শিথিল বাধনের অন্তরায় বলেই সংস্কৃতিকামীরা উগ্র জাতীয়তাকে এত ভয় করে। সব দেশে তাদের যে-ঘরটি রয়েছে, সেই ঘরটি তারা খুঁজে নিতে চায়। সকল দেশের, সকল জাতির, সকল কালের লোকই তাদের আত্মীয়। তারা বিশ্বনাগরিক অনাত্মীয়তা, মানুষকে আপন না-জানা, ধর্ম বা মতবাদের বিভিন্নতার জন্য মানুষকে পর ভাবা সংস্কৃতির মনঃপূত নয়। কেননা, সংস্কৃতি মানেই অহমিকামুক্তি। অহমিকার গুমটভরা অন্ধকারে সংস্কৃতিকামীর বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। অহঙ্কার পতনের মূল কি না তা সে বলতে পারে না, কিন্তু তা যে আনন্দের অন্তরায় সে সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ সচেতন। অহঙ্কারী হওয়ার মানে নিজের চারদিকে বেড়া দিয়ে মানুষকে পর করা, আর মানুষকে পর করা মানে আনন্দকে পর করা। মানুষে-মানুষে মিলনেই আনন্দের জন্ম, বিরোধে নয়। বিরোধ আনন্দের শত্রু।
সংস্কৃতিসাধনা মানে ripe হওয়ার সাধনা। সেজন্য জ্ঞানের প্রয়োজন আছে, বিজ্ঞানের প্রয়োজন আছে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রেমের। সংস্কৃতিবান হওয়ার মানে প্রেমবান হওয়া। প্রেমের তাগিদে বিচিত্র জীবনধারায় যে স্নাত হয়নি সে তো অসংস্কৃত। তার গায়ে প্রাকৃত জীবনের কটুগন্ধ লেগে রয়েছে, তা অসহ্য!’সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থ নীরে স্নাত না হলে সংস্কৃতিবান হওয়া যায় না।
সম্মান ও আত্মসম্মান
০১.
পৃথিবীতে উন্নতি করিবার পথ দুইটি একটি আত্মশক্তি, আরেকটি চালিয়াতি। চালিয়াতিও একপ্রকার শক্তি বটে, তবে তাহা ধীরে ধীরে আত্মাকে ক্ষুদ্র ও নির্বীর্য করিয়া চারিত্রিক অধোগতি সাধন করে বলিয়া সর্বদা নিন্দনীয় ও পরিত্যাজ্য।
যাহারা আত্মশক্তির সাধনা করে, তাহাদের বড় হইতে সময় লাগে, অথবা তাহাদের কেহ কেহ কোনো সময়ে বড় হইতেই পারে না। তবু তাহাদের জীবন সার্থক এইজন্য যে, তাহারা একটি বড় রকমের আদর্শ দিয়া পৃথিবীকে ঋণী করিয়া যায়। সার্থক হইলে তো কথাই নাই, না হইলেও সাধনার একটা মূল্য আছেই। ভিতরের দিক হইতে দেখিতে গেলে তাহা আত্মশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করিয়া মানুষকে সৃজনধর্মী করিয়া তুলে, আর বাহিরের দিক হইতে দেখিতে গেলে তাহা মানুষকে প্রাত্যহিক জীবনের গ্লানি ও নীচতা হইতে রক্ষা করে।
সার্থকতা সকল সময় সকলের ভাগ্যে ঘটে না। কারণ তাহা শুধু চেষ্টার উপর নির্ভর না করিয়া বিধাত-দত্ত শক্তির উপর নির্ভর করিতেছে। সে-শক্তির তারতম্য আছে। তাহার জন্য আমরা দায়ী নহি, দায়ী স্বয়ং বিধাতা। শক্তির অভাবের জন্য লজ্জাবোধ করিবার কিছুই। নাই। সাধনার অভাবেই আমাদের লজ্জা। আমি চেষ্টা করিলেই রবীন্দ্রনাথ হইতে পারি না। কারণ রবীন্দ্রনাথের শক্তিতে আর আমার শক্তিতে আকাশ-পাতাল প্রভেদ। কিন্তু সাধনায় তাহার সমকক্ষ হওয়া অসম্ভব নহে। না হইলে বিধাতার অপরাধ হইবে না, হইবে আমাদেরই।
একজন একশ টাকার মূলধন লইয়া কারবার শুরু করিল, আরেকজনের মূলধন মাত্র পঁচিশ টাকা। পঁচিশ টাকা মূলধনওয়ালার কাছে একশ টাকার মূলধনের লাভ প্রত্যাশা করা বাতুলতা; তবু সমীকরণ পদ্ধতির দ্বারা দেখা যাইতে পারে–উভয়ের মধ্যে লাভের সমতা আছে কি-না। না-থাকিলে বুঝিতে হইবে সাধনায় গলদ, উপযুক্ত চেষ্টা হয় নাই। অতএব, ফলের দিকে না তাকাইয়া আমাদের সর্বান্তঃকরণে চেষ্টা করিয়া যাওয়া উচিত। সফল হইলে তো ভালোই, না হইলে ঊর্ধ্বে অঙ্গুলিসঙ্কেত করিয়া অট্টহাস্য করিয়া বলিতে পারিব– আমার কী দোষ? আমার চেষ্টা তো আমি করিলাম। দোষ ঐ যাহাকে ধরিতে ছুঁইতে পাওয়া যায় না, সেই ব্যক্তির। কিন্তু সাধনা না করিয়া বিনাচেষ্টায় কিছুতেই নিজেকে অকৃতকার্যতার গ্লানি হইতে মুক্ত করিতে পারি না।
.
০২.
চালিয়াতির সহগামী তোষামোদ, তোষামোদ আত্মার পক্ষে ব্যভিচার। ভান ও অভিনয়ের উপর নির্ভরশীল বলিয়া তোষামোদ তলে তলে আত্মাকে কলুষিত করিয়া তোলে। শ্রদ্ধা না থাকিলেও কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য শ্রদ্ধার ভান করিতে করিতে চরিত্র কপট ও দুর্বল হইয়া পড়ে, এবং পরিণামে ভালো-মন্দ বিচার করিবার ক্ষমতাই নষ্ট হইয়া যায়। এই অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ, কারণ তখন বুঝিতেই পারা যায় না যে, নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করা হইতেছে।
তোষামোদকারী ও বারবণিতা প্রায় সমপর্যায়ভুক্ত। যৌন সম্বন্ধ নিজে ভালো কি মন্দ, কিছুই নয়। তাহার সঙ্গে মানসিকতার যোগেই তাহা ভালো কি মন্দ হইয়া থাকে। প্রেম ব্যতীত প্রেমের ভান যেখানে সেখানেই তাহা পাপ, অন্যত্র নহে। শ্রদ্ধা ও প্রেম আত্মরই প্রকাশ ইহা মানিয়া নিলে এ-কথা বলিতে পারা যায় যে, বারবণিতা ও তোষামোদকারী উভয়ে আত্মবমাননাকারী বলিয়াই পাপী, অন্য কারণে নহে।
অথচ বারবর্ণিত ও বারবণিতা সম্পর্কিত ব্যক্তিকে দেখিলে আমরা ঘৃণায় নাসিকা কুঞ্চিত করি, তোষামোদকারীকে দেখিলে ডাকিয়া আনিয়া শ্রেষ্ঠ আসন দিতেও কুণ্ঠা বোধ করি না। ইহা হইতেই বুঝা যায়, আমাদের পাপ-পুণ্যের ধারণা কত অগভীর। যুক্তিযুক্ততার উপর নির্ভরশীল না হইয়া তাহা একটি সংস্কারের উপর নির্ভর করিয়া আছে। যাহা পাপ মনে করিতেছি, তাহা কেন পাপ হইল একবারও ভাবিয়া দেখিতেছি না। দশজনে যখন মনে করিতেছে তখন আমিও মনে করিতেছি দশজনে মনে না করলে আমিও বিরত থাকিতাম–ইহাই আমাদের মনোভাব। এই মনোভাব হইতে মুক্তিলাভ না করিলে আত্মিক মৃত্যু অনিবার্য। যে শিক্ষায় তাহা সম্ভব হইবে, তাহার গোড়ার কথা হইবে আত্মনিষ্ঠা বা আত্মসম্মান, তথাকথিত সম্মান নয়। আর লক্ষ্য হইবে জীবনের বিকাশ, সফলতা নয়। সফলতা লাভ করিলে তো ভালোই, না করিলেও বিশেষ ক্ষতি নাই। সফলতার জন্য বিকাশকে বর্জন করা আর আত্মহত্যা করা সমান।