মোতাহের হোসেন চৌধুরী সভ্যতা’ গ্রন্থটির অনুবাদ ছাড়াও বাট্রান্ড রাসেলের ‘দি কংকোয়েস্ট অফ হ্যাপিনেস’ গ্রন্থটির মূলানুসরণে ‘সুখ’ গ্রন্থটি রচনা করেন। বহুলাংশে এই গ্রন্থ মূল বইটির অনুবাদ হলেও বেলের অনুসরণে সভ্যতার’ রচনার মতো এখানেও তিনি নিজের মতামত সুন্দরভাবে গ্রথিত করেছেন। অনুবাদগ্রন্থ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তার অনিন্দ্য রুচি ও জীবনবোধের প্রভাব লক্ষ করা যায়। তিনি বেছে বেছে সেসব বইকেই অনুবাদের জন্য গ্রহণ করেছেন যেগুলো তাঁর চিন্তা ও রচনায় উজ্জ্বল রশ্মি ফেলেছে বিভিন্ন সময়ে।
মোতাহের হোসেন চৌধুরী শুধু একজন বুদ্ধিনিষ্ঠ প্রবন্ধের রচয়িতা নন, মূলত তিনি একজন কবিও। সত্যিকারভাবে বলতে গেলে যে-কোনো মহৎ শিল্পীই প্রকৃত প্রস্তাবে কবি। কিন্তু প্রবন্ধরাজ্যে তিনি যেমন অনন্য ও একক–কারো সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে যান না, বক্তব্যের ব্যাপারে স্থির ও পৃথক বিশ্বাসে বলীয়ান এবং সত্যনিষ্ঠ, কবিতার ক্ষেত্রেও তিনি তেমনি অনন্য ও উদার। সেখানেও তাঁর পরিচ্ছন্ন হৃদয় ও সুন্দর অন্বেষার পরিচয় ফুট। তাই তিনি তাঁর প্রার্থনায় যাচনা করেন :
হে আল্লাহ!
বুদ্ধি দাও, শান্তি দাও, অনুভূতি দাও, কল্পনা দাও।
সৃষ্টিপথের মর্মকোষের মধুপানের ক্ষমতা দাও।
জীবনকে আনন্দিত করো, সার্থক করো, উজ্জ্বল করো;
উদ্যোগী করো, প্রাণবান করো, নিষ্ঠাবান করো।
অন্তরে নিয়ত শিখার মতো আলো–
বিবেকরূপে, বিচারবুদ্ধিরূপে।
আমার প্রার্থনা খাঁটি করো, খাঁটি করো, খাঁটি করো।
{ প্রার্থনা : প্রভাতির্ক।}
মোতাহের হোসেনের মানসলোকে প্রমথ চৌধুরীর প্রভাব সুস্পষ্ট এবং এ কারণেই হয়তো তাঁর মতোই রোমান্টিক কাব্য রচনার চাইতে সনেট রচনাতেই তিনি মুক্তি খুঁজেছেন বেশি।
দীন আমি, দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়া বেড়াই।
আনন্দ-কণিকা মাগি। কোথা নাহি পাই।
সে পরম ধনটুকু; তাই নিশিদিন
প্রাণ মোর বহে শুষ্ক মধু ছন্দোহীন!
হৃদয় মরুভূ মাঝে ফোটেনাকো ফুল।
হাসে না মধুর হাসি, করে না আকুল
নীরস জীবন মম। রহি ম্রিয়মাণ।
পরাণে বাজিয়া উঠে বিষাদের গান।
কাঙাল পরাণ মোর সকলের কাছে।
প্রাণ দাও, প্রেম দাও–এই ভিক্ষা যাচে।
{ চতুর্দশপদী। }
শুধু সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি ছিলেন স্ত্র, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, নিরহঙ্কার ও রসজ্ঞ। তিনি ছিলেন অজাতশত্রু। আবুল ফজল লিখেছেন : “তার কথা ও ব্যবহারে রুক্ষতা, কঠোরতা ছিল না, তাকে কোনোদিন ধৈর্য হারাতে দেখা যায় নি। তাঁর স্বভাব ও ব্যবহারে বিনম্র মাধুর্য ও আলাপ আলোচনায় সরস পরিহাসপ্রিয়তা শেষদিন পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। ছাত্রদের সঙ্গেও ব্যবহারের ব্যতিক্রম ঘটে নি কোনোদিন।” মোতাহের হোসেন চৌধুরীকে আবুল ফজল যৌবনে পেয়েছিলেন মুসলিম সাহিত্য সমাজের বুদ্ধির মুক্তির দলে এবং পরে পেয়েছিলেন অধ্যাপনা জীবনে চট্টগ্রাম কলেজে সহকর্মী হিসেবে। সুতরাং তার চোখে মোতাহেরের ব্যক্তিগত জীবনের এই পরিচয় নিঃসন্দেহে নির্ভরযোগ্য।
মোতাহের হোসেন চৌধুরী আমাদের সাহিত্যে সেইসব অল্পসংখ্যক ব্যক্তিদের অন্যতম যারা আপন চিন্তা ও আদর্শকে স্বার্থ বা নিজের প্রয়োজনের জন্যে বিসর্জন দেননি। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা হয়তো অতি-প্রগতিশীল নয় এবং হয়তো এটা স্বাভাবিকও; কেননা তার সমস্ত চিন্তা বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ব্যক্তি। সমষ্টিগত কল্যাণ চেতনা বা শ্রেণীহীন সমাজগঠন তার লক্ষ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। হয়তো এ কারণেই তিনি অতি-প্রগতিবাদী নন বা কোনো বিশেষ আদর্শকেই একমাত্র আদর্শ হিসাবে ধরে নেন নি। তার প্রধান আদর্শ মানবিকতাবাদ। এসব কারণে সমকালীন রাজনৈতিক উত্থান-পতন বা আলোড়নসমূহ তাঁর রচনায় অনুপস্থিত। এমনকি আঁদ্রে মারোয়ার মতো সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদকে ব্যক্তি বিকাশের অন্তরায় বলেও সমালোচনা করেছেন তিনি। অন্যদিকে, একই সঙ্গে এবং প্রায় একই কারণে, তিনি ধর্মান্ধতা ও শাস্ত্রানুগত্যকে সমালোচনা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন : “শাস্ত্রানুগত্য নয়, আত্মপ্রত্যয় ও আত্মোপলব্ধিই পৃথিবীকে সাম্য-মৈত্রীর পুণমন্দিরে পরিণত করতে পারে সুন্দর পৃথিবীকে সুন্দরতম করবার এ-ই সহজতম পন্থা। বিংশ শতকের মানবতাবাদী শিল্পী রমা রোলার কণ্ঠে একদা শোনা গিয়েছিল–
“Broaden yourself or perish. Embrace all new and free forces of the world you are suffocating in your old shells, which are glorious but fossilised. Break them down. Breathe and let us breath”.
মোতাহের চৌধুরীর কণ্ঠেও এ ধ্বনিটিই সুকুমার ভাষায় ধ্বনিত হয়েছে।
—-শফিউল আলম