মনে করুন নটের পেশা আপনার মনঃপূত, সেদিকেই আপনার প্রতিভা সহজ পথ খুঁজে পাবে বলে আপনার বিশ্বাস। কিন্তু আপনার গুরুজনরা তা পছন্দ করেন না। তাদের কাছে হয় তা নীতির দিক দিয়ে নিন্দনীয়, নয় সামাজিকতার দিক দিয়ে নিম্নস্তরের। তাই তা থেকে বিরত করবার জন্যে যত প্রকারের চাপ সম্ভব তারা আপনাকে দেবেন। হয়, আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলে আমরা তোমার সম্পর্ক ছিন্ন করব বলে তারা আপনাকে শাসাবেন, নয়, কিছুদিনের মধ্যেই তুমি তোমার একগুয়েমির জন্য অনুতপ্ত হবে বলে ভয় দেখাবেন। কিন্তু আপনার দমলে চলবে না। হয়তো এ-কথা ঠিক যে আপনার গলার স্বর খারাপ, অভিনয়ের প্রতিভা আপনার নেই। কিন্তু তাহলেও থিয়েটারে যোগ দিয়ে উপযুক্ত লোকের কাছ থেকেই তা জানা ভালো, অনুপযুক্ত লোকের কথায় কান পাতা ঠিক হবে না। সময়ের অপব্যয়ের কথা বলবেন জানি। কিন্তু চিন্তার কারণ নেই, এর পরেও বহু সময় হাতে থাকবে। অপচয়ের ভয়ে নিজেকে সঙ্কুচিত করবেন না। জীবন যে ধনী, অপচয়ের দ্বারাই তা প্রমাণিত হয়। অতএব ভাবনা কী? একেবারে নির্ভুল জীবনযাপনের চেষ্টা ভালো নয়। প্রাণশক্তির অভাব ঘটে বলে তাতে জীবনে মর্চে পড়ে। অভিজ্ঞতাসম্পন্নদের কথায়ই আপনি কান পাতবেন, অভিজ্ঞতাহীনদের কথায় নয়। আপনি আপনার পথটি অনুসরণ করে চললে মুরব্বিরা একদিন না একদিন আপনাকে সমর্থন করবেনই–আপনি যত দেরিতে ভাবছেন তার বহু পূর্বেই। সুতরাং মাভৈ, নিষেধের কথা ভেবে না-হক নিজেকে বিচলিত করবেন না।
আপনি কি জানেন না, সমাজ-মরু সবসময়ই প্রতিভা-তরুর রস শুষে নিতে চায়; যন পারে না, তখন শত নির্যাতন সত্ত্বেও তরুটি ফুল ফোঁটায়, তখনই সে বলে ওঠে : দেখ দেখ কেমন ফুল ফুটিয়েছি। যেন এই ফুল ফোঁটানোর বাহাদুরিটা তারই। সমাজের মতো বেহায়া আর কে আছে? আপনি যে-পথে চলতে চেয়েছিলেন স্টেপথেই চলুন। দেখবেন সার্থক হলে পরিবারের লোকেরা আপনাকে গলার মালা করেই রাখবেন, না হলে অবশ্য ভিন্ন কথা।
কিন্তু সার্থক না হলেই যে আপনার জীবনটা বরবাদে গেল তা নয়। বরং আপনার মতো ব্যর্থলোকেরাই সমাজকে সমৃদ্ধ করে তোলে। যে সমাজে যত ব্যর্থলোকের বাস সে সমাজ তত ধনী। কেননা, ব্যর্থতার কথাটাই সাধনার কথা মনে পড়িয়ে দেয়। ব্যর্থলোকের সংখ্যা কম বলেই তো বাংলার মুসলমানসমাজ ব্যর্থ হল, বেশি বলে নয়। এ সমাজে-যে ব্যর্থলোকের সংখ্যা কম আশা করি কেউই তা অস্বীকার করবে না। আপনি কী বলবেন জানিনে, অমি তো দুচারটির বেশি দেখতে পাইনে। আপনি হয়তো বলবেন, কী বললেন? বাংলার মুসলমানসমাজে ব্যর্থলোক নেই? হায় আল্লা, আপনি অন্ধ, একেবারেই অন্ধ! আর আপনার অন্ধতার গোড়ায় রয়েছে আপনার রোমান্টিসিজম। রামাটিসিজমের হিটিজমে মুগ্ধ আছেন বলেই আপনি বাস্তবকে দেখতে পাচ্ছেন না; নইলে বলেন বাংলার মুসলমানসমাজে ব্যর্থলোক নেই, থাকলেও দুচারটি? না, আপনার সঙ্গে তর্ক বৃথা, আপনি একেবারে অবাস্তব। নইলে গরিবদের হাহাকারের কথা, আশান্বিত কর্মচারীদের নিরাশ হওয়ার কথা, নিশ্চয়ই জানতেন। কত লেকচারার-যে প্রফেসর, কত প্রফেসর-যে প্রিসিপ্যাল, কত প্রিসিপ্যাল-যে ডাইরেক্টর বাহাদুর হতে পারলেন না তার খবর রাখেন কি? রাখলে বাংলার মুসলমানসমাজে ব্যর্থলোক নেই, এমন কথা কখনো মুখে আনতেন না। চারিদিকে যেখানে ব্যর্থতা জড়ানো সেখানে ব্যর্থলোক দেখতে না-পারার মতো অন্ধতা আর কী হতে পারে?
আমি বলব, আপনি যে ব্যর্থতার কথা বলেছেন সে ব্যর্থতার প্রতি আমার দৃষ্টি নেই। পাকিস্তান হওয়ার পরে যেসব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, ম্যাজিস্ট্রেট কমিশনার, কমিশনার গভর্নর হতে না পেরে চোখের পানিতে বুক ভাসাচ্ছেন তাদের প্রতি আমি সম্পূর্ণ সহানুভূতিসম্পন্ন। কিন্তু আমি তাদের ব্যর্থতার কথা বলছিনে, বলছি সাধনার ব্যর্থতার কথা। সত্য সুন্দর বা কাল্পনিক কল্পনার ফলে যে ব্যর্থতার আবির্ভাব হয় সে ব্যর্থতার কথা।
সাধনা বাইরের দিকে ব্যর্থ হলেও ভেতরের দিকে কোনোদিন ব্যর্থ হয় না। বামন হয়ে যারা চাঁদের দিকে হাত বাড়ায় চাঁদের আলো কিছু না কিছু তাদের চিত্তে লেগে থাকেই। চাঁদকে তারা হয়তো পায় না, কিন্তু চাঁদের আলোকে পায়। যারা একটা বড় জিনিস চেয়ে ব্যর্থ হয়, তাদের অন্তরে সেই বড় জিনিসের ছাপ থেকে পারে না। তাই ছোট ব্যাপারে সার্থকতার চেয়ে বড় ব্যাপারে ব্যর্থতা অনেক ভালো। তাতে করে মানুষটি বড় হয়–তার ভেতরের কালিমা-কলুষ দূরীভূত হয়ে সে সুন্দর ও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আর এই ধরনের সুন্দর মানুষের সংস্পর্শে এসেই সমাজ সভ্যতা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এগিয়ে যায়। তাই বলেছি যে সমাজে যত ব্যর্থলোকের বাস সে সমাজ তত ধনী। (যে বনে যতবেশি ঝরা ফুল সে বনে ততবেশি বসন্তু এসেছে মনে করতে হবে। ব্যর্থলোকের সংখ্যা বাড়ার মানে কী? যারা সৌন্দর্যকে কামনা করে তাদের সংখ্যা বাড়া, যারা প্রেমকে কামনা করে তাদের সংখ্যা বাড়া, যারা সত্যকে কামনা করে তাদের সংখ্যা বাড়া, এক কথায় যারা সংস্কৃতিকে কামনা করে তাদের সংখ্যা বাড়া।
সাধনার দ্বারা সোনা হতে চেয়ে যদি আপনি ব্যর্থকাম হন তো তাতে দুঃখ নেই। কেননা, সোনা না হলেও আপনি কষ্টিপাথর হবেনই। আর সংস্কৃতিক্ষেত্রে কষ্টিপাথর হওয়াটাও কম কথা নয়। কষ্টিপাথর হওয়ার দরুন সোনা কী চিজ তা আপনি সহজেই বলতে পারবেন। তাই সভ্যতা-সৃষ্টির ব্যাপারে আপনার মূল্য অনেক–এমনকি প্রতিভাবানের চেয়েও বেশি। বেল সাহেব যখন বলেন, সভ্যতা প্রতিভার সৃষ্টি নয়, সমজদারির সৃষ্টি তখন ঠিকই বলেন। যে সমাজে সমজদারি যতবেশি সেসমাজ ততবেশি সভ্য। সমজদারি মানে মূল্যবোধ। মূল্যবান শিল্প রচনা করলেও সব প্রতিভাবান মূল্যবোধের পরিচয় দেয় না। আর্ট সৃষ্টি করলেও অনেক সময় তা প্রাকৃতই থেকে যায়, আর্ট হয় না। তাদের রচনার পশ্চাতে থাকে একটা অন্ধ প্রেরণা, চক্ষুম্মান প্রচেষ্টা নয়। সমজদারের বেলা কিন্তু বড় হয়ে ওঠে চক্ষুম্মান প্রয়াস। সে যা হতে চায় তাই হয়, অন্ধ প্রেরণার তাগিদে কিছু হয় না। প্রতিভাবান একতরফা, একঝোকা, সমজদার বহভঙ্গিম। বহু প্রতিভাকে হজম করেই সমজদার সমজদার। সে স্রষ্টা না হলেও ভোক্তা, ভোজ্যদ্রব্যের মূল্য সম্বন্ধে সচেতন। প্রতিভাবানদের অনেক সময়ই সে চেতনা থাকে না। কাজেই প্রতিভা প্রকাশ করতে গিয়ে যদি আপনি ব্যর্থ হন তো তাতে বিশেষ দুঃখ নেই। কেননা, পরিণামে আপনি সমজদার হবেনই, আর সমজদার না হলেও নয়, হলেই সমাজের লাভ।