আইডিয়ার গোঁড়ামি থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় নিজের বা নিজের দলের অভ্রান্ততা সম্বন্ধে একটুখানি সন্দেহ রাখা। এই সন্দেহটুকুই মানুষকে সুন্দর করে তোলে, আর সৌন্দর্যই সংস্কৃতির লক্ষ্য। স্কেপটিসিজমের প্রভাব না থাকলে যে সভ্যতা সৃষ্টি হতে পারে না, এতো একরকম অবিসংবাদিত সত্য। মনে রাখা দরকার, সংস্কৃতিবান হওয়ার কোনো ধরাবাধা পথ নেই, বিচিত্র পথ। কার জন্য কোন্ পথটি সার্থক কে বলবে? সেকালে বলা হত যত জীব, তত শিব; একালে বলা যেতে পারে যত সংস্কৃতিবান মানুষ তত সংস্কৃতি-পন্থা। যে-পথটি ধরে মানুষ কালচার্ড হয় তা অলক্ষ্য না হলেও দুর্লক্ষ্য। তা পরে আবিষ্কার করা যায়, আগে নয়। তাই সংস্কৃতিবান মানুষটি একটা অলাদা মানুষ, স্বতন্ত্র সত্তা। তার জীবনের একটি আলাদা স্বাদ, আলাদা ব্যঞ্জনা থাকে। সে মতবাদীর মতো বুলি আওড়ায় না, তার প্রতিকথায় আত্মা স্পন্দিত হয়ে ওঠে। প্রেমের ব্যাপারে, সৌন্দর্যের ব্যাপারে, এমনকি সাধারণত ধর্মীয় কল্যাণের ব্যাপারেও তার আত্মার ঝলকানি দেখতে পাওয়া যায়। নিজের পথটি নিজেই তৈরি করে নেয় বলে সে নিজেই নিজের নবী হয়ে দাঁড়ায়। তাই সে স্বাতন্ত্র্যধর্মী, গোলে হরিবোলের জগতে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। কল্যাণের ব্যাপারে সাম্যকে স্বীকার করলেও প্রেমের ব্যাপারে, সৌন্দর্যের ব্যাপারে, চিন্তার ব্যাপারে সে স্বাতন্ত্র্য তথা বৈচিত্রের পক্ষপাতী। সত্যকার সংস্কৃতিকামীরা নিজেদের ছাঁচে ঢালাই করতে চায় না। নকল যিশু, নকল বুদ্ধ, নকল মার্ক্স বা নকল লেনিন হওয়া তাদের মনঃপূত নয়। ক্ষুদ্র হলেও তারা খাঁটি কিছু হতে চায়!
কিন্তু পথের বিভিন্নতা থাকলেও তাদের লক্ষ্যের সাম্য রয়েছে–সকলেই অমৃত তথা আত্মাকে চায়। যিশুখ্রিস্ট যখন বলেন : For what is man profited if he shall gain the whole world, and lose his own soul?–তখন সংস্কৃতিকামীর অন্তরের কথাই বলেন। এই খ্রিস্টবাণীরই ঔপনিষদিক ভাবান্তর হচ্ছে ‘যেনাহং নামৃতা স্যাং কিমহং তেন কুর্যাম’–যা দিয়ে আমি অমৃত লাভ করব না তা দিয়ে আমি কী করব? অমৃতকে কামনা, তথা প্রেমকে কামনা, সৌন্দর্যকে কামনা, উচ্চতর জীবনকে কামনা, এই তো সংস্কৃতি। এইজন্য সংস্কৃতিকে একটা আলাদা ধর্ম, উচ্চস্তরের ধর্ম বলা হয়েছে। প্রাণিজীবনের ঊর্ধ্বে যে-জীবন রয়েছে তার সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দিয়ে, এবং তার দ্বারা প্রাণিজীবনকে খণ্ডিত করে দিয়ে, তা মানুষের অন্তরে মুক্তির স্বাদ নিয়ে আসে। তাই বলে প্রাণিজীবনের তথা ক্ষুৎপিপাসার মূল্য যে তা দেয় না তা নয়। খুবই দেয়। Man doesnot live by bread alone –এই কথাটার মধ্যেই ক্ষুৎপিপাসার স্বীকৃতি রয়েছে। তবে মর্যাদাভেদ আছে। যা নিয়ে বাঁচা যায়, আর যার জন্য বাঁচতে হয়, তা কখনো এক মর্যাদা পেতে পারে না। তাই সংস্কৃতিকামীদের ইচ্ছা : ক্ষুৎপিপাসার জগৎটি তৈরি করা হোক ক্ষুৎপিপাসার উর্ধ্বে যেজগৎটি রয়েছে তারই পানে লক্ষ্য রেখে। নইলে সংস্কৃতি ব্যাহত হবে। সংস্কৃতিকামীরা আরো কামনা করে : ক্ষুৎপিপাসার জগৎ তথা কল্যাণের জগৎ নির্মাণে লক্ষ্যের চেয়ে উপায়কে যেন কম বড় স্থান দেওয়া না হয়। কেননা, উপায়ই চরিত্রের স্রষ্টা, লক্ষ্য নয়। একবার একরকম চরিত্র সৃষ্টি হয়ে গেলে পরে তার থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন।
হিমালয়ের চুড়ায় চূড়ায় যে ধনধারা আবদ্ধ হয়ে আছে, ভগীরথের মতো সমতলভূমিতে নামিয়ে এনে তাকে সাধারণের ভোগের বস্তু করতে না পারলে জগতের মুক্তি নেই কথা স্বীকার করলেও, এই একটি সুরই সংস্কৃতিকামীদের জীবনে বেজে ওঠে না, সঙ্গে সঙ্গে বিচিত্ৰসুরের সমারোহ দেখা দেয়। একসুরা, একফেঁকা জীবন যে দীন জীবন, তা তারা জানে। বিভিন্ন, এমনকি বিপরীত সুরের চমকে সিমফনি সৃষ্টি করতে না পারলে তারা খুশি হয় না। তাদের জীবনবীণাটি একতারা নয়, বহুতারসমন্বিত। তাই একত্ববাদে তাদের এত আপত্তি। একত্ববাদী তথা মতবাদীরা অনেক সময় সূক্ষ্ম তারগুলিকে আমলই দিতে চায় না, অথচ প্রকৃত সংস্কৃতিকামীদের নজর সেদিকেই। মতবাদীর সবচেয়ে বড় ত্রুটি এই যে, একটি আদর্শের আলোকে সমস্ত কিছু দেখতে চায় বলে সে অবজেকটিভ তথা ময় হতে পারে না। অবজেকটিভ হতে হলে নিজেকে লুকোতে হয়। মতবাদী, নিজেকে, তথা নিজের মতটিকে লুকোতে পারে না বলে বিচিত্র ভাব ও অনুভূতির আগার মানুষের মর্মে গিয়ে পৌঁছতে পারে না। সে কেবল নিজের মতবাদটিকেই খোঁজে, বারে বারে ফিরে ফিরে তার সেই এক কথা। বিভিন্ন ব্যাপারকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে, এমনকি একটি ব্যাপারকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে না জানলে-যে জীবন দরিদ্র থেকে যায় তা সে বোঝে না। আদর্শের গোড়ামির দরুন সে বৈচিত্র্যবোধ তথা জীবনবোধ হারিয়ে বসে। তাই কান পাততে নয়, মুখ খুলতেই সে পটু। অথচ কান পাতাতেই সংস্কৃতি, মুখ খোলাতে নয়। কান পাতার ফলে যখন লোকের মনের বিচিত্র ভাব ও অনুভূতি এসে আপনার অন্তরকে অজ্ঞাতসারে ভরে তোলে, তখনই আপনি অভাবিতের দেখা পান। মুখ খুললে শুধু ‘ভাবিতে’র প্রকাশ। মতবাদী কান পাততে জানে না। বলে অন্তরের দিক দিয়ে মরে যায়, যদিও হইচই করে বলে ভাবে, সে-ই সবচেয়ে বেশি বেঁচে আছে। প্রবলভাবে বাঁচা বাঁচা নয়, মৃত্যু। প্রচুরভাবে, গভীরভাবে বাঁচাই বাঁচা-সংস্কৃতিকামীই এ-সত্য উপলব্ধি করতে পারে। মতবাদ ঝড়ের মতো এসে জীবনের সমস্ত মুকুল ঝরিয়ে দেয়। সংস্কৃতি ঠিক তার উল্টো, দখিন হাওয়ার মতো জীবনের সমস্ত ফুল ফুটিয়ে তোলাই তার কাজ। তখন কত রং, কত বৈচিত্র্য, কত সৌন্দর্য। একসুরা, একরঙা জীবন মতবাদীর সংস্কৃতিকামীর নয়। সংস্কৃতিসাধনা বহুভঙ্গিম জীবনের সাধনা। Let us agree to differ–’ভিন্নরুচিহি লোকঃ–এই উক্তিতে মতবাদীর আস্থা কম। অথচ সংস্কৃতিকামীর কাছে এরচেয়ে শ্রদ্ধেয় বাণী আর নেই।