আমরা যে-যুগে বাস করছি, তাতে প্রকর্ষ এমন ছড়িয়ে পড়েছে যে, তরুণরা সেসব পাচ্ছে যেন নিশ্বাস প্রবাসের মতো সহজভাবে। কাব্য-দর্শন বিষয়ক চিন্তা আন্দোলিত হচ্ছে তাদের মধ্যে, তারা সেসব গ্রহণ করছে নিশ্বাস প্রশ্বাসের মতো, মনে করছে সেসব তাদের নিজস্ব সম্পদ, প্রকাশও করছে সেসব সেই ভঙ্গিতে। কিন্তু যুগের কাছ থেকে যা পেয়েছে তা যখন ফিরিয়ে দিচ্ছে সেই যুগকে, তখন তারা হয়ে পড়ছে নিঃস্ব। তারা যেন ফোয়ারা, কিছুক্ষণের জন্য চলে তাতে জলের খেলা কিন্তু জল নিঃশেষিত হবার সঙ্গে হয় তার শেষ।*[* কবিগুরু গ্যেটে ২য় খণ্ড–কাজী আবদুল ওদুদ]
আমাদের বেলাও তাই ঘটছে। যুগের জিনিস যুগকে ফিরিয়ে দেওয়ার পরে আমরাও নিঃশেষিত হয়ে পড়ি। গভীরতর প্রাপ্তির দিকে নজর নেই বলেই এমনটি ঘটে। নইলে জীবন এমন ফাঁকা হয়ে পড়ত না।
এই ধরনের বুদ্ধিসর্বস্ব অন্তঃসারশূন্য মানুষের দিকে তাকিয়ে গ্যেটে যে নৈরাশ্যব্যঞ্জক উক্তি করেছেন তাও এখানে উদ্ধৃতিযোগ্য। তিনি বলেছেন :
মানুষ আরো সচেতন আরো কুশাগ্রবৃদ্ধি হবে; কিন্তু থাকবে না তাদের মহত্ত্ব, সুখ, কর্মদক্ষতা, যদিও থাকে তবে বিশেষ বিশেষ যুগে। এমনকালের কথা ভাবতে পারি যখন ঈশ্বর মানুষে আর কোনো আনন্দ পাবেন না। তখন সব ভেঙেচুরে তিনি গড়বেন নতুন করে।*[ কবিগুরু গোটে ২য় খণ্ড-কাজী আবদুল ওদুদ]
আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তার জীবন উপভোগ করবার জন্য। যদি উপভোগনীয় কিছুই না রইল তবে তাকে আর রেখে কী লাভ? আল্লাহ্ উপভোগ করেন মানুষের ভেতরের বেদনশীলতা; আর তা বুদ্ধির ব্যাপার নয়, আত্মার ব্যাপার; তাই আত্মার তাগিদ তথা সৌন্দর্যের তাগিদ। মহত্ত্বের তাগিদ যখন ফুরিয়ে যায় তখন মানুষে আর আল্লাহর রুচি না-হওয়ারই কথা। আল্লাহ্ বেদনাহীন তথা মহত্বহীন জীবন পছন্দ করেন না।
(‘Man is not the last word of God’ বলে একালের লেখক বার্নার্ড-শও মানুষকে ভয় দেখিয়েছেন তার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বিখ্যাত গ্রহ ‘ব্যাক টু ম্যাথুশেলায়। আর হাক্সলির ব্রেভ নিউ ওয়ার্লড-এর অনুপম চরিত্র ‘স্যাভেজ’এর সৃষ্টিও এই বেদনাহীনতার প্রতিবাদেই।)
যেখানে পশুমানুষটি তলিয়ে গিয়ে মানুষ-মানুষটি বড় হয়ে ওঠে না; যেখানে প্রতিযোগিতা, প্রতারণা, প্রতিহিংসা প্রভৃতি নীচপ্রবৃত্তিসমূহের জয়জয়কার; সেখানে ক্রিয়েটিভিটি থাকতে পারে, কিন্তু সমজদারি নৈব নৈব চহারগীজ নিস্ত। রিফাইনমেন্ট সমজদারিরই দান, ক্রিয়েটিভিটির নয়। ক্রিয়েটিভিটির গায়ে অনেক সময় লেগে থাকে আদিমতার গন্ধ। তা দিয়ে বড়কিছু সৃষ্ট হলেও অনুপম কিছু সষ্ট হয় না। সমজদারির লক্ষ্য রূপান্তর–নিজের ভেতরের সুন্দর ও মহৎ মানুষটির উন্মোচন। যেখানে এই রূপান্তর নেই, সেখানে সমজদারি নেই সেখানে আছে কেবল চমক লাগানো শক্তির প্রকাশ। সমজদারি তো আর ক্রিয়েটিভিটির মতো একটা হঠাৎ-আসা ব্যাপার নয় যে, জীবনের ওপর প্রভাব না রেখে চলে যাবে। তা সাধনাল ব্যাপার আর সাধনার প্রভাব থাকেই। ক্রিয়েটিভিটি কথাটায় শক্তির প্রকাশই বড় হয়ে ওঠে, আত্মমার্জিতি নয়। সবচেয়ে বড় সৃষ্টি যে আত্মসৃষ্টি, ক্রিয়েটিভিটি বুলিবাদীদের পক্ষে তা বোঝা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই তাদের জীবন ও রচনা অসংস্কৃতির গন্ধমুক্ত হতে পারে না। জোয়ারের জলের মতো কোথাকার একটা শক্তি এসে তাদের তোলপাড় করে দিয়ে যায়, তারপরে যে দীনতা সে-দীনতা। জীবনের ওপর রচনার কোনো প্রভাব থাকে না বলে তাদের জীবন আর ইতর জীবনে বিশেষ কোনো পার্থক্য থাকে না। ক্ষণদ্যুতিকে স্থায়িত্ব দানের চেষ্টা হয় শুধু রচনায়, জীবনে নয়। তাই জীবন ফাঁকা থেকে যায়। (অথবা ভুল বলেছি, জীবন কোনোদিন ফাঁকা থাকে না, আল্লাহ না থাকলে সেখানে শয়তান থাকেই, সুন্দর না থাকলে তা অসুন্দরের আস্তানা হয়ে পড়েই।)
সমজদারদের কিন্তু ভিন্নধারা। অপরকে চমকে দেওয়া নয়, নিজেকে খুশি ও সুন্দর করাই তাদের উদ্দেশ্য। তা বিনয়ের সন্তান, অহমিকার নয়। নিজের কৃত্রিম ঔজ্জ্বল্যে পীড়া বোধ করা সমজদারিরই পরিচয়। অপরেরা যেখানে গর্বে মাথা উঁচায়, সমজদাররা সেখানে লজ্জায় অধোবদন হয়। মিথ্যা ঔজ্জ্বল্যে তারা তৃপ্ত হতে চায় না, ফাঁকি দিয়ে স্বর্গ কিনতে তারা নারাজ। তারা চায় আঁটি জিনিস। কৃত্রিমপণ্যে-যে জীবনের পরা ব্যর্থ হয়ে যায় তা তারা সবচেয়ে ভালো বোঝে।
বলেছি, সমজদারি ব্যর্থতার দান; প্রতিভা প্রকাশ করতে গিয়ে যারা ব্যর্থ হয় সাধারণত তারাই সমজদার হয়। অকৃতকার্যতাটা এখানে শাপে বর হয়ে দেখা দেয়। তাই ব্যর্থতা জিন্দাবাদ না বলে উপায় নেই। ব্যর্থতার দিকে মানুষকে ডাকুন, সমাজ সমৃদ্ধ হবে। বড় কাজে হাত দিয়ে যারা ব্যর্থ হয় তারাই তো সমাজকে সমৃদ্ধ করে তোলে। এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার :সমজদারও সৃষ্টি করে, কিন্তু সে বই নয়, শিল্প নয়, নিজের অন্তরাত্মা; আর অন্তরাত্মার চেয়ে বড় সৃষ্টি আর কী হতে পারে?
না, ব্যর্থতাকে ভয় করবেন না। সাহিত্যশিল্পের পথে পা বাড়ানো কি ব্যর্থতার পথে পা বাড়ানো নয়? ওপথে সার্থকতা লাভ করে আর কটি লোক? কিন্তু যারা ব্যর্থ হয় তাদের জীবনেও এমন একটা মূল্যবান জিনিসের আবির্ভাব হয় যা না হলে সমাজ-সভ্যতা সংস্কৃতির পথে এগিয়ে যেতে পারে না। এ ধরনের ব্যর্থলোকের দ্বারাই সমাজে নবপ্রাণ সঞ্চারিত হয়। পলিমাটি ফেলে-ফেলে এরাই সমাজকে উর্বর করে দিয়ে যায়, তাই এদের মূল্য অনেক। শুধু ঢাউস নামের অধিকারীদের মনে রাখা তো অনেক সময় একপ্রকারের মোহ, সত্যকার সচেতনতার পরিচয় দেওয়া হয় এদের মনে রাখলেই।