১৬
কারণ, আমার হৃদয়ের মধ্যস্থিত আদর্শ আমার চেয়ে বড়ো। তাহা আমার মনুষ্যত্ব। আমি আমার ধর্মজ্ঞানের হাতে একটি যন্ত্রমাত্র। সে আমাকে দিয়া তাহার কাজ করাইয়া লইতে চায়। আমার একমাত্র দুঃখ এই যে আমি তাহার উপযোগী নহি– আমার দ্বারা তাহার কাজ সম্পন্ন হয় না। আমি দুর্বল। তাহার কাজ করিতে গিয়া আমি ভাঙিয়া যাই। কিন্তু সেই ভাঙিয়া যাওয়াতে আনন্দ আছে। মনে এই সান্ত্বনা থাকে যে, তাহারই কাজে আমি ভাঙিলাম। আমি নিষ্ফল হইলাম বলিতে বুঝায়, আমার প্রভুর কাজ হইল না। মনুষ্যত্ব আমাকে আশ্রয় করিয়া মগ্ন হইল। স্বামিন্, তোমার আদেশ পালন হইল না!
১৭
সাধারণের কাছ হইতে যে ব্যক্তি খ্যাতি উপহার পায় তাহার রক্ষা নাই। এ বিষকন্যার হাতে যদি মৃত্যু না হয় তো বন্দী হইতে হইবে। এই খ্যাতি তাপসের তপস্যা ভঙ্গ করিতে সাধকের সাধনায় ব্যাঘাত করিতে আসে। যে ব্যক্তি সাধারণের প্রিয় সাধারণ তাহার জন্য আফিম বরাদ্দ করিয়া দেয়, সাধারণের দাঁড়ে বসিয়া সে ঝিমাইতে থাকে, সে আগেকার মতো তাহার ডানাদুটি লইয়া মেঘের দিকে তেমন করিয়া আর উড়িতে পারে না। তার পরে এক দিন যখন খামখেয়ালি সাধারণ তাহার সাধের পাখির বরাদ্দ বন্ধ করিয়া দিবে, তখন পাখির গান বন্ধ তাহার প্রাণ কণ্ঠাগত।
ভারতী, ভাদ্র, ১২৯২
ভানুসিংহ ঠাকুরের জীবনী
ভারতবর্ষের কোন্ মূর্খ বা কোন্ পণ্ডিত কোন্ খৃস্টাব্দে জন্মিয়াছিলেন বা মরিয়াছিলেন, তাহার কিছুই স্থির নাই, অতএব ভারতবর্ষে ইতিহাস ছিল না ইহা স্থির। এ বিষয়ে পণ্ডিতবর হচিন্সন সাহেব যে অতি পরমাশ্চর্য সারগর্ভ গবেষণাপূর্ণ যুক্তিবহুল কথা বলিয়াছেন তাহা এইখানে উদ্ধৃত করি– “প্রকৃত ইতিহাস না থাকিলে আমরা প্রাচীনকালের বিষয় অতি অল্পই জানিতে পারি!
আমাদের দেশে যে ইতিহাস ছিল না, এবং ইতিহাস না থাকিলে যে কিছুই জানা যায় না তাহার প্রমাণ, বৈষ্ণব চূড়ামণি অতি প্রাচীন কবি ভানুসিংহ ঠাকুরের বিষয় আমরা কিছুই অবগত নহি। ইহা সামান্য দুঃখের কথা নহে। ভারতবর্ষের এই দূরপনেয় কলঙ্ক মোচন করিতে আমরা অগ্রসর হইয়াছি। কৃতকার্য হইয়াছি এই তো আমাদের বিশ্বাস। যাহা আমরা স্থির করিয়াছি, তাহা যে পরম সত্য তদ্বিষয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় নাই।
কোন্ সময়ে ভানুসিংহ ঠাকুরের আবির্ভাব হইয়াছিল, তাহাই প্রথমে নির্ণয় করিতে হয়। কেহ বলে বিদ্যাপতি ঠাকুরের পূর্বে, কেহ বলে পরে। যদি পূর্বে হয় তো কত পূর্বে ও যদি পরে হয় তো কত পরে? বহবিধ প্রামাণ্য গ্রন্থ হইতে এ সম্বন্ধে বিস্তর সাহায্য পাওয়া যায়; যথা–
প্রথমত– চারি বেদ। ঋক্ যজু সাম অথর্ব। বেদ চারি কি তিন, এ বিষয়ে কিছুই স্থির হয় নাই। আমরা স্থির করিয়াছি, কিন্তু অনেকেই করেন নাই। বেদ যে তিন তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। ঋগ্বেদে আছে– “ঋষয় স্ত্রয়ী বেদা বিদুঃ ঋচো জুংযি সামানি।’ চতুর্থ শতপথ ব্রাহ্মণে কী লেখা আছে তাহা কাহারো অবিদিত নাই। বেদের সূত্র যাঁহারা অবসরমতে পড়িয়া থাকেন, তাঁহারাও দেখিয়া থাকিবেন তন্মধ্যে অথর্ব বেদের সূত্রপাত নাই। যাহা হউক, প্রমাণ হইল বেদ তিন বৈ নয়। এক্ষণে সেই তিন বেদে ভানুসিংহের বিষয় কী কী প্রমাণ পাওয়া যায় তাহা আলোচনা করিয়া দেখা যাক। বেদে ছন্দ মন্ত্র আছে, ব্রাহ্মণ আছে, সূত্র আছে, কিন্তু ভানুসিংহের কোনো কথা নাই। এমন-কি, বেদের সংহিতা ভাগে ইন্দ্র, বরুণ, মরুৎ, অগ্নি, রুদ্র, রবি প্রভৃতি দেবগণের কথাও আছে কিন্তু ইতিহাস রচনায় অনভিজ্ঞতাবশত ভানুসিংহের কোনা উল্লেখ নাই।
শ্রীমদ্ভাগবতে ও বিষ্ণুপুরাণে নন্দবংশ রাজগণের কথা পাওয়া যায়। এমন-কি, তাহাতে ইহাও লিখিয়ছে যে, মহাপদ্ম নন্দীর সুমাল্য প্রভৃতি আট পুত্র জন্মিবে– কৌটিল্য ব্রাহ্মণের কথাও আছে, অথচ ভানুসিংহের কোনো কথা তাহাতে দেখিতে পাইলাম না। যদি কোনো দুঃসাহসিক পাঠক বলেন যে, হাঁ, তাহাতে ভানুসিংহের কথা আছে, তিনি প্রমাণ প্রয়োগপূর্বক দেখাইয়া দিন– তিনি আমাদের এবং ভারতবর্ষের ধন্যবাদভাজন হইবেন।
আমরা ভোজ প্রবন্ধ আনাইয়া দেখিলাম, তাহাতে ধারা নগরাধিপ ভোজরাজার বিস্তারিত বিবরণ আছে। তাহাতে নিম্নলিখিত পণ্ডিতগণের নাম পাওয়া যায়– কালিদাস কর্পূর, কলিঙ্গ, কোকিল, শ্রীদচন্দ্র। এমন-কি মুচকুন্দ, ময়ূর ও দামোদরের নামও তাহাতে পাওয়া গেল, কিন্তু ভানুসিংহের নাম কোথাও পাওয়া গেল না।
বিশ্বগুণাদর্শ দেখো–মাঘশ্চোরো ময়ূরো মুরারি পুরসরো ভারবিঃ সারবিদ্যঃ
শ্রীহর্ষঃ কালিদাসঃ কবিরথ ভবভূত্যাদয়ো ভোজরাজঃ
দেখো, ইহাতেও ভানুসিংহের নাম নাই।
বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন উল্লেখ স্থলে ভানুসিংহের নাম পাওয়া যায় ভাবিয়া আমরা বিস্তর অনুসন্ধান করিয়া দেখিয়াছি–
ধন্বন্তরিঃ ক্ষপণকোমর সিংহ শঙ্কুর্বেতাল ভট্ট ঘটকর্পর কালিদাসাঃ
খ্যাতা বরাহ মিহিরো নৃপতেঃ সভায়াং রত্নানি বৈ বররুচির্ণব বিক্রমস্য।
কৈ ইহার মধ্যেও তো ভানুসিংহের নাম পাওয়া গেল না। তবে, কোনো কোনো ভাবুকব্যক্তি সন্দেহ করেন কালিদাস ও ভানুসিংহ একই ব্যক্তি হইবেন। এ সন্দেহ নিতান্ত অগ্রাহ্য নহে, কারণ কবিত্বশক্তি সম্বন্ধে উভয়ের সম্পূর্ণ সাদৃশ্য দেখা যায়।
অবশেষে আমরা বত্রিশ সিংহাসন, বেতাল পঁচিশ, তুলসীদাসের রামায়ণ, আরব্য উপন্যাস ও সুশীলার উপাখ্যান বিস্তর গবেষণার সহিত অনুসন্ধান করিয়া কোথাও ভানুসিংহের উল্লেখ দেখিতে পাইলাম না। অতএব কেহ যেন আমাদের অনুসন্ধানের প্রতি দোষারোপ না করেন– দোষ কেবল গ্রন্থগুলির।