আমাদের দেশের বিবাহ-প্রণালীর মতো গোলাম-চোর খেলা আর নাই। প্রজাপতি তাস বিলি করিয়া দিয়াছেন। সত্য মিথ্যা জানি না, বিবাহিত বন্ধুবান্ধবের মুখে শুনিতে পাই যে, তাসে গোলামের ভাগই অধিক। চৌধুরী হালদারের হাত হইতে তাস টানিবে; দেখিয়া টানা-পদ্ধতি নাই। চৌধুরীর হাতে যদি দুরি থাকে আর হালদারের হাতেও দুরি থাকে তবেই শুভ, নতুবা যদি গোলাম টানিয়া বসেন, তবেই সর্বনাশ। আন্দাজ করিয়া টানিতে হয়, আগে থাকিতে জানিবার উপায় নাই। কিন্তু কী আশ্চর্য। কোথায় চৌধুরী কোথায় হালদার; হালদারের হাত হইতে চৌধুরী দৈবাৎ একটা তাস টানিল, চৌষট্টিটা তাসের মধ্যে হয়তো সেইটাই মিলিয়া গেল। যেই মিলিল, অমনি মিল-দম্পতি বিশ্রাম পাইল। অন্যান্য অবিবাহিত তাসেরা হাতে হাতে মিল অনুসন্ধান করিয়া ফিরিতে লাগিল, তাহাদের আর বিরাম বিশ্রাম নাই। এইখানে সাধারণকে বিদিত করিতেছি, আমি একটি অবিবাহিত তাস আছি, আমার মিল কাহার হাতে আছে জানিতে চাই। আমার বন্ধুবান্ধবেরা আমাকে বলেন, গোলাম। বলেন, আমার মিল ত্রিজগতে নাই। যে কন্যাকর্তা টানিবেন তিনি গোলাম-চোর হইবেন। কিন্তু বোধ করি, তাঁহারা রহস্য করিয়া থাকেন, কথাটা সত্য নহে।
অনেক অসাবধানী এমন আলগা করিয়া তাস ধরেন, তাঁহাদের হাতের কাগজ সকলেই দেখিতে পায়। পাঠকেরা যেন এমন করিয়া তাস না ধরেন। এমন অনেক বড়ো বড়ো ধনী খেলোয়াড় দেখিয়াছি, তাঁহারা এমনই আলগা করিয়া তাস ধরেন যে, প্রতিবেশীরা তাঁহাদের হাত হইতে আবশ্যকমতো সাতা টানে, আটা টানে, নহলা টানে, তাঁহারা মনে মনে ফুলিতে থাকেন, তবে বুঝি গোলামটাও টানিবে। তাঁহাদের হাতের কাগজ সব ফুরাইয়া যায়, কেবল গোলামটাই অবশিষ্ট থাকে।
পাঠকদের হাতে যদি গোলাম আসিয়া থাকে, চালান করিয়া দিবার কৌশল অবগত হউন। কোনো মতে মুখ-ভাবে না প্রকাশ হয়, হাতে গোলাম আছে। অনেক বড়ো বড়ো হৌসের হাতে গোলাম আসিয়া থাকে, লোকে যদি অঙ্কুশ মাত্রে জানিতে পারে যে, হৌসের হাতের কাগজে গোলাম দেখা দিয়াছে, তাহা হইলেই তাহার খেলা সাঙ্গ হয়। যে পরিবারের হাতে মূর্খ বরের গোলাম আছে, তাহারা যদি চারি দিকে কেতাব ছড়াইয়া রাখে, মুখস্থ বুলি বলিতে পারে, তাহা হইলে তাহারাও গোলাম চালাইয়া দিতে পারে। তুমি আমি যদি এ সংসারে মুখের জোরে চলিয়া যাইতে পারি, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পারি, রায় বাহাদুর হইতে পারি, তাহা হইলে আরও অনেক গোলাম চলিয়া যাইতে পারে।
একে তো গোলাম-চোর হইতেই বিশেষ আপত্তি আছে, তাহাতে যদি জানিতে পারি যে, আর একজন কৌশল করিয়া ভাঁড়াইয়া আমার হাতে গোলামটি চালান করিয়া দিয়াছেন, তাহা হইলে কিছু অপ্রস্তুত হইতে হয়। সংবাদপত্র ও মাসিকপত্রে সমালোচনা ও বিজ্ঞাপন যাঁহারা পাঠ করেন তাঁহারা ট্যাঁকের পয়সা খরচ করিয়া সহসা আবিষ্কার করেন, যে, গোলাম-চোর হইয়াছেন। সত্য কথা বলিতে কী, অনেক পাঠক তাসের কাগজ চেনে না, তাঁহারা অনেক সময়ে জানিতেই পারেন না যে, তাঁহারা গোলাম টানিয়াছেন। রঙচঙ দেখিয়া তাঁহারা ভারি খুশি হন, কিন্তু যাঁহারা তাসের কাগজ চেনেন, তাঁহারা গোলাম-চোরকে দেখিয়া মনে মনে হাসেন।
যাহা হউক, পাঠকেরা একবার ভাবিয়া দেখুন, কতবার গোলাম-চোর হইয়াছেন, কত রঙের গোলাম তাঁহার হাতে আছে। প্রকাশ করিবার আবশ্যক নাই, কথাটা চাপিয়া রাখুন, কিন্তু প্রতিবেশী গোলাম-চোর হইলে তাহা লইয়া অতিরিক্ত হাস্য-পরিহাস না করেন।
ভারতী, আষাঢ়, ১২৮৮
ঘানির বলদ
ঘানির বলদ যদি মনে করে আমি যতই ঘুরছি ততই নূতন রাজ্য আবিষ্কার করছি তবে সেটা তার একটা অন্ধ ভ্রম, কিন্তু সে যদি জানে আমি সর্ষেকে পেষণ করে তার মধ্যেকার নিগূঢ় তেলটকু বের করে নিচ্ছি তবে সে ঠিক কথাটা জানে।
বিজ্ঞান নিজের ঘানিযন্ত্রের চতুর্দিকে যতই সশব্দে ঘুরছে, রহস্যরাজ্যের সীমার দিকে এক পা অগ্রসর হতে পারছে না, কিন্তু বিবিধ বীজকে বিশ্লেষণ এবং পেষণ করে তার ভিতরকার তেল অনেকটা পরিমাণে বের করছে, এবং সে তেল থেকে মানুষের গৃহকোণের অন্ধকার দূর করবার একটা উপাদান তৈরি করছে সে কথা নিয়ে সে বাস্তিবিক গর্ব করতে পারে।
পারিবারিক স্মৃতিলিপি পুস্তক,
চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য পেয়
জঠর-তত্ত্ববিৎ বুধগণ উদর-সেবাকে চারি ভাগে বিভক্ত করিয়াছেন। চর্বণ করা, শোষণ করা, লেহন করা ও পান করা। আহারের অনুষঙ্গিক ও অত নিকট সম্পর্কীয় একটি পদার্থ আছে, পুরাতন নস্য-সেবকেরা তাহাকে অনাদর করিয়াছেন যথা, ধূমায়ন অর্থাৎ ধোঁয়ান। যাহা হউক, “ভক্ষণ ও ভক্ষণায়ন’ সভার সভ্যগণ তঁহাদের শাস্ত্রের পাঁচটা পরিচ্ছেদ নির্মাণ করিয়াছেন, প্রথম চর্ব্য; দ্বিতীয় চোষ্য; তৃতীয় লেহ্য; চতুর্থ পেয় ও পঞ্চম ধৌম্য। এই শেষ পরিচ্ছেদটাকে অনেকে রীতিমতো পরিচ্ছেদ বলিয়া গণনা করেন না, তাঁহারা ইহাকে পরিশিষ্ট স্বরূপে দেখেন।
আমাদের বুদ্ধির খোরাককেও এইরূপ পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা যায়। শ্রীযুক্ত লালা আহার-বিহারী উদরাম্বুধি মহাশয় দেখিবেন, তাঁহাদের ভোজের সহিত বুদ্ধির ভোজের যথেষ্ট সৌসাদৃশ্য আছে।
চর্ব্য। কাঁচা, আভাঙা সত্য। ইহা একেবারে উদরে যাইবার উপযোগী নহে। গলা দিয়া নামে না, পেটে গিয়া হজম হয় না। ইহা অতিশয় নিরেট পদার্থ। ইংরাজি বুদ্ধিজীবী ঔদারিকগণ ইহাকে পতদঢ়ড় বলেন। যদি ইহাকে দাঁত দিয়া ভাঙিয়া ভাঙিয়া, বিশ্লেষণ করিয়া, রহিয়া বসিয়া না খাও, যেমন পাও তেমনি গিলিতে আরম্ভ কর তবে তাহাতে বুদ্ধিগত শরীরের পুষ্টি সাধন হয় না। এইটি না জানার দরুন অনেক হানি হয়। স্কুলে ছেলেদের ইতিহাসের পাতে যে আহার দেওয়া হয় তাহা আদ্যোপান্ত চর্ব্য। বেচারিদের ভাঙিবার দাঁত নাই, কাজেই ক্রমিক গিলে। কোন্ রাজার পর কোন্ রাজা আসিয়াছে; কোন্ রাজা কোন্ সালে সিংহাসন প্রাপ্ত হইয়াছে ও কোন্ সালে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইয়াছে, এই-সকল শক্ত শক্ত ফলের আঁঠিগুলি তাহাদের গিলিতে হয়। মাস্টারবর্গ মনে করেন, ছাত্রদের মনের ক্ষেত্রে এই যে-সকল বীজ রোপণ করিতেছেন, ভবিষ্যতে ইহা হইতে বড়ো বড়ো গাছ উৎপন্ন হইবে। কথাটা যে চাষার মতো হইল; কারণ, এ যে ক্ষেত্র নয়, এ পাকযন্ত্র। এখানে গাছ হয় না, রক্ত হয়। আজকাল য়ুরোপে এই সত্যটি আবিষ্কৃত হইয়াছে ও পাঠ্য ইতিহাস লিখিবার ধারাও পরিবর্তিত হইয়াছে। এখনকার ইতিহাস কতকগুলা ঘটনার সংবাদপত্র ও রাজাদিগের নামাবলী নহে। অবশ্য চর্ব্য পদার্থের কাঠিন্যের কমবেশ পরিমাণ আছে। কোনোটা বা চিবাইতে কষ্ট বোধ হয় না মুখে দিলেই মিলাইয়া যায়, কোনোটা চিবাইতে বিষম কষ্ট হয়। যাঁহাদের বুদ্ধি দাঁত-ওয়ালা, চর্ব্য তাঁহাদের স্বাভাবিক খাদ্য। তাঁহারা কঠিন কঠিন চর্ব্যগুলিকে লইয়া বিশ্লেষণ দাঁত দিয়া ভাঙিয়া, মুখের মধ্যে আনুমানিক ও প্রামাণিক যুক্তির রসে রসালা করিয়া লইয়া এমনি আকারে তাহাকে পরিণত করেন যে, তাহার চর্ব্য অবস্থা ঘুচিয়া যায় ও সে পরিপাকের উপযোগী ও রক্ত-নির্মাণক্ষম হইয়া উঠে। ইহা একটি শারীর-তত্ত্বের নিয়ম যে, খাদ্য যতক্ষণ চর্ব্য অবস্থায় থাকে, অর্থাৎ পতদঢ়ড় যখন কেবলমাত্র পতদঢ়ড় রূপেই থাকে, ততক্ষণ তাহা রক্ত নির্মাণ করিতে পারে না, রক্তের সহিত মিশিতে পারে না। তাহার সাক্ষ্য, আমাদের অসংখ্য এম-এ বি-এ’দের খাইয়া খাইয়া পিলে হয়; উদরী হয়; কাহারো কাহারো বা অপরিমিত চর্বি হয়, ও বাহির হইতে বিষম বলিষ্ঠ বলিয়া বোধ হয়; কিন্তু বল হয় না।