প্রেম সে তো আগুনের শিখা, অন্তরেতে চির অনির্বাণ,
অবসন্ন নয় কভু তাহা, নহে কভু রুগণ, পরিম্লান।
এখন ক্রুচ সাহেব ট্র্যাজেডি সম্বন্ধে যা বলেছেন, তার আলোচনা করছি। তার মতে ইবসেনের ‘গোসূটের চেয়ে শেক্সপিয়ারের ‘কিং লিয়র অনেক বড়। আমার মতও তাই। কিন্তু তাই বলে সেকালের মানুষের তুলনায় একালের মানুষকে হীন বলা যায় না। এ-যুগে যে কিং লিয়রের মতো বই লেখা যায় না তার কারণ এযুগের মানুষের অবনতি নয়, উন্নতি। গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলেই মানুষ ব্যক্তি বিশেষের রাজসিক বিষাদের গুণকীর্তন করতে অনিচ্ছুক। সেকালে অনেকগুলি মানুষ বাঁচত একটি মানুষের বিকাশের দিকে লক্ষ্য রেখে। একালে তা আর হচ্ছে না। কিং লিয়র যে-মনোভঙ্গির সৃষ্টি, হালে সে মনোভঙ্গির কোনো মর্যাদা নেই বলেই ব্যক্তিতান্ত্রিক ট্র্যাজেডি সৃষ্টির চেষ্টা ব্যর্থ। শেক্সপিয়ার বলেছেন :
রাজা যখন মরে আকাশেতে ধূমকেতু ভায়,
ভিখারি যখন মরে কভু কিছু ঘটে না তথায়।
একটি চাল টিপলে যেমন সমস্ত ভাতের অবস্থা জানতে পারা যায়, তেমনি এই একটি উক্তির দ্বারাই সেকালের সমগ্র দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে। শেক্সপিয়ার যুগের ধারণার বশবর্তী না হয়ে পারেননি। তাই দেখতে পাওয়া যায় কবি ‘সিনা’র মৃত্যু কমিক হাস্যকর, আর ‘সিজার’ ‘ব্রুটাস’-এর মৃত্যু ট্র্যাজিক বিষাদাস্ত। যুগের ভাবনার সঙ্গে পুরোপুরি বুক মেলাতে পেরেছিলেন বলেও শেক্সপিয়ার কিং লিয়রের মতো অনবদ্য নাটক রচনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। একালের নাট্যকার যদি তাদের যুগের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে যেতে পারেন তো তারাও অনুরূপ সার্থক গ্রন্থ রচনা করতে সক্ষম হবেন। একালে বড় হয়ে উঠেছে সমাজ, ব্যক্তি নয়। তাই এ-যুগে ট্র্যাজেডি লিখতে হবে সমাজকে নিয়ে ব্যক্তিকে নিয়ে লিখলে তেমন সার্থকতা পাওয়া যাবে না। তেমনি একটি গ্রন্থ হচ্ছে আরনেস্ট টলারের Massemensch (Massess & Man)। গ্রন্থটির মর্যাদা যে অতীতের শ্রেষ্ঠ নাটকসমূহের সমান, এ কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু এই বলতে চাই যে, গাম্ভীর্য, মহত্ত্ব ও বীর্যে ওদের সঙ্গে এটির সাদৃশ্য রয়েছে। এরিস্টাটল-কথিত ‘দুঃখ ও ভীতির তাড়নায় মানবঅন্তরের নির্মলতা সাধনের ক্ষমতা এর আছে। এই ধরনের ট্র্যাজেডি খুব বিরল–’লাখে মিলে না এক। ট্রাজেডি লিখতে হলে ট্র্যাজেডি অনুভব করতে হবে। আর ট্রাজেডি অনুভব করতে হলে যুগের মর্মে প্রবেশ করা দরকার। শুধু বুদ্ধি দিয়ে নয়; রক্ত দিয়ে, শিরা-উপশিরা দিয়ে, স্নায়ু দিয়ে যুগকে জানতে হবে।
ক্রুচ সাহেব যেরূপ সাহসের সঙ্গে নিরানন্দ জগৎকে স্বীকার করে নেন তাতে পাঠকরা তার প্রতি শ্রদ্ধাসম্পন্ন না হয়ে পারেন না। বীরের মতনই তিনি সমস্ত দুঃখের বোঝা মাথায় তুলে নিতে চান। কিন্তু জগৎকে নিরানন্দ মনে করার সত্যকার কোনো কারণ আছে কি? নতুন অবস্থার সংস্পর্শে এসে পুরাতন মূল্যবান আবেগগুলির জন্ম দিতে পারছেন না বলেই ক্রুচ ও জুচের মতো অতীত প্রেমিক লেখকদের কাছে জগৎ নিরানন্দ। বর্তমানের সঙ্গে বুক মেলালে তারাও বুঝতে পারতেন শেক্সপিয়ার যে মহৎ আবেগের অধিকারী তারাও তা থেকে বঞ্চিত নন। শেক্সপিয়ারের পথটি অনুসরণ করছেন না বলেই তাদের এই দুর্দশা। ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ যুগের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। মহৎ আবেগের উপাদান বর্তমানেও আছে। কিন্তু সমাজবোধ বর্জিত বলে সাহিত্যিকগোষ্ঠী তার স্বাদ থেকে বঞ্চিত। নইলে এ-যুগে বাঁচবার মতো কিছু নেই, এমন কথা তাঁরা বলতে পারতেন না। তাদের দুর্ভাগ্যের কারণ তারা নিজেরাই। যৌবনের অতিভোগ ও বাস্তববর্জিত অত্যধিক মননের ফলেই এই দুঃখবাদ। এর থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন। আর বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উপায় হচ্ছে কাজে নামা। কাজই আমাদের সুস্থ মানসিকতা দিতে পারে; আর কেউ না, আর কিছু না। যারা কাজ করে, তারাই আনন্দ পায়। জগতের স্বাদ-গন্ধ তাদের জন্য।
তাই, যাঁরা আর আনন্দ পাচ্ছেন না, জগতে বাচবার মতো কিছুই দেখছেন না, তাদের কাছে আমার অনুরোধ : লেখা ছেড়ে দিন, যদি সহজে ছাড়তে না পারেন তো জোর করে ছাড়ার চেষ্টা করুন। চিন্তার খোলস ত্যাগ করে জগতের পথে বেরিয়ে আসুন। নিজেকে এমন একটি অবস্থায় দাঁড় করান যেখানে প্রাথমিক শারীরিক প্রয়োজনগুলির দাবি মেটানোই হবে প্রথম ও প্রধান কাজ। তাহলেই দেখতে পাবেন আপনি পুনরায় জীবনে ফিরে এসেছেন, আর জীবনে ফিরে এসেছেন বলে সুখ পাচ্ছেন। মন নিয়ে অধিক নাড়াচাড়া করতে করতে আপনি মনকে বিগড়ে দিয়েছেন। এবার মনোবিহীন হয়ে বাস্তবের সুস্থ স্পর্শে আপনার সহজ ভোগ কামনাকে জাগিয়ে তুলুন।
লেখার সত্যকার আকুতি আপনার ভেতর থাকলে আপনি অবশ্যই আবার লেখায় ফিরে আসবেন। আর এবার লেখা আপনার কাছে বাজে মনে হবে না বলে আপনি লিখে প্রচুর আনন্দও পাবেন।* [* কোনো ইংরেজ লেখকের অনুসরণে। লেখক]
ব্যর্থতা জিন্দাবাদ
বৃদ্ধ ও তরুণ উভয়েরই নিজের ইচ্ছামতো কাজ করার এমনকি ভুল করার অধিকার থাকা চাই, নইলে সমাজে প্রাণদৈন্যের অবধি থাকে না। প্রাণপ্রদায়ী ব্যাপারে যেমন বিয়ে, বৃত্তি নিরূপণ, বন্ধুনির্বাচন প্রভৃতি বিষয়ে যদি তরুণরা বৃদ্ধের উপদেশ মেনে চলে তো ভুল করবে। যে জাতির তরুণরা এসব বিষয়ে স্বাধীনতার পরিচয় দেয় না, সে জাতি মৃত, তার কাছ থেকে দুনিয়া কিছু আশা করতে পারে না। সে পৃথিবীর বোঝাস্বরূপ।