ঊনবিংশ শতাব্দীর সামন্ততান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা এবং বিংশ শতাব্দীর উদার মানবিকতাবাদের জয়ধ্বনি–এই দুই দিগন্ত সমানভাবে তাঁর রচনার ওপর আলোক ছড়িয়েছে। রাসেল স্বকীয় উদারতায় ও মানবিকতাবাদে যেমন একদিকে মানবসমাজের অন্যতম প্রতিভূ, অন্যদিকে ঠিক তেমনি ব্যক্তিচিন্তার দ্বন্দ্বে প্রায়শ জর্জরিত, দীর্ণ এবং হতাশাগ্রস্ত। একটা বিরাট আত্মদ্বন্দ্বের ছায়া লক্ষ করা যায় তার সমগ্র জীবনে। ক্লাইভ বেলের (যিনি সভ্যতার আলোকে জীবনের মূল্যায়নের প্রয়াসী) রচনায়ও এক প্রচণ্ড আত্ম-অভিঘাত বর্তমান এবং প্রায়শ আত্মদ্বন্দ্বে নিক্ষিপ্ত তিনি। যেহেতু এঁরা দুজনেই ঊনবিংশ শতাব্দীর চেতনার পটভূমিতে এবং বিংশ শতাব্দীর মানবিক মূল্যবোধে লালিত, সুতরাং এদের চৈতন্যে এই সংঘাত স্বাভাবিক। তাছাড়া মহৎ শিল্পীমাত্রেই তো আজীবন এই অবধারিত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের শিকার। মোতাহের হোসেন যেহেতু এদের দুজনেরই ভাবশিষ্য, তাঁর রচনায় তাই বেল ও রাসেলের কণ্ঠ অনুচ্চ নয়।
শুধু জীবনধারণ করাটাই বাঁচা নয়। বাঁচাটাও একটা শিল্পিত জীবনধারা। জীবনের সৌন্দর্য, রসপিপাসা ও অর্থময় ভাবজগৎকে স্বকীয় জগতে জারিত করে নেয়ার মধ্যেই জীবনের মহত্তম সার্থকতা ও গভীরতম তাৎপর্য। প্রয়োজন দিয়েই শুধু মানুষ বাঁচাকে পরিপূর্ণতায় উত্তীর্ণ করতে পারে না, প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক বাচ্যাতিরিক্ত অব্যক্ত আনন্দময়তার সন্ধান মানুষকে করতে হয়। তাঁর মতে : আমরা জীবনে বাঁচার উপায়কেই বড় করে দেখি; জীবন আমাদের কাছে তাই অর্থ উপার্জনের একটা নিমিত্ত মাত্র। জীবনকে আমরা সর্বদা বেড়া-দেয়া শস্যক্ষেতের মতো সযত্নে লালিত করবার ব্যর্থ চেষ্টা করি। আর সেই অতি-যত্ন এবং অতি-সাবধানতার ফলেই আমাদের জীবন অর্থহীন হয়ে পড়ে। আমরা জীবনে কৃতকার্যতা লাভ করি না বলে আমাদের হতাশা ও দুঃখের শেষ নেই। মোতাহের হোসেনের ভাষায়-”জীবনের উদ্দেশ্য জীবন উপভোগ; কৃতকার্যত নয়, কৃতকার্যতা একটা উপায় মাত্র।তিনি আরো বলেন, “বাঁচার উপায়কে যখন বড় করে তুলি জীবন তখনই হয় দরিদ্র, বাঁচার উদ্দেশ্যকে বড় করে তুললেই জীবন ঐশ্বর্যশালী হয়ে ওঠে।
তাঁর কাছে জীবন যেহেতু এক সুন্দর আনন্দলোকের সঙ্গে মিশ্রিত, তাই তা কখনো অসংস্কৃত ও অপরিচ্ছন্ন নয়। তিনি তাই বারংবার তথাকথিত ধার্মিক হওয়ার চাইতে সংস্কৃতিবান হওয়ার প্রার্থনা করেছেন। এবং যা জীবনপ্রদ, তাকেই সুখের উৎস মনে করেছেন : “যা জীবন-দায়ী তাই সুখ-দায়ী। কালচারের উদ্দেশ্য তাই সুখ সাধনা।” আর কালচার তার দৃষ্টিতে তথাকথিত কোনো সংঘবদ্ধ জীবনাচরণ নয়, বরং “কালচার মানে উন্নততর জীবন সম্বন্ধে চেতনা–সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে অবহিতি।” এবং “সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত কালচারের উদ্দেশ্য নয়, উপায়। উদ্দেশ্য নিজের ভেতরে একটা ঈশ্বর বা আল্লা সৃষ্টি করা। যে তা করতে পেরেছে সেই কালচার্ড অভিধা পেতে পারে, অপরে নয়।”
তাঁর জীবনচেতনা বরাবরই এককেন্দ্রিক এবং নিজস্ব বলয়ে ঘূর্ণিত এবং সে বলয়ে শুধু সুন্দর আর আনন্দের, কল্যাণ আর প্রেমেরই ধ্বনি। তাই সংস্কৃতি বলতে তিনি মনে করেন- “সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে, মহত্তাবে বাঁচা, প্রকৃতি-সংসার ও মানব সংসারের মধ্যে অসংখ্য অনুভূতির শিকড় চালিয়ে দিয়ে বিচিত্র রস টেনে নিয়ে বাঁচা …. নদীর হাওয়ায়, চাঁদের চাওয়ায় বাঁচা আকাশের নীলিমায় তৃণগুলোর শ্যামলিমায় বাঁচা, বিরহীর নয়নজলে মহতের জীবনদানে বাঁচা…। বাঁচা, বাঁচা, বাঁচা। প্রচুরভাবে, গভীরভাবে বাঁচা। বিশ্বের বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা।” মনে হয় মোতাহের হোসেনই বাংলা সাহিত্যের প্রথম কণ্ঠ যিনি জীবনকে, বাঁচাকে এবং শিল্পিতভাবে বাঁচাকে সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মনে করেছেন।
মোতাহের হোসেনের চেতনায় সংস্কৃতি চিন্তা ছাড়া অন্য যেসব বিষয় আলোড়ন ও আন্দোলন এনেছে তা হল তার সভ্যতা সম্পর্কিত চিন্তা এবং জীবনের চত্বরে মূল্যবোধ ও যুক্তি-বিচারের প্রতিষ্ঠা। সভ্যতা তার দৃষ্টিতে “আলোক ও মাধুর্যের সাধনা।” তাঁর সভ্যতাবিষয়ক চিন্তায় ক্লাইভ বেল প্রধান অনুপ্রেরণা। তার সভ্যতা’ গ্রন্থটি তিনি অনুবাদও করেছেন। তবে সেটাকে শুধুমাত্র অনুবাদকর্ম বললে ভুল হবে। মূল সৃষ্টির মতোই এই রচনাটি তার আপন বক্তব্যে পূর্ণতর। বইটির রচনা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘অহং আশ্রিত মোহ থেকে মুক্তি পেয়ে মানুষ সহজভাবে সংস্কৃতি ও সভ্যতার পানে তাকাতে সক্ষম হবে, এই ভরসাতেই আমি বেল সাহেবের অনুসরণে এই বইখানি লেখার প্রেরণা অনুভব করি।” তিনি তাই সর্বদা ইতর সুখের চেয়ে সূক্ষ্ম সুখকে বড় করে দেখেছেন এবং সূক্ষ্ম রসানুভূতি ও প্রেমবোধকেই সভ্যতার মাপকাঠি বলে গ্রহণ করেছেন।
মোতাহের হোসেন চৌধুরী আজীবন জন-কোলাহলের বাইরে নিয়োজিত ছিলেন, আপন হৃদয়লোকের সৌন্দর্যে সৃষ্টির এক কল্পিত সুখলোকের স্বপ্নসাধনায়। এর ফলে যথেষ্ট প্রতিভার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও জীবদ্দশায় তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালেই ছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধরাজি স্বকীয় ঐশ্বর্য নিয়ে অলক্ষ্যেই প্রায় ঝরে গেছে, কখনো কখনো সৌন্দর্যসন্ধানী প্রেমিকদের হাতে এলেও এবং তার সুবাস বিভিন্নজনের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও তা নিয়ে পাঠকসমাজে ব্যাপক কৌতূহল কখনো দেখা যায় নি। তার সংস্কৃতি কথা” গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পরে। গ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে, অনেকটা আকস্মিকভাবেই আমাদের সাহিত্যের পদপাতবিরল অঙ্গনে এক নতুন ও অনাবিষ্কৃত ঐশ্বর্যের সন্ধান পেয়ে যান সুধীসমাজ। সনিষ্ঠ, পরিচ্ছন্ন ও সংস্কৃতিবান একজন লেখক যেন আবিষ্কৃত হন আমাদের সাহিত্যে। তার চিন্তার বহুমুখী ধারা এ গ্রন্থেও লক্ষ্যযোগ্য সংস্কৃতি, জাতীয়তা, সাম্প্রদায়িকতা, মূল্যবোধ, মনুষ্যত্ব, রিনেসাঁস, দুঃখবাদ এবংবিধ বহুবিষয় আলোচ্য হয়েছে এই গ্রন্থে। তবে তার সমস্ত লেখা ও চিন্তার বিশ্লেষণ করে মোটামুটি এ উপসংহারে আসা যায়–’কোনো গোঁড়ামি নয়, একদেশদর্শিতা নয়, তীব্রতা ও প্রচণ্ডতা নয়, এক সুচারু ও ভারসাম্যময় মধ্যপথ তার অবলম্বন—এটা অবশ্য ভীরুর গন্তব্য নয়, বরং শক্তি ও সুন্দরের, সাহস ও রুচির সই অবস্থান।” তাঁর সম্পর্কে এ মন্তব্য যথার্থ : “তিনি অমিতাচারের বিরোধী, আবেগবান তিনি, কিন্তু আবেগ উত্তাল নন; যুক্তি বিশ্বাসী কিন্তু হৃদয়কে উপেক্ষা করে নয়; তিনি বক্তব্যে দৃঢ় কিন্তু গোঁড়া নন, কৌতুক ভালোবাসেন কিন্তু ব্যঙ্গপ্রবণ নন। এই ব্যক্তিত্ব বিরল।”