সে জানে না যে সে আত্মহত্যা করিয়াছে–তাহার পিতামাতাও না, বন্ধু বান্ধবও জানে না। যেসব ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি আত্ম-আত্মা করিয়া অস্থির, তাহারাও না। আত্মসম্মানের প্রতি আমাদের নজর নাই, বাহিরের সম্মান পাইলেই ব্যস। সম্মানের জন্য আত্মাকে বিক্রি করিতেও আমরা প্রস্তুত। তবু আমরা ধার্মিক। ধর্ম ব্যাপারে পান হইতে চুন খসিলে অস্থির হইয়া পড়ি। হায় রে, ধর্মের খাঁচাটি লইয়া আমরা সানন্দে নৃত্য করিতেছি, পাখিটি কবে উড়িয়া গিয়াছে, সেদিকে কাহারো লক্ষ্যই নাই।
০. ভূমিকা : শফিউল আলম
মোতাহের হোসেন চৌধুরীর নির্বাচিত প্রবন্ধ
সংকলন : আবুল কাসেম ফজলুল হক
ভূমিকা : শফিউল আলম
ভূমিকা
তিনি এক বিরলপ্রজ লেখক লোকচক্ষুর অন্তরালে, লজ্জাতুর; অথচ প্রবল ব্যক্তিত্বশালী, মিতবাক অথচ এক অপার্থিব সুন্দর ও সত্যের সাধনায় নিমগ্ন; খ্যাতির অভিলাষ তাঁর নেই; বিনয়ী, সজ্জন এবং সম্ভ্রান্ত মনের অধিকারসম্পন্ন হৃদয়বান পুরুষ তিনি, তিনি মোতাহের হোসেন চৌধুরী। সাতচল্লিশোত্তর ক্রান্তিকালে আমাদের সাহিত্যের আদর্শ, আঙ্গিক ও কলাগত ভাবনায় যখন আমাদের সংস্কৃতিক্ষেত্র চঞ্চল, বিবিধ বৈরী মতবাদ ও মতভেদের প্রচণ্ড ঝড়ে আন্দোলিত, তখনো এই নেহাত অধ্যাপক মানুষটি নীরবে আপন সাহিত্যকর্মে নিমগ্ন ছিলেন, মতবাদ ও মতভেদের বিভিন্ন ঝাঘাত থেকে বহু দূরে। এবং সেজন্যই সম্ভবত কোনো দলীয় নামাবলি, মতবাদ বা ইজম’ তার লেখাকে আক্রান্ত করে নি, বরং সর্বপ্রকারের মতাদর্শকে অশ্রদ্ধা না করেও তার নিজস্ব ভুবনে, স্বকীয় শিল্পলোকে পরমহংসের মতো সন্তরণ করেছেন, আপন সৌরলোকে ঘুরেছেন, তার বিশ্বাস ও চেতনালোক থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হন নি। তাঁর দৃঢ় প্রত্যয়ে ও প্রগাঢ় প্রজ্ঞায় তার বক্তব্যের বুনন দৃঢ় এবং সুসংবদ্ধ ছিল।
বস্তুতপক্ষে মীর মশাররফ হোসেনের গদ্যে যে ঐতিহ্যের প্রথম ও শক্তিশালী উন্মোচন, নজরুল ইসলামের গদ্য তাঁর পরিণত অগ্রগতিরই স্মারকবাহী। মীরের গদ্যের যে ভারী, ঋজু ক্লাসিকধর্মিতা বা নজরুলের গদ্যের যে প্রাণবন্যা–এর কোনোটারই প্রত্যক্ষ উত্তরসূরি মোতাহের নন। তাঁর গদ্যে তাদের থেকে একটা ভাগত এবং আঙ্গিকগত দূরত্ব সহজেই লক্ষণীয়। মীর মশাররফ যে সমাজগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, নজরুল ইসলামও সে সমাজেরই ছায়ায় লালিত। নজরুল যে-যুগের ধ্বজাবাহী, সে যুগ ক্রান্তি ও পরিবর্তনের এবং এ পরিবর্তনের অন্তরঙ্গ হাওয়ায় তাঁর গদ্য ও পদ্যাবলি উন্মীলিত। কিন্তু, যেহেতু প্রত্যেক সাহিত্যকর্ম ও শিল্পকর্ম যুগেরই প্রতিভাস, যন্ত্রণা আত্মদহনে রঞ্জিত, আনন্দ ও বেদনার স্মারক, সেজন্য নজরুলের রচনা চঞ্চল ও ঊর্মিমুখর না হয়ে পারে নি; যেহেতু সাতচল্লিশ-পূর্ব সময় স্বাভাবিক কারণেই ছিল উচ্ছ্বাস ও উদ্বেলতার যুগ, অস্থিরতার পদধ্বনি দিকে দিকে।
নজরুল যখন চারণের বেশে দিকে দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন; নতুন কথায়, প্রাণের বন্যায় ভরিয়ে দিচ্ছেন সারাদেশকে; নবীন চেতনার দ্বারা সনাতনপন্থীদের মনে ও হৃদয়ে ভয় ও আতঙ্কের সৃষ্টি করছেন ঠিক সে সময়ে মুসলমান সমাজের একটি স্থিতধী তরুণ দল, বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলনে স্থির-প্রতিজ্ঞ হয়ে, অভীষ্ট পথে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। মুসলমান সমাজের কুসংস্কার, অন্ধতা, বুদ্ধিহীনতা, কূপমণ্ডুকতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদের উজ্জ্বল সূচিপত্র ছিল তাঁদের হাতে। অন্ধকারকে দূর করবার প্রদীপ্ত শিখা ছিল তাঁদের হাতে। আর তারা তাদের সম্মিলিত সংঘের নামকরণ করেছিলেন মুসলিম সাহিত্য সমাজ।
“শিখা ছিল তাঁদেরই অন্তরের বহ্নিশিখার মুখপত্র। তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য “চিন্তাচর্চা ও জ্ঞানের সমন্বয় ও সংযোগসাধন।” সংকীর্ণতা নয়, মূল্যবোধ ও যুক্তির বিচারে সবকিছুকে নিরিখ করাই এঁদের মুখ্য উদ্দেশ্য। তরুণ অধ্যাপক আবুল হোসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহের হোসেন, আবুল ফজল, আনোয়ারুল কাদির এ আন্দোলনের প্রথম পথিকৃৎ হলেও এঁদেরই চিন্তাধারার মূলস্রোত ছিল মোতাহের হোসেন চৌধুরীর শোণিতে। এবং সত্যিকার অর্থে তিনিই ছিলেন “খুব সম্ভব বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের শেষ ফসল।” বুদ্ধির মুক্তি যারা চেয়েছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন উঠতি উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, এবং অনেকে পেশাগত কারণে বা বৃত্তিগত প্রেরণায় লেখাকে একটা অন্তর্গত দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। আধুনিক জীবন ও জগতের পরিবর্তন ও নবমূল্যবোধের চৈতন্য তাদের নতুন করে ভাববার প্রেরণা যুগিয়েছিল। ঢাকা থেকে প্রকাশিত মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র ‘শিখা’ ও প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্র’ মোতাহের হোসেনকে যুগপৎ আকর্ষণ করেছিল। প্রকৃতপক্ষে বাইরের দিক থেকে শিখায়। সমাজসচেতনতা প্রবলভাবে উচ্চারিত হলেও আন্তরিক ভুবনে তার মধ্যে ছিল ব্যক্তির জড়তা উন্মোচনের আগ্রহ এবং এদেশের তরুণ মুসলমান সম্প্রদায়কে আত্মসম্মানবোধে জাগ্রত ও উদ্দীপিত করে তোলবার ঐকান্তিকতা। অপরপক্ষে সবুজপত্রের আদর্শ ছিল সতেজ ও জাগ্রত মননের উদ্বোধন ঘটানো। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর মানসভূমি এ দুটি কেন্দ্র থেকেই সমানভাবে প্রেরণা পেয়েছিল। কোনো প্রকারের ভাবাবেগ বা উচ্ছ্বাসপ্রবণতা, এজন্যেই তাঁর রচনায় দুর্লভ। বরং সবসময় এক বুদ্ধিনিষ্ঠ বিবেচক হৃদয়বান সংযমী শিল্পীর দৃষ্টি দেখা যায় তার প্রতিটি রচনায়। একদিকে কাজী আবদুল ওদুদ অন্যদিকে প্রমথ চৌধুরী দুজনেই তাঁর হৃদয়ের কাছাকাছি। যুক্তি বিচার ও মূল্যবোধ তার সমস্ত চিন্তার স্রোতকে এক সুনির্দিষ্ট গ্রথিত গন্তব্যের দিকে নিয়ে গেছে; সে কারণেই তার প্রবন্ধে বক্তব্য যেখানে সোচ্চার হয়েছে আপন নিজস্বতায়, যুক্তির ভারসাম্যেও সেখানে তা হয়েছে ঋদ্ধ। আনন্দ, সুন্দর, প্রেমবোধ, কল্যাণবোধ তাঁর রচনার ও চিন্তার আকর। মোতাহের হোসেন যে যুগ ও পরিবেশের সন্তান তা প্রধানত ছিল নব্যচিন্তায় উদ্দীপ্ত মুসলমান যুবকদের ব্যক্তিত্ব-বিকাশের যুগ। মোতাহেরের রচনায় এ কারণেই নতুন ব্যক্তিবাদ, একক সৌন্দর্যবিশ্বাস ও আনন্দচর্চার ধ্বনি শোনা যায় অবিরামভাবে। তার সাহিত্যচর্চার পটভূমিতে যদিও রয়েছে এক সুসংস্কৃত ব্যক্তিমানস, তথাপি সাহিত্যচর্চাকে তিনি বুদ্ধির মুক্তির অন্য প্রবক্তাদের মতো কোনো মন্ত্র বা হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেন নি। সাহিত্যচর্চা তার কাছে ছিল গভীর শ্রদ্ধায় ভরা পবিত্রতায় পূর্ণ নৈবেদ্যের মতো। তিনি বলেন : “লেখা আমার কাছে একপ্রকারের প্রার্থনা আর প্রার্থনার উদ্দেশ্য আত্মার ঔজ্জ্বল্য সাধন, অর্থ উপার্জন নয়। শুধু তাই নয়, এমন এক নির্মল ও পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী তিনি ছিলেন যে, সাহিত্যচর্চায় কোনোপ্রকার প্রতিযোগিতা করাকে তিনি পাপ বলে মনে করতেন। সবকিছুর উর্ধ্বে তিনি চেয়েছেন একজন সংস্কৃতিবান, যুক্তিনিষ্ঠ, প্রেমময় ও সভ্য মানুষ হতে। তার এ চিন্তার জগতে আরো দুজন মনীষী তাঁকে প্রভাবান্বিত করেছেন। এবং প্রকৃতপক্ষে “বহু বিভিন্ন দিগন্ত থেকে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ওপর আলো এসে পড়েছিল; যদিও শেষপর্যন্ত যে-কোনো সৎ লেখকের মতোই তাঁর নিজস্ব কিছু ছিল, যার জন্য তাঁকে চেনা যায়। তার ওপরে যেমন দেশজ কোনো কোনো ব্যক্তির প্রভাব দেখি, তেমনি তিনি কোনো কোনো মহৎ বৈদেশিকের অংশভাগী।” এ বৈদেশিক দুজন হলেন বিংশ শতাব্দীর মানবতাবাদী দার্শনিক বার্টান্ড রাসেল ও চিন্তাবিদ ক্লাইভ বেল। “ক্লাইভ বেল এবং বার্ট্রান্ড রাসেল মেঘের মতোন ছায়া ফেলে আছেন তাঁর ভাবনার আকাশে।” ক্লাইভ বেল বা রাসেল যে যুগ-সমাজের প্রতিনিধি, মোতাহের হোসেন চৌধুরীর যুগ ও সমাজ তা থেকে ভিন্ন হলেও চিন্তার জগতে তিনি ছিলেন তাঁদের সঙ্গে একাত্ম। তাঁদের মতোই মানবতার শুভবুদ্ধি ও নিরঞ্জন সুন্দরের সাধনা তারও কাম্য এবং তাঁর সমস্ত সাহিত্যকর্মে এর পরিচয় বিস্তৃত।