না; কারণ,তারা পিঁপড়ে, কেবলমাত্র পিঁপড়ে, পিঁপড়ে ব্যতীত আর কিছুই নয়। শোনা যায় পিঁপড়েরা মাটিতে বাসা বানাতে পারে; স্পষ্টই বোধ হচ্ছে তারা ডেঞে জাতির কাছ থেকে স্থপতিবিদ্যা শিক্ষা করছে– কারণ, তারা পিঁপড়ে, সামান্য পিঁপড়ে, সংস্কৃত ভাষায় যাকে বলে পিপীলিকা।
পিঁপড়েদের দেখে আমার অত্যন্ত মায়া হয়, ওদের উপকার করবার প্রবৃত্তি আমার অত্যন্ত বলবতী হয়ে ওঠে। এমন-কি, আমার ইচ্ছা করে, সভ্য ডেঞে-সমাজ কিছুদিনের জন্য ছেড়ে, দলকে-দল ডেঞে-ভ্রাতৃবৃন্দকে নিয়ে পিঁপড়েদের বাসার মধ্যে বাসস্থাপন করি এবং পিঁপড়ে-সংস্কারকার্যে ব্রতী হই– এতদূর পর্যন্ত ত্যাগস্বীকার করতে আমি প্রস্তুত আছি। তাদের শর্করকণা গলাধঃকরণ করে এবং তাদের বিবরের মধ্যে হাত পা ছড়িয়ে কোনোক্রমে আমরা জীবনযাপন করতে রাজি আছি, যদি এতেও তারা কিছুমাত্র উন্নত হয়।
তারা উন্নতি চায় না– তারা নিজের শর্করা নিজে খেতে এবং নিজের বিবরে নিজে বাস করতে চায়, তার কারণ তারা পিঁপড়ে, নিতান্তই পিঁপড়ে। কিন্তু আমরা যখন ডেঞে তখন আমরা তাদের উন্নতি দেবই, এবং তাদের শর্করা আমরা খাব ও তাদের বিবরে আমরা বাস করব– আমরা এবং আমাদের ভাইপো, ভাগ্নে, ভাইঝি ও শ্যালকবৃন্দ।
যদি জিজ্ঞাসা কর তাদের শর্করা আমরা কেন খাব এবং তাদের বিবরে কেন বাস করব তবে তার প্রধান কারণ এই দেখাতে পারি যে, তারা পিঁপড়ে এবং আমরা ডেঞে! দ্বিতীয়, আমরা নিঃস্বার্থভাবে পিঁপড়েদের উন্নতিসাধনে ব্রতী হয়েছি, অতএব আমরা তাদের শর্করা খাব এবং বিবরেও বাস করব। তৃতীয়, আমাদের প্রিয় ডাঁইভূমি ত্যাগ করে আসতে হবে, সেইজন্য, সেই দুঃখ নিবারণের জন্য, শর্করা কিছু অধিক পরিমাণে খাওয়া আবশ্যক। চতুর্থ, বিদেশে বিজাতির মধ্যে বিচরণ করতে হবে, নানা রোগ হতে পারে– তা হলে বোধ করি আমরা বেশি দিন বাঁচব না– হায়, আমাদের কী শোচনীয় অবস্থা! অতএব শর্করা খেতেই হবে, এবং বিবরেও যতটা স্থান আছে সমস্ত আমরা এবং আমাদের শ্যালকেরা মিলে ভাগাভাগি করে নেব।