কথায় কথায় হিন্দুর উন্নতি-অবনতির কথা এসে পড়ল। ভালোই হল, কথায় বলে নসিহতের চেয়ে নজির ভালো। আর এ নজিরে বিপদের সম্ভাবনা কম। কারণ, আর যে-কারণেই হোক ধর্মের সমালোচনায় হিন্দু, অন্তত বাঙালি হিন্দু, উদ্দণ্ড হয় না। ধর্ম ব্যাপারে পাশাপাশি বিভিন্ন মতবাদ চলার দরুন সে অনেকখানি ধর্মীয় সহিষ্ণুতা অর্জন করেছে।
ধার্মিক আর কাঁচাৰ্ড মানুষে আরেকটা লক্ষ্যযোগ্য পার্থক্য এই যে, ধার্মিকের চেয়ে কালচার্ড মানুষের বন্ধন অনেক বেশি। উল্টা কথার মতো শোনালেও, কথাটি সত্য। ধার্মিকের কয়েকটি মোটা বন্ধন, সংস্কৃতিবান মানুষের বন্ধনের অন্ত নেই। অসংখ্য সূক্ষ্মচিন্তার বাঁধনে যে বাধা সেই তো ফ্রি-থিংকার আর ফ্রি-থিংকিং কাল্ডারের দান। যেখানে ফ্রি-থিংকিং নেই। সেখানে কাঁচার নেই।
প্রশ্ন হবে : ধর্ম আর কালচারকে যেভাবে আলাদা করে দেখা হল তাতে মনে হচ্ছে নাকি ধার্মিক কখনো প্রকৃত অর্থে কালচার্ড হতে পারে না? কিন্তু কথাটি কি সত্য? ধার্মিকদের মধ্যেও তো অনেক কালচার্ড লোক দেখতে পাওয়া যায়। উত্তরে বলব : তা বটে, কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই টের পাওয়া যাবে, সেখানেও কালচারই কালচার্ড হওয়ার হেতু। অনুভূতি, কল্পনার সাধনা করেছেন বলেই তারা কালচার্ড, অন্য কারণে নয়।
একটা অভিজ্ঞতার সহায়তায় আমি কথাটা পরিষ্কার করবার চেষ্টা করছি। আমি মিলিটারি কন্ট্রাক্টারের খাতায় নাম লেখানোর দরুন পাদরি ওয়াটসন সাহেব যা বলেছিলেন তা এখানে মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন : কবিত্বের প্রবণতাসম্পন্ন মানুষের পক্ষে বস্ট্রাকটার, বিশেষ করে মিলিটারি কন্ট্রাকটার হওয়া অপরাধ, মহাঅপরাধ। নিজের প্রতিভাকে মরতে দেওয়া আর নিজের আত্মাকে মরতে দেওয়া এক কথা। তুমি নিজেকে মরতে দিতে পার, কিন্তু নিজের আত্মাকে মরতে দিতে পার না। যে-পেশা গ্রহণ করলে তোমার সূক্ষ্ম অনুভূতি ও সৌন্দর্যবোধ ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা, তুমি সে পেশা গ্রহণ করেছ শুনে আমি সত্যিই দুঃখিত। আমি চাই তুমি না-খেয়ে মরো তথাপি তোমার সূক্ষ্মানুভূতিকে বাঁচিয়ে রাখো, কেননা সূক্ষ্মানুভূতিরই অপর নাম আত্মা। তুমি বলবে তোমার সামান্য প্রতিভা, আর little genius is a great bondage –সামান্য প্রতিভা, কঠিন বন্ধন। কিন্তু সামান্য হলেও তা মূল্যবান। আর যা মূল্যবান তার যত্ন না নেওয়া মহাপাপ। বুঝলে? কথায় বলে, ভালো লোকদের ভাত নেই। তোমার ভাত না থাক, কিন্তু ভালোও বজায় থাক, এই আমার কামনা।
তখন মার্ক্সের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ হয়নি। তাই কথাটা শুনে খুশি হয়ে ঘরে ফিরে এলাম, কোনো তর্ক না করে। এখনো মাঝে মাঝে আমার সেই বোকামিকে আমি চুমু খাই। কেননা, আমি জানি খুশি হওয়ার জন্যে বোকা হওয়ার প্রয়োজন আছে। বাইবেলের ভাষাটা একটু বদলে দিয়ে বলা যায় : Blessed are the simple hearted for they shall he happy. * [* এর কিছুদিন পরে আমার এক ধার্মিক বন্ধুকে বললাম : দেখুন তো খ্রিস্টান পাদরিরা কী সুন্দর কথা বলেন, আমাদের মৌলবী সাহেবদের তো এমন সুন্দর কথা বলতে শোনা যায় না। উত্তরে বন্ধুটি বললেন : বোকা কোথাকার, ওদের পাদরিদের যে কালচার আছে। আমাদের মৌলবী সাহেবদের তা কোথায়? ব্যস, আমার বোকামির পুরস্কারটি হাতে হাতে পেয়ে গেলাম :কাঁচারই যে সৌন্দর্যের কারণ, অন্যকিছু নয়, তা প্রমাণিত হয়ে গেল।]
এখন এই যে মূল্যবোধ, এই যে সূক্ষ্ম অনুভূতি আর আত্মাকে এক করে দেখার প্রবৃত্তি একি ধর্মের দান, না কাল্ডারের কীর্তি? কই সচরাচর তো ধার্মিকের মুখে এধরনের সুন্দর কথা শুনতে পাওয়া যায় না। তার কাছে তো আল্লার হুকুম আর বেহেশত দোজখই বড় হয়ে ওঠে, সুক্ষ্ম অনুভূতির কথা নয়। সূক্ষ্ম অনুভূতি কালচারের দান। Human value সম্বন্ধে কাঁচারই মানুষকে সচেতন করে। তবে কাশ্চার্ড মানুষ ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করে কেন? উত্তর, আরামের জন্য। একটা বিশ্বাসের আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে সহজে জীবন যাপন করা যায় বলেই তিনি তা করেন। যে ধর্মকে তিনি আশ্রয়রূপে গ্রহণ করেন তাতে তিনি নিজেরই কালচার্ড মনের প্রতিবিম্ব দেখতে পান, এবং দেখতে পেয়ে ঘোষণা করে বেড়ান : দেখো, দেখো এখানে সব আছে, এখানে এসো; কাস্টার্ড মনের উপযোগী ধর্ম যদি কোথাও থেকে থাকে তবে তা এখানে, এখানে, এখানে ব্যাপারটা যে মোটের ওপর তাঁরি মনের প্রতিফলন, বাইরের তেমনি কিছু নয়, তা তিনি টের পান না। প্রেমিক যেমন নিগ্রো মেয়ের ভুরুতেও হেলেনীয় সৌন্দর্য দেখতে পেয়ে মুগ্ধ হয়ে থাকে, এখানেও তেমন একটা ব্যাপার ঘটে। তা তিনি মুগ্ধ হয়ে থাকুন কিন্তু তাঁর ‘সুন্দরী’কে অপরেও সুন্দর বলুক, এমনি একটা গোয়ার্তুমি যেন তাকে পেয়ে না বসে, এই আমাদের প্রার্থনা।
সংস্কৃতি মানে জীবনের values** [**** অনেকে বলেন হায়ার ভ্যালু, কিন্তু হায়ার ভ্যালু বলে কোনো কথা থাকা উচিত নয়। কেননা, ‘ভ্যালু জিনিসটা নিজেই একটা ‘হায়ার’ কিছু সুতরাং হায়ার কথাটা ফাজিল, অতিরিক্ত।] সম্বন্ধে ধারণা। ধর্মের মতো মতবাদ বা আদর্শও তা ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই সে সম্বন্ধে সাবধান হওয়ার দরকার। অতীতে ধর্ম ঈশ্বরকে আচ্ছন্ন করেছিল, বর্তমানে মতবাদ বা আদর্শ মনুষ্যত্বকে আচ্ছন্ন করতে পারে। লোকটা মোটের উপর ভালো কি মন্দ সেদিকে আমাদের নজর নেই, তার গায়ে কোন দলের মার্কা পড়েছে সেদিকেই আমাদের লক্ষ্য। মার্কাটি নিজের দলের হলে তার সাত খুন মাফ, না হলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার দোষ বের করা আমাদের স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। এই মনোবৃত্তি থেকে মুক্তি না পেলে কালচার্ড হওয়া যায় না। মনে রাখা দরকার, ধর্মের সমস্ত দোষ মতবাদের ঘাড়ে এসে চেপেছে। মতবাদী ধার্মিকের মতোই অসহিষ্ণু ও সঙ্কীর্ণ, ধার্মিকের মতোই দলবদ্ধতায় বিশ্বাসী, অধিকন্তু ধার্মিকের চেয়েও নিষ্ঠুর। ধার্মিকের নিষ্ঠুরতার সহায় ছিল ধর্মগ্রন্থের সমর্থন, মতবাদীর সহায় বিজ্ঞান। আমি আমার জন্য নিষ্ঠুর হচ্ছি না, পৃথিবী-উন্নয়নের বিজ্ঞানসম্মত আদর্শের জন্যই নিষ্ঠুর হচ্ছি। অতএব এখানে আমার গৌরব নিহিত, কলঙ্ক নয়। নিষ্ঠুরতাব্যাপারে এই যুক্তিই মতবাদীর আত্মসমর্থনের উপায়। সৌভাগ্যের বিষয় সত্যিকার সংস্কৃতিকামীরা কখনো মতবাদী হতে চায় না, মতবাদকে তারা যমের মতো ভয় করে। কেননা, তাদের কাজ বাইরের থেকে কোনো দর্শন গ্রহণ করা নয়, বহু বেদনায় নিজের ভিতর থেকে একটা জীবনদর্শনের জন্ম দেওয়া, এবং দিন দিন তাকে উন্নতির পথে চালনা করা।