এই-যে সমজদার-সম্প্রদায়, এরা খুশি হওয়া আর খুশি করার মন্ত্রে দীক্ষিত। এদের সাধনা দুঃখ ভুলবার সাধনা, দুঃখ দূর করবার সাধনা নয়। মন ভোলাবার মন্ত্র এরা জানে। একটা বড়কিছুর কাছে আত্মসমর্পণ করে এরা নিজেদের অবিক্ষুব্ধ রাখে।
.
পরিশিষ্ট
ওপরে যে-গতির কথা বলা হয়েছে, সে সম্বন্ধে আরো কয়েকটি কথা বলতে হচ্ছে। গতিকে মানলে হয়তো চলে না, জীবনের জড়ত্ব ঘোচাবার ক্ষমতা তারই হাতে। কিন্তু অসহায়ের মতো কেবল গতিকে মানলে জীবনে কতৃত্ব থাকে না। গতির মধ্যে স্থিতিকেও জানতে হবে। আর তা সম্ভব হয় চিরন্তনকে উপলব্ধি করলেই। শিল্পী-সাহিত্যিকরা তা-ই করেন। গতি থেকে চিরন্তনকে ছিনিয়ে নিয়ে রূপায়িত করাই এঁদের কাজ। আর রূপায়ণ মানে স্থিরতা দান–’অসীমের সীমা রচনা করা।” অনন্ত কালপ্রবাহ এই-যে স্থির ধ্রুবতারাবৎ সৃষ্টিসমূহ এরাই সংস্কৃতির উপাদান। এদের সম্বন্ধে সচেতন হয়েই আমরা মূল্যবোধের পরিচয় দেই।
কালপ্রবাহ অনবরত বয়ে চলেছে। বিরতিহীন তার গতি। কিন্তু এই চিরপ্রবহমান কালধারার বাধাকে অগ্রাহ্য করে এমন কতিপয় লোক আকাশে মাথা তুলে দাঁড়ান, আলোকস্তম্ভের মতো নিয়ত সম্মুখে থেকে যারা মানুষের পথচলাকে সুন্দর ও সার্থক করে তোলেন। তাঁরাই মানববন্ধু। তাঁদের দানে জীবন ভরে তোলাই সমৃদ্ধি।
বুদ্ধদেব-কনফুসিয়াস-সক্রেটিস-যিশুখ্রিস্ট-হজরত মুহম্মদ, কালিদাস-হাফেজ শেক্সপিয়ার-গ্যেটে-রবীন্দ্রনাথ, কালের গর্জন অগ্রাহ্য করে এঁরা দাঁড়িয়ে আছেন হিমালয়ের মতো উন্নতশিরে। এঁদের উন্নতশীর্ষকে অন্তরে ধারণ করতে না পারলে ‘সংস্কৃতিবান’ হওয়া যায় না। তাই সংস্কৃতির জন্য অতীতের জ্ঞান এত প্রয়োজনীয়। কেবল বর্তমান তরঙ্গের চূড়ায় চূড়ায় আবেগে উল্লাসি নৃত্য করলে সংস্কৃতি হয় না। অতীতে মানপর্যটন প্রয়োজনীয়। অতীতেরই একটা রূপ আছে, বর্তমানের নেই। বর্তমান চিরচলন্ত, চিরপরিবর্তমান, তাই রূপের সীমায় বাঁধা পড়ে না। অতীত রূপের সীমায় বাঁধা, সে একখানা ছবির বই। আর এই ছবির বইখানা হাতড়াতে হাতড়াতে অন্তরে যে সৌন্দর্য, যে-শ্রদ্ধা জাগে তা-ই সংস্কৃতি। (বলাবাহুল্য, এখানে অতীতের সুহৃদ সম্মিত রূপের প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে, প্রভুসম্মিত রূপের প্রতি নয়। প্রভুসমিত রূপ-যে অন্তরাত্মাকে চেপে রাখে, বিকশিত করে না, সে তো একরকম জানা কথা।)।
এখানেই প্রগতির সঙ্গে সংস্কৃতির বিরোধ বাধে। প্রগতি মানে কালের যাত্রাপথটি মসৃণ ও অব্যাহত রাখা। যেখানে-যেখানে অন্যায়-অবিচারের আবর্জনা পুঞ্জীভূত হয়ে সমাজের সার্থক প্রকাশকে ব্যাহত করে সেখানে সেখানে সেই আবর্জনাপ সরিয়ে দিয়ে গতিধারাকে মুক্ত করাই প্রগতির কাজ। কিন্তু শুধু তা করলেই সংস্কৃতি হয় না। সংস্কৃতি মানে কেবল কল্যাণ নয়, সৌন্দর্যও। সৌন্দর্যই বেশি। অনেক সময় অকল্যাণকে বরণ করে নিয়েই সৌন্দর্য সাধন করতে হয়। আগে কল্যাণ পরে সৌন্দর্য এমন তক খাটে না।
এই সৌন্দর্যসাধনের জন্য স্থিতির প্রয়োজন। দিনের চলমান অবস্থায় যে-সৌন্দর্য চোখে পড়ে না, রাত্রের স্থির অবস্থায় তাই মানসচক্ষে ফুটে ওঠে। তখন সৌন্দর্য আমরা শুধু দেখিনে, সৃষ্টিও করি; কেননা চোখের কাজের চেয়ে মনের কাজটাই তখন বড় হয়ে ওঠে। দিনে যে-সৌন্দর্য চেতনের ওপর আলগাভাবে পরশ বোলায়, রাত্রে তাই ফুটে ওঠে অচেতনের মায়ায় উজ্জ্বল হয়ে। গ্রহ-তারা দীপ জ্বালে যেন দিনের স্মৃতিকে মধুরতর, উজ্জ্বলতর করবার উদ্দেশ্যেই। দিনে কাজ, ছুটাছুটি, রাত্রে ধ্যান, কল্পনা। রহস্যের উপলব্ধি করা যায় রাত্রেই, দিনে নয়।
তাই দরকার স্থিরতার। কি ব্যক্তির জীবনে, কি জাতির জীবনে স্থিরতার প্রয়োজন অনিবার্য। স্থিরতার মানেই একটা অবস্থাকে মেনে নেওয়া, সেই অবস্থায় দুঃখবেদনা নিয়ে ছটফট না-করা। সার্থক নেতৃসম্প্রদায় তাই সমাজকে এমন একটি কালের তীরে এনে পৌঁছে দেন যেখানে নিশ্বাস ফেলবার ফুরসত পাওয়া যায়। নইলে কেবল প্রগতির তাগিদে চলতে আত্মহারা হয়ে পড়তে হয়। তখন সৌন্দর্য দেখার দৃষ্টি আর থাকে না। কাটা তোলার কাজে অতিরিক্ত রত থাকার দরুন ফুল দেখার দৃষ্টিটা বেমালুম হাতছাড়া হয়ে যায়।
(কবির ‘বুতশিকন’কে যে-কথাটা বলেছিলেন এখানে তা মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন : হে বুতশিকন তুমি-যে মূর্তি ভেঙে চলেছ তাতে তোমার ক্ষতিই হচ্ছে, কেননা তুমি কেবল মূর্তিই দেখতে পাচ্ছ, আল্লাহকে আর উপলব্ধি করতে পারছ না। তেমনি একালের প্রগতিবাদীদের সম্বোধন করে বলা যায় : হে প্রগতিবাদী সম্প্রদায়, তোমরা শুধু অন্যায়-অবিচারের কাঁটাই দেখলে–পৃথিবীপুষ্পে সৌন্দর্য আর উপলব্ধি করতে পারলে না। তোমরা দুর্ভাগ্য।)
বলাবাহুল্য এখানে প্রগতির বিরুদ্ধে বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। প্রগতি কোথায় সৌন্দর্যের গায়ে হাত তুলতে পারে সেদিকে ইঙ্গিত করাই আমার উদ্দেশ্য। প্রগতি আম-দরবারের ব্যাপার, সংস্কৃতি খাস-দরবারের। আম-দরবারের দাবি যখন প্রবল হয়ে ওঠে তখন খাস দরবারের দাবিটা বানচাল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেটা যেন না হয়।
কাঁটা তোলার ব্যর্থতা এখানে যে, কাটার অন্ত নেই। একভাবে-না-একভাবে তা দেখা দেবেই। তাই কাঁটা তোলার ব্যর্থতা সম্বন্ধে সচেতন আধুনিক কবির মুখে শুনতে পাই :