তারপর? তারপর লোকসমাজে আমার বেশ কদর বাড়িয়া গেল। যাহারা তোমার নিকট আসিতে সাহস করে না; তাহারা তোমার কাছে সুপারিশ করিবার জন্য আমাকে ধরিতে লাগিল। আমিও সুযোগ ও সুবিধা বুঝিয়া তাহাদের তোষামোদ ও স্তুতিতে স্ফীত হইতে লাগিলাম। ক্রমে ক্রমে খোদার মর্জিতে ও লোকের কৃপায় পকেটও ভারী হইতে লাগিল। তারপর একটু চাল খাটাইয়া সামান্য তোষামোদকারীর পদ হইতে একেবারে তোমার মন্ত্রিত্বের পদে উন্নীত হইলাম। বাস, আর আমাকে পায় কে? এখন তুমি আর আমি প্রায় সমান। তুমি আরো উপরের পদে উন্নীত হইলে আমিও তোমার পরিত্যক্তপদে উঠিয়া আসিলাম। এতদিন তোমাকে ও তোমার মতো অন্যান্য বড়লোককে নতজানু হইয়া সেলাম ঠুকিতে ঠুকিতে কোমর বাকিয়া গিয়াছিল, এখন অন্যের কোমর বাকাইতে লাগিলাম। নইলে তোমাদেরই যে প্রিয়-শিষ্য তাহা প্রমাণ করিব কী করিয়া তোষামোদল উন্নতি ও সম্মানের এই সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
কিন্তু তোষামোদের শুধু এই রূপ নয়, অন্য রূপও আছে। জনপ্রিয় হইবার জন্য প্রচলিত ও সামাজিক মতবাদের সমর্থন, কবি ও সাহিত্যিক হইবার জন্য বড় লেখকের অনুভূতি ও ভাব চুরি করিয়া রচনা লিখিবার চেষ্টা ইত্যাদি একপ্রকার তোষামোদ। অত্যন্ত সূক্ষ্ম বলিয়া সূক্ষ্মদর্শী ব্যতীত অন্য কেহ তাহা উপলব্ধি করিতে পারে না। আধুনিকদের মধ্যেই এই পাপ অত্যন্ত বেশি। কারণ আধুনিকরাই একটা কিছু হইতে চায়, কিন্তু হইবার যথার্থ সাধনা করে। তাহারা লেখে, কিন্তু কবিতার অনুভূতির প্রতি সত্যিকার কোনো দরদ রাখে না। মত প্রচার করে কিন্তু মতবাদের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল হয় না। মত তাহাদের গায়ের কোট, গায়ের চামড়া নয়। সুবিধানুযায়ী পরে আবার খুলিয়া রাখে। ভণ্ডামি ও চালিয়াতিতে ইহাদের জীবন ক্লিন্ন। বেশ বুদ্ধিলিপ্ত হইয়া জীবনযাপন করিলেও ভিতরে ভিতরে এদের আত্মা মরিয়া আসে, অন্তরের সত্যোপলব্ধি নষ্ট হইয়া যায়। কবি ও সাহিত্যিকের স্বাভাবিক আত্মমর্যাদা জ্ঞান হইতে বঞ্চিত বলিয়া ইহারা অত্যন্ত সুবিধাবাদী হইয়া পড়ে। বড়লোকের কেদারায় বসিতে পারিলে তাহারা নিজেকে সরফরাজ মনে করে, এক রাত্রি ইষ্টক নির্মিত গৃহে ঘুমাইতে পারিলে নিজের জীবন ধন্য মনে না করিয়া পারে না। ইহারা অশ্লীল ও কদর্য। দেখা তো দূরের কথা, ইহাদের নাম শুনিলেও চিত্তের শান্তি নষ্ট হইয়া যায়।
.
০৫.
আসলে বিচারপূর্ণভাবে দেখিতে গেলে, তোষামোদ ও চালিয়াতির দ্বারা উন্নতি লাভ করা যায় না। তাহাতে উন্নীত হওয়া যায়, কিন্তু উন্নত হওয়া যায় না। উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে যে চারিত্রিক ও মানসিক পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী, চালিয়াত ও তোষামোদকারীদের জীবনে তাহা অনুপস্থিত। সে যে-কেসে অবস্থাতেই থাকিয়া যায়। শুধু বাহিরের পোশাকি পরিবর্তন ঘটে মাত্র। সে পদকে মর্যাদা দান করে না, পদ তাহাকে মর্যাদা দান করে। তাহার পদে তাহাকে কেমন যেন মানায় না–গম্ভীর হইলে মনে হয় অতিরিক্ত গম্ভীর হইয়া পড়িয়াছে। যেন ধরা পড়িবার ভয়ে সতত অতিরিক্ত সাবধান।
উন্নতির একমাত্র পন্থা সাধনা। সাধনা ব্যতীত জীবনে লাবণ্য ফোটে না। উন্নীত না হইলেও তাহাতে লাভ। যতটুকু সাধনা করিলাম ততটুকু অগ্রসর হইলাম, ততটুকু চরিত্রের বিকাশ সাধন হইল। বাস্ তাহাতেই তৃপ্তি তাহাতেই আনন্দ। ভিতরে ভিতরে আমি বাড়িলাম, integrated হইলাম, ইহার চাইতে বড় কথা আর কী হইতে পারে? কিন্তু গভীর না হইলে তাহা উপলব্ধি করা যায় না, সূক্ষ্মদর্শী না হইলে তাহা প্রত্যক্ষ করা অসম্ভব। কারণ তাহা বাহিরের বস্তু নয়, তাহা চরিত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশিয়া আছে।
সাধককে ভবিষ্যতের ভাবনা ভুলিয়া, লাভ-লোকসানের মায়া কাটাইয়া কেবল সৃষ্টির আনন্দে কাজ করিতে হয়। সাধনাকে বড় না করিয়া সিদ্ধিকে বড় করিয়া দেখিলে সাধকের চলার শক্তি মন্দীভূত হইয়া আসে, তাহার ভিতরের তেজ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। আর তাড়াতাড়ি লক্ষ্যে পৌঁছিতে গিয়া সে মাঝে মাঝে মারাত্মক ভুল করিয়া বসে। লক্ষ্যে সে পৌঁছে আর উন্নতিও সে লাভ করে বটে, তবে তাহাই তাহার চিন্তাভাবনার একমাত্র কারণ হইয়া ওঠে না, হইলে সাধনার গতি স্তব্ধ হইয়া যায়চিত্ত অস্থির হইয়া পড়ে। মনে হয়, সাধক মাত্রই ক্ষণবাদী। ক্ষণগুলির যথার্থ ব্যবহারই তাহাদের একমাত্র কাজ। তবে লক্ষ্যের প্রতি একটুখানি দৃষ্টি না রাখিলে সাধনার ধারা এলোমেলো হইতে পারে বলিয়া তাহার প্রতি মাঝে মাঝে একটু দৃষ্টি রাখা সাধকের পক্ষে প্রয়োজন হইয়া পড়ে।
সঞ্চয়শীলতা সাধকের ধর্ম নহে। সঞ্চয়ের জালে বন্দী হইলে সাধনায় অগ্রসর হওয়া অসম্ভব হইয়া পড়ে। শুধু বাহিরের বস্তুই নয়, তাহার সৃষ্টির চাইতে সে নিজেই বড় বলিয়া তাহাকে নিজের সৃষ্ট বস্তুর মায়া কাটাইয়াও চলিতে হয়।
সাধকের মর্মবাণী :
হায়রে হৃদয়–তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু
পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
প্রান্তের চাইতে অপ্রান্তই তাহাকে বেশি করিয়া টানে। তাহার সাধনা আত্মা বধূর নব নব রূপ দেখিবার সাধনা। সঞ্চয়ের প্রতি লোভ থাকিলে উদার ও সুন্দর জীবনযাপন করা মুশকিল হইয়া ওঠে–চিত্তের প্রশান্তি নষ্ট হইয়া যায় বলিয়া বিক্ষিপ্ততা অরাজকতার মূর্তি নিয়া দেখা দেয়। রাসেলের উক্তিই এ-সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলিয়াছেন :