(প্রতিভাবান যে কখনো সমজদার হয় না, এমন কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। হয়, কিন্তু তাদের সংখ্যা নগণ্য। গ্যেটে-রবীন্দ্রনাথ আর কটি জন্মে? বেশিরভাগ প্রতিভাবানই তো সৃষ্টিমুহূর্তে মহান, পরমুহূর্তে সাধারণ। তারা সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু সৌন্দর্য কী বস্তু তা বলতে পারে না। তাই শিল্পী হলেও জীবনশিল্পী তারা হতে পারে না। মানুষের দুটো ক্ষমতা–নাড়া দেওয়ার ক্ষমতা আর সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা। নাড়া দেওয়ার ক্ষমতা প্রতিভাবানের, সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা রসিকের বা সমজদারের। নাড়া দেওয়ার ক্ষমতার অনুশীলনেই জীবন শিল্পমণ্ডিত হয়।
জীবনের দুটো শক্তি–নাড়া দেওয়ার শক্তি, আর সাড়া দেওয়ার শক্তি। নাড়া দেওয়ার শক্তি প্রতিভাবানের আর সাড়া দেওয়ার শক্তি সমজদারের। সাড়া দেওয়ার শক্তিটা খোদাদাদী, সমজদারের শক্তিটা সাধনা-লভ্য।
সমজদারি মানে মূল্যবোধের অনুশীলন। পিতার ধনে পোন্দারি করার সুযোগ পায় না বলে সমজদারদের মূল্যবোধের অনুশীলন করতে হয়। তাদের সাধনায় সমাজে মূল্যবোধ ছড়িয়ে পড়ে। সেটা একটা মদ-নয় ধরনের লাভ নয়, বিশেষ লাভ। এরই ফলে সমাজ সাধ্যানুসারে ক্ষমতা লাভ করে। মানুষের চলার পথটি সহজ করে দেওয়া নয়; কঠিন পথটি আনন্দময় করে তোলাই তার কাজ। শ্যামের বাঁশির দিকে কান রেখে পথের কাঁটা দলে চলার কায়দাটি সে বাতলে দেয়।
অধুনা সমজদারি কথাটা ক্রিয়েটিভিটির চেয়ে কম মূল্য পেলেও, আসলে কম মূল্য নয়। একটু তলিয়ে দেখলেই টের পাওয়া যাবে, সমজদারির হাতেই আত্মউৎকর্ষের ভার, ক্রিয়েটিভিটির হাতে নয়। ক্রিয়েটিভিটির হাতে কেবল আত্মপ্রকাশের ক্ষমতা। ভেতরে যা আছে তা বাইরে ঠেলে প্রকাশ করে দাও, এই তার হুকুম, ভেতরটা মেজেঘষে সুন্দর ও অনাবিল করে তোলো, অন্তরাত্মার পুষ্টিসাধন করো, এমন কথা সে বলে না। এই যে ভেতর থেকে বাইরে প্রকাশের তাগিদ এরই ফরাসি নাম ‘এলাভাইট্যাল’। বর্তমান জগৎ এরই প্রভাবে গতিচঞ্চল। প্রগতি এরই সন্তান। কেবল ব্যস্ততা, কেবল তাড়াহুড়া, কেবল ঠেলাঠেলি, অন্তরে কোনো গভীরতর প্রাপ্তির তাগিদ নেই। তাই, হালে কালচারের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ক্রিয়েটিভিটি কথাটা। গল্প কবিতা ও শিল্পসৃষ্টির দ্বারা সকলেই মানুষকে চমকে দিতে চায়, শিল্পসাহিত্যের প্রভাবে এসে নিজেকে সুন্দর ও মহান করে তুলতে চায় কম লোকই। আত্মমার্জিতির দিকে নয়, আত্মপ্রকাশের দিকেই সকলের ঝোঁক। সকলেই চায় প্রতিষ্ঠা। বছর বছর অজস্র পুস্তক প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও যে মানুষের তেমন উন্নয়ন হচ্ছে না তার হেতুও এখানে। মানসভাণ্ডার পূর্ণ করে দেওয়ার দিকে ঝোঁক নেই বলে অধুনা মানুষের অন্তর জীবনটা ফাঁকা ও ফাপা হয়ে পড়ছে। গভীর অনুভূতিতে মূক হয়ে যাওয়ায়, নীরবতার গানে কান পাতার প্রবৃত্তি কারো ভেতরেই নেই। সকলেই চায় কেবল দিতে, নিতে নয়। প্রশংসালোলুপ লেখক আর পাঠকে সমাজ ছেয়ে যাচ্ছে। সকলের মুখে কেবল বিশ্বের কথা; নিজের কথা, নিজের অন্তরাত্মার কথা কেউ আর বলে না। কিন্তু যতই আমরা বিশ্ববিধ করছি, ততই-যে অন্তরের দিক দিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছি, সেদিকে কারো হৃক্ষেপ নেই। বিশ্ববুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে অন্তরের নিঃস্বতা ঢাকবার একটা উপায়, এমনি মনে হয়। গভীরতর প্রাপ্তির দিকে নজর নেই বলে রাজনীতির মতো সংস্কৃতি জিনিসটাও হইচই চর্চা হয়ে পড়েছে। সেখানেও দেখা দিয়েছে বুলিসর্বস্বতা। একটা আইডিয়ার প্রতিধ্বনি হয়ে চিন্তার বালাই থেকে মুক্তি পাওয়াই অধুনাতন সংস্কৃতির উদ্দেশ্য।
তাই পুঁথির প্রতাপ দেখে যখন মোহিতলাল শঙ্কিত হন তখন তার বিরুদ্ধে কিছুই বলার থাকে না। সত্যিই তো পুঁথি আজ জগদ্দল শিলার মতো মানুষের বুকের ওপর চেপে বসেছে, তার অন্তর বিকাশে সহায়তা করছে সামান্যই। ভূমাপ্রীতি তার লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য কেবল খণ্ডজ্ঞানে মস্তিষ্ক ভারাক্রান্ত করে তোলা। তাই আত্মার উজ্জীবন আর হয় না। লেখক কি পাঠক কেউই রূপান্তর কামনা করে না, সকলেই চায় শক্তির জলুস দেখিয়ে বাহবা পেতে। পাঠকদের যে গ্রহণ তাও যেন সেদিকে লক্ষ্য রেখেই। কথা বলে লোককে চমকে দেওয়ার জন্যেই তারা বই পড়ে, আত্মপুষ্টির জন্য নয়। বই পড়ার দরুন বুদ্ধিরই কসরত হয়, আত্মার অনুশীলন হয় না। মুখে মুখে আধুনিক ইনটেলেকচুয়াল বুলি, ভেতরে একটা ছদাবেশ, অসভ্যতার ওপর সভ্যতার পলেস্তারা। সকলেই চায় বিশ্বকে পরিবর্তিত করতে, নিজের রূপান্তরের দিকে কারোই কেঁক নেই। অথচ বিবের চেয়ে নিজের ওপরই যে আমাদের অধিকার বেশি, নিজেকেই যে সহজে বদলানো যায়, সে কথাটা আমাদের মনে থাকে না। নিজেকে নীরবে ফুলের মতো বিকশিত করে তোলার আনন্দ আজ আর কেউ চায় না, সকলেই চায় সমারোহ প্রকাশ। করার দিকেই সকলের ঝোঁক, হওয়ার দিকে নয়। অথচ কাশ্চারের উদ্দেশ্য-যে কিছু করা নয়, কিছু হওয়া সুন্দর হওয়া, প্রেমিক হওয়া, নবীন হওয়া এতো একরকম অবিসংবাদিত সত্য।
কিন্তু সচরাচর এই সত্যের প্রতি নজর রাখা হয় না বলে একপ্রকার সস্তা সংস্কৃতিতে জীবন ছেয়ে যায়। তাতে থাকে কেবল বুদ্ধির চটক, আত্মার গভীরতা নয়। তাই তা দিয়ে জীবনের দীনতা দূর হয় না। পুস্তক-বাহুল্যের দরুন এই-যে সস্তা সংস্কৃতি, এর অন্তঃসারশূন্যতার প্রতি গ্যেটে বহুপূর্বেই ইঙ্গিত করেছেন :