পবর্গ বা বার্ধক্য। প্রৌঢ়ে যাহা নুইতে আরম্ভ করিয়াছিল, এখন তাহার (প)তন হইল। পতিত বৃক্ষকে যেমন সহস্র লতায় চারি দিক হইতে জড়াইয়া ধরে, তেমনি সংসারের সহস্র (ফাঁ)দে বৃদ্ধকে চারি দিক হইতে আচ্ছন্ন করে; ছেলে, মেয়ে, নাতি নাতনী ইত্যাদি। (বি)রাম, (বি)শ্রাম। (ভ্রা)ন্তি, (ভ)য়, (ভ)র, (ভি)ক্ষা ও অবশেষে (ম)রণ। ঢোলা নয়, নিদ্রা নয়, মহা নিদ্রা।
মানুষ (ক)(র্ম)-ক্ষেত্রে নামিল– ক হইতে আরম্ভ করিল, ম-য়ে শেষ করিল। কাঁদিয়া জন্মিল, ক্রন্দনের মধ্যে অপসারিত হইল। কিন্তু মানুষের এই সমগ্র জীবন আরম্ভ ক-বর্গের মধ্যে প্রতিবিম্বিত আছে। ক-বর্গে কী কী আছে? কাঁদা, খেলা, গেলা, ঘা লাগা ও উঁ আঁ করা। প্রথম কাঁদা, শৈশবের ক্রন্দন, দ্বিতীয় খেলা, কৈশোরের খেলা। তৃতীয় গেলা অর্থাৎ ভোগ, যৌবনের ভোগ। চতুর্থ ঘা লাগা, প্রৌঢ়ের শোক। পঞ্চম উঁ আঁ করা, বৃদ্ধের রোগ; বৃদ্ধের বিলাপ। জীবনের ভোজ অবসান হইলে যে-সকল ছেঁড়া পাত ভাঙা পাত্র, বিক্ষিপ্ত উচ্ছিষ্ট ইতস্তত পড়িয়া থাকে, তাহাও ক-বর্গের মধ্যে গিয়া পড়ে, যথা–(কা)ঠ, (খা)ট, (গ)ঙ্গার (ঘা)ট ও বিলাপের উঁ আঁ শব্দ। আরম্ভের সহিত অবসানের এমনি নিকট সম্বন্ধ।
অ আ প্রভৃতি স্বরবর্ণগুলি আমাদের জীবনের অনুভাবসমূহ। এগুলি ব্যতীত কোনো ব্যঞ্জনবর্ণ দাঁড়াইতে পারে না। জীবনের যে-কোনো ঘটনা ঘটুক-না তাহার সহিত একটা অনুভাবের স্বরবর্ণ লিপ্ত আছেই। কখনো বা তৃপ্তিসূচক আ, কখনো বা তীব্র যন্ত্রণা-সূচক ই, কখনো বা গভীর যন্ত্রণাসূচক উ, আমাদের ঘটনার ব্যঞ্জনবর্ণে যুক্ত হয়। মর্ত্য-জীবনের বর্ণমালায় সমুদয় ব্যঞ্জনবর্ণের সহিত অভাব-সূচক “অ’ লিপ্ত থাকে। তাহাই তাহার মূল সহচর। অদৃষ্ট আমাদের এই-সকল অক্ষর সাজাইয়া এক-একটা গ্রন্থ রচনা করিতেছে। কাহারো বা কাব্য হয়, কাহারো বা দর্শন হয়, কাহারো বা ছাড়া ছাড়া অর্থহীন কতকগুলা অক্ষর-সমষ্টি হয় মাত্র, দেখিয়া মনে হয়, তাহার অদৃষ্ট হাত পাকাইবার জন্য চিরজীবন কেবল মক্শো করিয়াই আসিতেছে, পদরচনা করিতে আর শিখিল না। এই সকল রচনার খাতা হাতে করিয়া বোধ করি পরলোকে মহাগুরুর নিকটে গিয়া একদিন দাঁড়াইতে হইবে; তিনি যাহাকে যে শ্রেণীর উপযুক্ত বিবেচনা করিবেন, উত্তীর্ণ করিয়া দিবেন।
বিষয়টা অত্যন্ত শোকাবহ হইয়া দাঁড়াইল। আমাদের আলংকারিকেরা বিয়োগান্ত নাটকের বিরোধী। তবে কেন আমাদের বৈয়াকরণিকেরা এমনতরো বিয়োগান্ত করুণ রসোদ্দীপক বর্ণমালার সৃষ্টি করিলেন? কিন্তু পাঠকেরা ভুলিয়া গেছেন, আমাদের সাহিত্যে পাঁচ অঙ্কেই নাটক শেষ হয় না, আরো দুটো অঙ্ক বাকি থাকে। পাঁচটা বর্গেই আমাদের বর্ণমালা শেষ হয় না, আরো দুটো বর্গ থাকে। মরণেই আমাদের জীবন-পুস্তকের সমাপ্তি নহে; তাহা একটা পদের পর একটা দাঁড়ি মাত্র। অমন কত সহস্র পদ আছে, কত সহস্র দাঁড়ি আছে কে জানে? অবশিষ্ট দুটি বর্গের কথা পরে বলিব; আপাতত পাঠকদিগকে আশ্বাস দিবার জন্য এইটুকু বলিয়া রাখি “হ’য়ে আমাদের বর্ণমালা শেষ। হ অর্থে হওয়া, মরা নহে। অতএব বিলাপ করিবার কিছুই নাই। আমাদের ব্যঞ্জনবর্ণ আমাদের নাটকের ন্যায় (কাঁ)দায় আরম্ভ (হা)সায় শেষ।
আমাদের বর্ণমালা “অহং’ শব্দের একটি ব্যাখা। অ-য়ে ইহার আরম্ভ, হ-য়ে ইহার শেষ!
ভারতী, আশ্বিন-কার্তিক, ১২৮৮
জীবনের বুদ্বুদ
মানুষকে দেখলে আমার অনেক সময়ে মনে হয়, গোলাকার মাথাটা নিয়ে পৃথিবী জুড়ে ক্রমাগতই কতকগুলো জীবনের বুদ্বুদ্ উঠছে। খানিকক্ষণের জন্যে সূর্যালোকে নীলাকাশের দিকে উন্মুখ হয়ে থাকে; তার পরে হঠাৎ ফেটে যায়, জীবনের তপ্তবাষ্পটুকু বেরিয়ে যায়, মৃত্তিকার আবরণটুকু এই মৃৎ-সাগরে মৃত্যুসাগরে লুপ্ত হয়, কারো গণনার মধ্যে আসে না।
উপমাটা অত্যন্ত পুরাতন, কিন্তু যখনই ভেবে দেখা যায় তখনই নূতন মনে হয়। মৃত্যুর চেয়ে পুরাতন এবং মৃত্যুর চেয়ে নূতন আর কিছু নেই।
পারিবারিক স্মৃতিলিপি পুস্তক,
ঠাকুরঘর
বড়ো ভয়ে ভয়ে লিখিতে হয়। এখানে সকলেই সকল কথা গায় পাতিয়া লয়। বিশেষত যদি দুটো অপবাদের কথা থাকে। মনে করি, এমন কৌশলে লিখিলাম যে, সকলেই মনে করিবে আমার প্রতিবেশীকে লক্ষ্য করা হইতেছে, ভারি খুশি হইবে; কিন্তু দেখি বিপরীত ফল হয়। সকলেই মনে করে ওর মধ্যে যে কথাটা সব চেয়ে গর্হিত সেটা বিশেষরূপে আমার প্রতি আড়ি করিয়াই লেখা হইয়াছে– নতুবা এমন লোক আর কে আছে!
ভান এবং অন্ধ অহংকারের উপর স্বভাবতই দুটো শক্ত কথা বলিতে ইচ্ছা করে। যদি ঠিক জায়গায় আঘাত লাগে তো খুশি হওয়া যায়। কিন্তু ও সম্বন্ধে কিছু নাড়া দিলেই দুই-দশজন নয় একেবারে দেশের লোকে তাড়া করিয়া আসে। ইহার কারণ কী?
তবে কি আমরা দেশসুদ্ধ লোকই ঠাকুরঘরে বসিয়া কলা খাইতেছি? অর্থাৎ যেটা দেবতার উদ্দেশে দেওয়া উচিত, গোপনে তাহার মধ্য হইতে উপাদেয় জিনিসটি লইয়া নিজে ভক্ষণ করিতেছি? আসলে, দেবতার প্রতি ষোলো-আনা বিশ্বাসই নাই?
যে নৈবেদ্যটা সম্পূর্ণ স্বদেশের প্রাপ্য তাহার সারভাগ নিজের জন্য সঞ্চয় করিতেছি। শাস্ত্রের দোহাই দিয়া অন্তগুqnu জড়ত্বটাকে দুধকলা খাওয়াইতেছি।
যে কারণেই হৌক, আমরা সহজে ঠাকুরঘর আর ছাড়িতে চাই না। কার্যক্ষেত্রে বিস্তর কাজ, এবং অনেক চিন্তা, এবং বাধা-বিপত্তির সঙ্গে কেবলই সংগ্রাম। কিন্তু ঠাকুরঘরে কোনো কাজকর্ম নাই; কেবলই স্তবপাঠ এবং ঘন্টানাড়া। অথচ নিজের কাছে এবং পরের কাছে অতি অল্প চেষ্টায় পরম পবিত্র ভক্তিভাজন হইয়া উঠা যায়।