.
০৩.
সম্মান আর আত্মসম্মানে আকাশ-পাতাল প্রভেদ। উভয় ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গিমার পার্থক্য বিস্তর। আত্মসম্মানীর দৃষ্টি অন্তর্মুখী; আর সম্মানীর দৃষ্টি বহির্মুখী। আত্মসম্মানীর সম্মান সে নিজে ছাড়া অন্য কেহ নষ্ট করিতে পারে না। সম্মানীর সম্মান অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তনশীল–সামান্য ধুলা লাগিলেও তাহা নষ্ট হইয়া যায়। আজ তুমি লক্ষ টাকার মালিক বলিয়া যে সম্মানের অধিকারী, কাল লক্ষ টাকা ফুরাইয়া গেলে আর সে সম্মান থাকিবে না, তুমি নিতান্ত অসহায় ও কৃপার পাত্র হইয়া পড়িবে। তাই কখন কী হয় মনে করিয়া তোমাকে সতত ভীত ও ত্রস্ত থাকিতে হয়। আত্মসম্মান কিন্তু এই ভীতি ও ত্রস্ত হইতে মুক্ত ভয়ার্ততার পাপ হইতে সে রক্ষা পাইয়াছে।
সম্মানীকে লোক বুঝিয়া কথা বলিতে হয়, সময় বুঝিয়া বাহির হইতে হয়, স্থান বুঝিয়া পদার্পণ করিতে হয়, আর স্বার্থ বুঝিয়া ভাব করিতে হয়। নইলে তাহার সম্মান বজায় রাখা ভার হইয়া ওঠে। সে মুক্ত নয়, সে বন্দী–সতত সন্দেহ দোলায় দোদুল্যমান বলিয়া তাহার চিত্তের স্থৈর্য নাই।
আত্মসম্মানী কিন্তু এইসব বালাই হইতে মুক্ত। সে নিজের ভিতরে এমন এক শ্রেষ্ঠ সম্পদের সাক্ষাৎ পাইয়াছে, যাহার মৃত্যু নাই–যাহা অজর, অমর, অক্ষয়, যাহা আগুনে পোড়ে না, জলে বিনষ্ট হয় না, দুর্যোগে ভাঙিয়া পড়ে না; শত শত বিপদপাতের মধ্য দিয়া গিয়াও যাহা ধ্বংস না হইয়া উজ্জ্বল হইয়া ওঠে। এই পরম বস্তুটি লাভ করিয়াছে বলিয়াই সে সর্বত্র স্বচ্ছন্দগতি, সদানন্দচিত্ত–তাহাকে ভীরুর মতো আগপাছ ভাবিয়া গণিয়া গণিয়া পা ফেলিয়া চলিতে হয় না। সে ভাবনামুক্ত।
সম্মানীর ভয়ের কারণ এইখানে যে, সে জানে সে ফাঁকি দিয়া বড় হইয়াছে, এবং সেহেতু যে-কোনো সময়ে যে কোনো অজুহাতে সেই বড়ত্ব হইতে বঞ্চিত হওয়া তাহার পক্ষে অসম্ভব নয়। সেইজন্যই সে ভীরুর মতো সন্দেহপ্রবণ ও স্বল্পপ্রাণ বলিয়াই নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী। সে মনে করে সমস্ত জগৎ তাহার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সুতরাং সকলকে টুটি টিপিয়া না মারিলে তাহার পক্ষে তিষ্ঠানো মুশকিল। তাহার অনেক কাজই সাহসের বলিয়া ভ্রম হয়, কিন্তু আসলে তাহা সাহসের ভান, দুর্বলচিত্তের ছটফটানি ছাড়া আর কিছুই নয়। নিজের অযোগ্যতা ঢাকিবার জন্য সে পারিপার্শ্বিক জগতকে সন্ত্রস্ত করিয়া রাখিতে চায়। যতই সে সাবধান হয় ততই তাহাকে বিসদৃশ ঠেকে–ততই তাহার ভিতরের কদর্যতা বাহির হইয়া পড়ে। অযোগ্য ভূঁইফোড়ের আগমনে এইজন্য যুদ্ধ ও পারিবারিক কলহ অবশ্যম্ভাবী হইয়া ওঠে।
আত্মনিষ্ঠার শ্রেষ্ঠতা এইখানে যে, আত্মনিষ্ঠাই আমাদের বহু পাপ ও অন্যায় হইতে রক্ষা করিতে পারে–বাইরের নীতি অথবা তথাকথিত সংযমের আদর্শ নয়। প্রবৃত্তির প্রাবল্যের কাছে বাইরের নীতি তো তৃণবৎ তুচ্ছ, আর আত্মনিষ্ঠা ব্যতীত সংযম-সাধনার চেষ্টা বালুকার উপর অট্টালিকা নির্মাণের মতোই নিরর্থক। আত্মনিষ্ঠা মানুষকে সৌভাগ্যে প্রমত্ত দুর্ভাগ্যে অস্থির ও বিপদে অধীর হইতে দেয় না। কারণ আত্মাই শ্রেষ্ঠ, তাহা হইতে বড় কিছুই হইতে পারে না, এই উপলব্ধির মধ্যে একটা বড় রকমের আশ্রয় লাভ করিয়া সে গভীরত্ব লাভ করে। আত্মনিষ্ঠা নাই বলিয়াই তোষামোদকারী বিশ্রী ও প্রগম্ভ। তাহার মাথা ও হাত প্রতাপশালীর পায়ে। আর পা দুর্বলের ঘাড়ে। নিজের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা না থাকার দরুন সে অপরের আত্মাকেও অপমান করিতে দ্বিধাবোধ করে না। থাকিলে লজ্জায় অধোবদন হইত।
.
০৪.
সাধকের প্রিয় হইতেছে আত্মসম্মান নিজের আত্মার প্রতি নিজের অপরিসীম শ্রদ্ধা। আর তোষামোদকারীর প্রিয় সম্মান। প্রথমটি ভিতর হইতে লাভ করিতে হয়, আর দ্বিতীয়টি বাহির হইতে। সাধক সৃজনধর্মী আর তোষামোদকারী সঞ্চয়ধর্মী (possessive)। তোষামোদকারী কী করিয়া সম্মান লাভ করে, তাহার একটা কাল্পনিক চিত্র অঙ্কন করা যাক।
সম্মান নির্ভর করিতেছে সার্থকতার উপর। সার্থক না হইলে যত বড় কাজেই হাত দাও না কেন, সম্মান নাই। কবিতা লিখিতেছ? ক্ষতি কী? রবীন্দ্রনাথ না হইলে আমরা কেয়ার করিব না।– ছবি আঁকিতেছ? বেশ তো। অবনীন্দ্রনাথ না হইলে আমরা ফিরিয়াও তাকাইব না। বিজ্ঞানচর্চা করিতেছ? ভালো কথা। জগদীশ বসু না হইয়া আসিলে তোমার স্থান নাই।–তাহার চাইতে যাহারা সঁতারে প্রথম হইল, ফুটবল খেলায় কেল্লাফতে করিল, অথবা ঘোড়দৌড়ে ঘোড়া ছুটাইয়া সকলের আগে আসিল, তাহাদিগকেই আমরা বরমাল্য প্রদান করিব। কোন্ বিষয়ে কী হইল, অথবা কীভাবে হইল, তাহা দেখিতে চাহিব না। দেখিব শুধু প্রথম হইল কিনা। তাহা হইলেই আমাদের বাস্। আমরা ‘ফিলিস্টাইন’; আমাদের কাছে মুড়ি-মুড়কির একদর।
সার্থকতা লাভের সহজ উপায় তোষামোদ ও চালিয়াতি। উভয়ে মাসতুতো ভাই–সর্বদা একসঙ্গে হাত ধরাধরি করিয়া চলে। একটিকে ছাড়া অন্যটি অথর্ব হইয়া পড়ে। সুতরাং উভয়কেই একসঙ্গে গ্রহণ করিতে হয়। নইলে সার্থকতা সহজলভ্য হয় না। সাধনার দ্বারাও সার্থকতা লাভ করা যায়। কিন্তু সাধনার পথ দুরূহ বলিয়া তোষামোদ ও চালিয়াতিকেই একান্তভাবে গ্রহণ করিতে হয়।
তুমি বড় হইয়াছ ও উচ্চপদবি লাভ করিয়াছ। তোমার দরবারে আসা-যাওয়া শুরু করিলাম। তোমার মনটি জয় করিতে তোমার শত্রু রহিমের বিরুদ্ধে অযথা নানা কথা বলিতে লাগিলাম, মাঝে মাঝে কারণে-অকারণে বোকার মতো তোমার প্রশংসা করিতে লাগিলাম, আর বোকার মতো তুমিও তাহা বিশ্বাস করিয়া খুশি হইতে লাগিলে। ফলে তোমার মনের কোণে আমার জন্য একটি স্থান রচিত হইল। আমি ধীরে ধীরে তোমার প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিলাম।