বাইরের নীতির এই-যে অস্বাস্থ্যকর প্রাধান্য, এর প্রতিবাদ রয়েছে হিন্দুপুরাণে। সত্যিকার মনুষ্যত্বের অধিকারী বলে তথাকথিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীরা সেখানে প্রাতঃস্মরণীয় ও প্রাতঃস্মরণীয় বলে গৃহীত। কালচারের গোড়ার কথা যে মূল্যবোধ, তা পুরাণকারদের ছিল। তাই দেখতে পাওয়া যায় নীতিকে বড় করে না-দেখে তারা অন্তরাত্মার মহিমাকেই বড় করে দেখেছেন, আর যেখানেই তা দেখতে পেয়েছেন সেখানেই শ্রদ্ধায় অবনতশির হয়েছেন। মনুষ্যত্ব তথা সজীব দয়া-মায়া স্নেহ প্রীতি ও মহত্ত্বই তাদের পূজ্য। নীতির খোলস ভেদ করে তারা মানুষের মর্মকে দেখতে সক্ষম হয়েছেন। পুরাণকারদের সেই ধারা বয়ে শরৎবাবু সাহিত্য-ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। পূরাণকারদের মতো তিনিও সত্যিকার মনুষ্যত্ব তথা মহত্ত্বের খোঁজে মহত্ত্বই তার কাছে মনুষ্যত্ব আর কিছু নয়–যাত্রা করেন এবং সমাজপরিত্যক্ত তথাকথিত পতিত পতিতাদের মধ্যেই তার সাক্ষাৎ পান, সভ্যভব্য নীতিপরায়ণদের জীবনে নয়। সেখানে তিনি দেখতে পেয়েছেন শুধু মিথ্যার খেলা আর সঙ্কীর্ণতার জয়জয়কার। লেফাফাদুরস্তি ও লেবাসপোরস্তি ঠিকই আছে, নাই কেবল মনুষ্যত্বের প্রতি ঐকান্তিক টান–যার ফলে মানুষ সঙ্কটসঙ্কুল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতেও দ্বিধা করে না।
কিন্তু হিন্দুপুরাণের ধারাবাহী শরৎবাবু সম্বন্ধে যখন হিন্দু অধ্যাপককেই সাবধানবাক্য উচ্চারণ করতে শুনি তখন বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। হিন্দুর ঐতিহ্য-যে নীতির ঐতিহ্য নয়, নীতির চেয়ে বহুগুণে শ্রেয় প্রীতির ঐতিহ্য, মহত্ত্বের ঐতিহ্য হিন্দুঐতিহ্যের ধ্বজাবাহী অধ্যাপক মশাই তা-ই উপলব্ধি করতে পারেন না। যার কথা বলা হল, তিনি আমারও শিক্ষক আর শিক্ষক কি মুরুব্বির সঙ্গে আমি তর্ক করতে পারিনে–ঘাবড়ে যাই, থতমত খেয়ে যাই। নইলে তাঁকে বললুম, শরৎবাবু সম্বন্ধে তো ছেলেদের সাবধান করে দিলেন স্যার, কিন্তু শরৎবাবু যার ধারাবাহী সেই পুরাণ সম্বন্ধে তো কিছু বললেন না–বিষবৃক্ষের আগাটা কাটা হল বটে, কিন্তু গোড়াটা রয়ে গেল যে। উত্তরে তিনি কী বলতেন জানিনে, তবে যা বলতেন তা বোধহয় এইরকম একটা কিছু আন্দাজ করা যায় : হিন্দুর প্রাতঃস্মরণীয় ও প্রাতঃস্মরণীয়াদের জীবনে যা ঘটেছে তা তাদের জীবনেই খাটে, অন্যের জীবনে নয়; একথা হিন্দু জানে, তাকে সে-কথা বুঝিয়ে দেওয়ার দরকার নেই।
জানে বৈকি, নইলে হিন্দুর পতন হবে কী করে? যেদিন থেকে হিন্দু, দেবতাদের জন্য এক জীবন আর নিজের জন্য অন্য জীবন মেনে নিলে সেদিন থেকেই তো তার পতনের সূত্রপাত হল–নীতিধর্মী, অশক্ত, বেদনাবিহীন, দুর্বল জীবন কামনা করার ফলে। জীবনের সমৃদ্ধিকে কামনা না করে কোনোপ্রকারে টিকে থাকাকেই সে বাঞ্ছনীয় মনে করলে। আর সত্যি-সত্যি কোনোপ্রকারেই সে টিকে রইল-museum specimen হয়ে। সেদিন থেকে হিন্দুসমাজে নীতিধর্মী মাঝারির রাজত্ব স্থাপিত হল, এবং অ-নীতিধর্মী মহতেরা অন্তর্ধান করলে। মহতেরা বললে : তোমার নীতি আমি মানিনে।…. জীবন নিয়ে পরীক্ষা করবার অধিকার আমার আছে। আমার ভেতরে যে অমৃত লুকিয়ে আছে তা আমার চাই-ই। আর তা আমাকে আবিষ্কার করে নিতে হবে, তোমার দেওয়া বাধা নীতির অনুসরণ করলে পাওয়া যাবে না। কে তোমাকে শেষ কথা বলার অধিকার দিয়েছে? আমি যে অশেষের পূজারী। ছোট ছোট নীতির বাধনে বেঁধে আমার জীবনকে, আমার আগমনকে ব্যর্থ করে দিও না, আমাকেই আমার উদ্ধারকর্তা হতে দাও, আমার জীবনের নিয়ামক হতে দাও। নীতিধর্মী মাঝারি বললে : চুপ করো, অত সাহস দেখিয়ো না, ঐ পরীক্ষাতে বিলক্ষণ ভয়ের কারণ আছে, ওখানে উন্নতির সম্ভাবনার চেয়ে পতনের সম্ভাবনাই বেশি। সুতরাং সাবধান। উন্নতি না হলে হোড়াই ভাবনা, পতন না হলেই হল। আমার দেওয়া এই নীতির মাদুলি পরিধান করো, পতন থেকে রক্ষা পাবে, আর এই রক্ষা পাওয়াটাই বড় কথা। দেখো না চারিদিকে কেবলই পতনের ফাঁদ। আমার কথা শুনলে তুমি অমৃত পাবে না বটে, কিন্তু বিষ থেকে বেঁচে যাবে। আর তাই তো চাই, অমৃত না-খেলেও বঁচা যায় কিন্তু বিষ খেলে তো বাঁচা যায় না। উত্তরে মুহূর্তকামীরা বললে : তাহলে বিদায়, এক্সপেরিমেন্টের ক্ষুধা আমার রক্তে, তোমার রাজ্যে আমার স্থান নেই। আমি অমৃতাভিসারী, মরণ ভয় আমার নেই। শুধু কোনোপ্রকারে টিকে থাকার সাধনা আমার নয়। মাঝারিরা বললে: ভালোই হল, আপদ গেছে। আমাদের সনাতন শাস্তির রাজ্যে সে অশান্তির হাওয়া বইয়ে দিয়েছিল। কী কেবল অমৃত অমৃত করে! অমৃত কি মানুষের? সে তো দেবতার। দেবতার পাতে হাত দিতে চায় যত অকালকুম্মারা!
দেবতার জন্য প্রেম, দেবতার জন্য মুহূর্ত, দেবতার জন্য সমৃদ্ধি। আমরা শুধু জন্মগ্রহণ করেছি আপিসের বড়বাবুটি হয়ে, বে-থা করে নিশ্চিন্তে ছেলের মাথায় হাতটি রেখে মরে যাওয়ার জন্য। দূরাভিসারী চিত্ত আমাদের নয়, কঠিনের সাধনাকে আমরা ভয় করি। তাই প্রেমকে ভয় করি, মহত্ত্বকে ভয় করি, জীবন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে ভয় করি। মৃত্যুর পরে যার তহবিলে কিছু টাকাপয়সা পাওয়া যায়, সে ব্যক্তিই আমাদের কাছে সার্থক মানুষ, তারই প্রশংসায় আমরা পঞ্চমুখ। আমাদের ছেলেদের তারই চরিত্র অধ্যয়ন ও অনুসরণ করতে বলি। ভুলে যাই যে, অন্তরের দিক দিয়ে যে যতবেশি ছোট, তারি তত বেশি টাকাপয়সা জমাবার সম্ভাবনা। ছোটলোকমির সাধনাই আমাদের কাছে জীবন-সাধনা হয়ে দাঁড়ায়। নীতি এ সাধনার সহায়ক, একটা ধরাবাধা পদ্ধতির অনুসরণ না করলে আর যাই করা যাক টাকাপয়সা করা যায় না। তাই আমরা নীতিধর্মী হয়েছি।