সাধারণ লোকের কাছে প্রগতি আর সভ্যতার কোনো পার্থক্য নেই। যা সভ্যতা তা-ই প্রগতি, অথবা যা প্রগতি তা-ই সভ্যতা। কিন্তু কাশ্চার্ড লোকেরা তা স্বীকার করে না। উভয়ের সূক্ষ্ম পার্থক্য সম্বন্ধে তারা সচেতন। প্রগতি তাদের কাছে মোটের উপর জ্ঞানের ব্যাপার। কেননা, জ্ঞানের ক্ষেত্রেই পরিবর্তনশীলতা অবধারিত, সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে নয়। তাই জ্ঞান, বিশেষ করে বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানপ্রসূত কল্যাণকেই তারা প্রগতি মনে করে। প্রকৃতিবিজয়লব্ধ সমৃদ্ধির সার্থক বিতরণই তাদের কাছে প্রগতি। কিন্তু সভ্যতা শুধু প্রগতি নয়, আরো কিছু। প্রগতির সঙ্গে সৌন্দর্যের সম্বন্ধ, প্রেমের সম্বন্ধ স্থাপিত না হলে সভ্যতা হয় না। আর সৌন্দর্য ও প্রেমের ব্যাপারটা তথা শিল্পের ব্যাপারটা–কেননা শিল্প, সৌন্দর্য ও প্রেমেরই অভিব্যক্তি–চিরন্তন ব্যাপার, প্রগতির ব্যাপার নয়। এ-সম্বন্ধে গির্ট মারের উক্তিটি উল্লেখযোগ্য : Doubtless there is in every art an element of knowledge or science, and that element is progressive. But there is another element, too, which does not depend on knowledge and which does not progress but has a kind of stationary and eternal value, like the beauty of the dawn, or the love of a mother for her child, or the joy of a young animal in being alive, or the courage of a martyr facing torment. We cannot, for all our progress, get beyond these things; there they stand, like light upon the mountains. The only question is whether we can rise to them. And it is the same with all the greatest births of imagination–চিরন্তনকে স্পর্শ করতে না পারলে সভ্যতা সৃষ্টি করা যায় না। কেননা, সভ্যতা ‘ভ্যালু’র ব্যাপার, আজ ‘নিউভ্যালু’ বলে কোনো চিজ নেই। জীবনে সোনা ফলাতে হলে প্রগতিকে চলতে হবে সভ্যতার দিকে মুখ করে, নইলে তার কাছ থেকে বড়কিছু পাওয়া যাবে না। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, আজকাল প্রগতি কথাটা যত্রতত্র শুনতে পাওয়া গেলেও সভ্যতা কথাটা একরকম নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। লোকেরা কেবল প্রগতি-প্রগতি করে, সভ্যতার নামটিও কেউ মুখে আনে না।
অনেকে সংস্কারমুক্তিকেই সংস্কৃতি মনে করে, উভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখতে পায় না। কিন্তু তা সত্য নয়। সংস্কারমুক্তি সংস্কৃতির একটি শর্ত মাত্র। তাও অনিবার্য শর্ত নয়। অনিবার্য শর্ত হচ্ছে মূল্যবোধ। সংস্কারমুক্তি ছাড়াও সংস্কৃতি হতে পারে, কিন্তু মূল্যবোধ ছাড়া সংস্কৃতি অসম্ভব। মূল্যবোধহীন সংস্কারমুক্তির চেয়ে কুসংস্কারও ভালো। শিণোদর-পরায়ণতার মতো মন্দ সংস্কার আর কী হতে পারে? অর্থগৃধুতাও তাই–কিন্তু এসব মূল্যবোধহীন সংস্কারমুক্তিরই ফল। তাই শুধু সংস্কারমুক্তির ওপরে আস্থা স্থাপন করে থাকা যায় না। আরো কিছু দরকার। কামের চেয়ে প্রেম বড়, ভোগের চেয়ে উপভোগ এ-সংস্কার না জন্মালে সংস্কৃতি হয় না। সূক্ষ্ম জীবনের প্রতি টান সংস্কৃতির জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু মূল্যবোধহীন সংস্কারমুক্তির টান সে-দিকে নয়, তা স্কুল জীবনেরই ভক্ত।
সংক্ষেপে সুন্দর করে, কবিতার মতো করে বলতে গেলে সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে, মহভাবে বাঁচা; প্রকৃতি-সংসার ও মানব-সংসারের মধ্যে অসংখ্য অনুভূতির শিকড় চালিয়ে দিয়ে বিচিত্র রস টেনে নিয়ে বাঁচা; কাব্যপাঠের মারফতে, ফুলের ফোঁটায়, নদীর ধাওয়ায়, চাঁদের চাওয়ায় বাঁচা; আকাশের নীলিমায়, তৃণগুল্মের শ্যামলিমায় বাঁচা, বিরহীর নয়নজলে, মহতের জীবনদানে বাঁচা; গল্পকাহিনীর মারফতে, নরনারীর বিচিত্র সুখ-দুঃখে বাঁচা; ভ্রমণকাহিনীর মারফতে, বিচিত্র দেশ ও বিচিত্র জাতির অন্তরঙ্গ সঙ্গী হয়ে বাঁচা; ইতিহাসের মারফতে মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশে বাঁচা; জীবনকাহিনীর মারফতে দুঃখীজনের দুঃখ নিবারণের অঙ্গীকারে বাঁচা। বাঁচা, বাঁচা, বঁচা। প্রচুরভাবে, গভীরভাবে বাঁচা। বিশ্বের বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা।
সংস্কৃতিবান মানুষ সমাজের কল্যাণ কামনা করে এবং সেজন্য প্রাণপাত করতেও প্রস্তুত থাকে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি চায় সে নিজের জীবনে সোনা ফলাতে। কেননা, সেখানে তার অবাধ অধিকার। তাই জগৎকে মেরামত করার চেয়ে নিজেকে শোধরানোর দিকেই তার অধিক কোঁক। তার সমুখ দিয়ে কে যেন সর্বদা গান গেয়ে যায় :
মন তুমি কৃষিকাজ জানো না,
এমন মানব-জনম রইল পতিত
আবাদ করলে ফলত সোনা।
জীবনে সোনা ফলাতে হলে যে-জিনিসটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় তা হচ্ছে সঙ্কীর্ণ ব্যক্তিত্ব মুক্ত হয়ে বিচিত্র জীবনধারণার সঙ্গে যোগযুক্ত হওয়া–নিজেকে বিশ্বের পানে মেলে ধরা, সঙ্কুচিত ও সঙ্কীর্ণ করে রাখা নয়। কবির যে প্রার্থনা–যুক্ত করহে সবার সঙ্গে, মুক্ত করহে বন্ধ–তাতে সংস্কৃতিকামনাই ব্যক্ত হয়েছে। সকলের সঙ্গে যুক্ত হওয়াতে মুক্তি সকলের থেকে আলাদা হয়ে, সঙ্কুচিত হয়ে, দূর্যের মতো আত্মগত হয়ে থাকা মুক্তি নয়–বন্ধন। জীবনে জীবন যোগ করা, নহিলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা, এই উক্তিটিও একই কামনার অভিব্যক্তি। পার্থক্য কেবল, ওখানে বাধনটা চাওয়া হয়েছে নিজের দিকে তাকিয়ে এবং নিজের জন্য, এখানে সকলের দিকে তাকিয়ে এবং সকলের জন্য। বাধন, বঁধন, বাঁধন। সকলের সঙ্গে বাঁধন পরাতেই সমৃদ্ধি, ‘ধরণীর পরে শিথিল বাঁধন ঝলমল প্রাণ করিস যাপন’–শিথিল বাঁধন না হলে ‘ঝলমল প্রাণ লাভ করা যায় না। আর ঝলমল প্রাণ লাভ করাই সংস্কৃতির উদ্দেশ্য।