বলা হইয়াছে, অন্তরের সহজ প্রবৃত্তি নষ্ট হওয়ার দরুন সাধক ক্ৰমে তিক্ত ও বিরক্ত হইয়া ওঠে। তিক্ততা ধীরে ধীরে নৃশংসতায় পরিণত হয়, আর সেই নৃশংসতাকে সে কখনো সাহস, কখনো নৈতিকতার ছদ্মবেশ পরাইয়া চালাইতে থাকে। ক্রমে প্রতিযোগিতার ইচ্ছা বলবতী হয়, অর্থাৎ নিজের সুখ-সৃষ্টির চাইতে পরের দুঃখ-সৃষ্টির স্পৃহা প্রবল হইয়া দেখা দেয়। নিজের ভিতরের কাজ করিবার প্রেরণা স্তব্ধ হইয়া আসে, অন্যকে জব্দ করিবার জন্যই তাহাকে সবকিছু করিতে হয়। জীবনের বিকাশের আর আনন্দ পায় না বলিয়া যে-কোনো ক্ষেত্রে যে কোনো উপায়ে সার্থকতা লাভকেই সে বড় করিয়া দেখিতে শুরু করে। সার্থকতা লাভের জন্য সে এত ব্যস্ত হইয়া ওঠে যে, আত্মার বৈশিষ্ট্য নষ্ট করিয়া নিতান্ত সাধারণ হইয়া পড়িতেও তাহার কুণ্ঠাবোধ হয় না। এইরূপে success-এর bitch goddess-এর আরাধনা চিত্তের সৌকুমার্য নষ্ট করিয়া তাহাকে একেবারে অনুভূতিহীন পশুতে পরিণত করে।
সাধকের জীবন কীভাবে লোভ ও প্রতিযোগিতার বশবর্তী হইয়া নষ্ট হইয়া যায়, তাহার একটা কাল্পনিক চিত্র অঙ্কন করা যাক। ধরা যাক, ‘ক’ নামক একটি লোক সহজ প্রেরণার বশবর্তী হইয়া শিল্পচর্চাকেই তাহার সাধনার বিষয় করিয়া তুলিল। (এখানে বলা দরকার, প্রত্যেক সাধককেই সহজ প্রেরণার বশবর্তী হইয়া চলিতে হয়। নইলে তাহার পথচলা সহজ ও আনন্দদায়ক হয় না।) শিল্পে কী করিয়া নতুনত্ব সৃষ্টি করা যায়, সেই দিকেই তাহার ঝোঁক। একলা ঘরে বসিয়া অথচ বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হইয়া তাহার দিন কাটে বেশ। জীবিকা অর্জনের চাইতে জীবনার্জনের দিকেই তাহার নজর বেশি। সে অনুভব করে তাহার চিত্তে স্পর্শমণির মতো এমন এক দুর্লভ বস্তু আছে যাহার স্পর্শে সামান্য ধূলিবালিও সোনা হইয়া ওঠে, নিতান্ত সাধারণ জিনিসও অসাধারণত্ব লাভ করে। সেই স্পর্শমণির স্পর্শ লাভ করিবার জন্য কীট-পতঙ্গ, তৃণলতা সমস্ত কিছু লইয়া বিশ্ব-সংসার তাহার মনের দুয়ারে অতিথি। আনন্দের অফুরন্ত ভাণ্ডার বলিয়া সে তাহার আত্মার প্রতি সতত শ্রদ্ধাশীল। কস্তুরী-মৃগের মতো সে আপনার গন্ধে আপনি পাগল। কিন্তু তাহার এই তন্ময়তার অবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হয় না। তাহার বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন তাহার শিল্পচর্চায় খুশি না থাকিয়া তাহাকে বাস্তবজগতে উন্নতি করিবার জন্য উপদেশ দিতে থাকে। তাহার মা তাহার বাল্যবন্ধু খ-র নজির দেখাইয়া তাহাকে বড়লোক হইতে বলে।’খ’ নাকি পাটের ব্যবসায় করিয়া অজস্র টাকা করিয়াছে; আর এক প্রাসাদতুল্য বাড়ি নির্মাণ করিয়াছে। প্রথম প্রথম তাহাদের কথায় তাহার মন বিরক্ত হইয়া ওঠে, মনে হয়, তাহাকে আত্মহত্যা করিবার জন্য উপদেশ দেওয়া হইতেছে।
কিন্তু ক্রমে সন্দেহ শয়তান তাহার হৃদয় জুড়িয়া বসিয়া তাহার ভিতরের দেবতার সঙ্গে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়। সন্দেহ ঠোঁট বাঁকাইয়া বলিতে থাকে–ফেলে রাখো তোমার শিল্পচর্চা। ওসব দিয়ে কী হয়? পারো তো খ-র মতো একখানা অট্টালিকা নির্মাণ করো, আর লোকের আভূমি-প্রণত সেলাম গ্রহণ করো। দেবতা তিরস্কারের সুরে বলে : ছি ছি এ কী তোমার মতিগতি? শেষে কাঞ্চন ফেলে কাঁচ গ্রহণ করিতে প্রস্তুত হইলে? আত্মার বিকাশেই তোমার তৃপ্তি; কেন ওসব বাইরের আবর্জনার প্রতি নজর দাও? পরিণামে বহু যুঝাযুঝির পর দেবতা পরাজয় লাভ করে। সন্দেহ জয়ী হইয়া তাহাকে বাস্তক-জগতে উন্নতি-সংগ্রামে প্রবৃত্ত করে। ক্রমে প্রতিযোগিতার স্পৃহা জাগে এবং তাহার আনুষঙ্গিক পাপও অন্তর-রাজ্য দখল করিয়া বসে। সে আত্মহত্যা করে। শিল্পচর্চা ছাড়িয়া দিয়া সে ছবির ব্যবসায় শুরু করে এবং অল্প কয়েক বছরের মধ্যে তাহাতে প্রচুর অর্থ উপার্জন করিয়া ‘খ’কে জব্দ করিবার জন্য এক বিরাট অট্টালিকা নির্মাণ করে। চারিদিকে তাহার জয়জয়কার পড়িয়া যায়। তাহার উন্নতি ও সম্মান দেখিয়া তাহার মা তাহাকে স্নেহ-আশীর্বাদ জানায়, পিতা যোগ্য পুত্র বলিয়া অভিনন্দন করে, আর শুভানুধ্যায়ী বন্ধু-বান্ধব, এতদিনে সে মিথ্যা কল্পনা পরিহার করিয়া নিরেট খাঁটি মানুষ হইয়াছে বলিয়া করমর্দন করে।
কিন্তু পূর্বেকার প্রশান্তি আর তাহার নাই। একলা ঘরে বসিয়া থাকিতে এখন আর তাহার ভালো লাগে না। মনে হয়, কী যেন হারাইয়া গিয়াছে কিসের বিরহে যেন মন উতলা হইয়া উঠে, চোখ বাম্পায়মান হইয়া আসে। ব্যথা ভুলিতে সে বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে হুল্লোড় করিয়া বেড়ায় পাগলের মতো ছুটাছুটি করিয়া সময় কাটায়। তবু আনন্দ করায়ত্ত হয় না।’খ, ‘খ, ‘খ’ ‘খ’-র ভূতে তাহাকে পাইয়াছে, ‘খ ছাড়া দুনিয়াতে সে এখন আর কাহাকেও দেখিতে পায় না। তাহার নিজের অস্তিত্বের চাইতেও খ-র অস্তিত্ব তাহার কাছে এখন সত্যতর। আনন্দ তাহার নিকট হইতে চিরবিদায় গ্রহণ করিয়াছে। সমস্ত পৃথিবী টুড়িয়াও সে একবিন্দু আনন্দ লাভ করিতে পারে না। যাহা তাহার জন্য আকাশ আলোর মতো অজস্র ছিল, যাহা নিজে উপভোগ করিয়া অন্যকে বিলাইয়াও উদ্বৃত্ত থাকিত, তাহা এমন দুর্লভ হইল কী করিয়া, শত চিন্তা করিয়াও সে তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারে না। শুধু মনে হয়, কী যেন পৃথিবী হইতে পলাইয়া গিয়াছে, কী যেন নাই। যে সন্ধ্যাতারা প্রতি সন্ধ্যায় তাহার জন্য আনন্দবার্তা বহন করিয়া আনিত, তাহা যেন এখন বিদ্রূপবার্তা নিয়া আসে। তাহার মুখে হাসি নাই, আছে ব্যঙ্গ।