God be thanked, the meanest of His creatures
Boasts two soul-sides, one to face the world with,
One to show a woman when he loves her.
এর থেকেই বুঝতে পারা যায়, ব্রাউনিঙের মতে জগতের প্রতি একমাত্র যুক্তিসঙ্গত মনোবৃত্তি হচ্ছে দ্বন্দ্বপরায়ণতার। যে মন নিয়ে প্রিয়ার সঙ্গে মেশা যায়, সে মন নিয়ে সাধারণের সঙ্গে মিশতে গেলে ভুল করা হবে।
সাধারণের সঙ্গে সম্বন্ধ দ্বন্দ্বের, মিলনের নয়। এর কারণ কী? ব্রাউনি বলবেন : জগৎ নিষ্ঠুর বলে। আমরা বলব না, জগৎ আপনাকে আপনার নির্ধারিত মূল্যে গ্রহণ করতে চায় না বলে। আপনি চান আপনার অবিমিশ্র প্রশংসা। জগৎ তা দিতে নারাজ। সে আপনাকে বাজিয়ে নিতে চায়। তাই আপনি এমন একটি সঙ্গিনী বেছে নিতে চান যিনি কেবল আপনার প্রশংসাই করবেন, আপনার ত্রুটির দিকে তাকাবেন না। এই সমালোচনাহীন প্রেম কিন্তু খুব প্রশংসনীয় ব্যাপার নয়। অপক্ষপাত সমালোচনার শীতল বাতাস সইতে পারা স্বাস্থ্যের লক্ষণ। যার সে। ক্ষমতা নেই সে দুর্বল, রুগণ। তার কাছ থেকে জগৎ তেমন কিছু আশা করতে পারে না।
আমি নিজে প্রেমে বিশ্বাসী। অবশ্য আমার প্রেম ভিক্টোরীয় যুগের প্রেমের মতো অন্ধ নয়, মুক্তদৃষ্টি। এ কেবল সঙ্গী বা সঙ্গিনীর ভালোর দিকেই তাকায় না, মন্দ দিকেও তাকায়। ভিক্টোরীয় যুগের লোকের মতো আমি প্রেমকে পূত পবিত্র মনে করে আকাশে তুলে রাখতে চাইনে। এই অতিরিক্ত শ্রদ্ধার মূলে রয়েছে ‘সেক্স-টেবু’ বা যৌন-নিষেধ। যৌন ব্যাপারকে খারাপ ভাবা হত বলেই সেকালের লোকেরা তাদের সমর্ধিত যৌন সম্বন্ধকে পূত পবিত্র প্রভৃতি বিশ্লেষণে বিশেষিত করে উচ্চাসন দিতে চাইত। নইলে সেকালে যৌনক্ষুধা যে একালের চেয়ে কম ছিল তা নয়। অধুনা মানুষ নূতন আদর্শ ভালোরূপে গ্রহণ করতে পারেনি বলে পুরোনো আদর্শের প্রভাব থেকে পুরাপুরি মুক্তি পাচ্ছে না। তাই মনোজগতে একটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। এই দ্বন্দ্বের ফলে নৈরাশ্য ও হতাশার জন্ম। আমার মনে হয়, এধরনের লোকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। কিন্তু সংখ্যায় কম হলেও গলাবাজিতে তারাই বড়। তাদের প্রচারের ফলে এ-যুগের কালো দিকটাই লোকের কাছে বড় হয়ে উঠেছে, আলোর দিকটা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। তারা যত মন্দ বলে প্রচার করতে চায়, আসলে কিন্তু যুগটা তত মন্দ নয়। এই যুগের সঙ্গতিসম্পন্ন তরুণরা যে প্রেমের ব্যাপারে অধিকতর সুখী, এ-কথা একরকম জোর দিয়েই বলা যায়। প্রাচীন আদর্শের অত্যাচার এবং যুক্তিধর্মী নীতির অভাবের দরুনই লোকেরা নৈরাশ্যব্যঞ্জক মনোবৃত্তির পরিচয় দিয়ে থাকে। অতীতের মোহ ভুলে গিয়ে হালের আদর্শকে পুরোপুরি গ্রহণ না করলে এই নৈরাশ্যের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন।
কেন যে প্রেমের মূল্য দেওয়া হয়, তা বলা সহজ নয়। তথাপি একবার চেষ্টা করে দেখছি। প্রথমত দেখতে পাওয়া যায়, প্রেম নিজেই একটা সুখের উৎস। সুখের তাগিদেই লোকেরা প্রেমের হাতে ধরা দেয়। এটাকে প্রেমের শ্রেষ্ঠ দিক হিসাবে ধরা না গেলেও প্রাথমিক ও অনিবার্য দিকরূপে সহজেই ধরে নেওয়া যায়। এটির অভাবে অপরাপর দিকগুলিরও ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা।
তোমার চেয়ে মিষ্টি কিছুই নেই।
এই ভুবনের মাঝে,
ওগো ও প্রেম, তাইতো তোমায় চাই
নিত্য সকাল সাঁঝে।
নিন্দা তোমার রটায় যারা, জানি,
পায়নি তোমার মধুর পরশখানি,
অন্ধকারে কাটায় তারা বেলা
হিংসা-দ্বেষের কাজে।
তোমার পরশ অন্তরেতে মোর
রাতের শেষে আনে সোনার ভোর
দিকে দিকে তাই যে কেবল শুনি
আনন্দ-গান বাজে।
কবি যখন এই পঙক্তিগুলি লেখেন তখন তিনি আল্লাহর জায়গায় প্রেমকে বসিয়ে নাস্তিক্যের সমাধান করতে চাননি, কিংবা বিষরহস্য উদ্ঘাটন করাও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন নিজেকে খুশি করতে, নিজেকে উপভোগ করতে, এইমাত্র। প্রেমের উপস্থিতি যেমন সুখের, অনুপস্থিতিও তেমনি দুঃখের। তাই প্রেমের জন্যে মানুষ এত উতলা হয়ে ওঠে। প্রেমের দ্বিতীয় গুণ হচ্ছে, তা জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখগুলির স্বাদ বাড়িয়ে দেয়। সঙ্গীত, পর্বতের ওপরে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত, পূর্ণিমা রাত্রে জোছনা-প্লাবিত সমুদ্র বক্ষ–প্রেমের সংস্পর্শ না হলে এসবের পুরো স্বাদ পাওয়া যায় না। প্রেয়সী নারীর সঙ্গ উপভোগ না করলে এসবের ইন্দ্রজাল অর্ধেকটাই অনুদঘাটিত থেকে যায়। তৃতীয়ত, ‘আমি’র চেয়ে ‘তুমিকে বড় করে তুলে’ প্রেম অহমিকার কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পথটি বাৎলে দেয়। একাকিত্বপ্রিয় দার্শনিক-যে সংসারে নেই, তা নয়। যথেষ্টই আছে। সৃটোইক ও প্রাথমিক যুগের খ্রিস্টানরা তো মনে করতেন জীবনের কল্যাণসাধনের জন্য দরকার কেবল ইচ্ছাশক্তির–সেজন্যে অপরের সহায়তার কোনো দরকার হয় না। সকলের লক্ষ্যই যে কল্যাণ তা নয়। কেউ কেউ চায় শক্তিকে, কারো লক্ষ্য বা ব্যক্তিগত সুখ। কিন্তু সকলের মধ্যেই একটা সাধ দেখতে পাওয়া যায়, আর তা হচ্ছে, অপরের সাহায্য ছাড়া নিজের ইচ্ছাশক্তির দ্বারাই কাজ ফতে করা যায়, এই বিশ্বাস। এই একাকিত্বপ্রিয় দর্শন-যে কেবল নীতির দিক দিয়ে মন্দ, তা নয়; জীবনের সহজ ও সার্থক বিকাশের পক্ষেও তা অন্তরায়। মানুষের জন্য পারস্পরিক সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজনীয়। জোর করে একা থাকতে হলে স্বভাবের বিরুদ্ধে যেতে হয়। মানুষের প্রকৃতিতে যে অসম্পূর্ণতা রয়েছে, তা-ই তাকে বন্ধু ও সহযোগী খুঁজতে বাধ্য করে। প্রেমের স্বাদ যে পেয়েছে সে কখনও একাকিত্ব-দর্শনের সমর্থক হতে পারে না। সন্তান বাৎসল্যের মতো এমন জোরালো অনুভূতি আর কি আছে? এরও গোড়ায় রয়েছে কিন্তু জনক-জননীর পরস্পরের প্রতি প্রেম। প্রেম একটা সাধারণ ব্যাপার-যত্রতত্রই তার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, এমন কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু এই বলতে চাই যে, প্রেমের স্বাদ যে পায়নি, জীবন তার কাছে তার শ্রেষ্ঠ ঐশ্বর্য উদঘাটিত করেনি। সে হতভাগা জীবনকে পেয়েও জীবন থেকে বঞ্চিত। প্রেম এমন একটা ব্যাপার, সন্দেহবাদের স্পর্শে যা মলিন হয়ে যায় না। তা চিরসুন্দর চিরপ্রাণপ্রদায়ী।